
পাকিস্তান-ভারতের মধ্যে সাম্প্রতিক উত্তেজনা ও অপারেশন সিঁদুর নিয়ে তুমুল বিতর্ক হয়েছে ভারতীয় পার্লামেন্টের উভয় কক্ষে। গত সোম ও মঙ্গলবার এ বিষয়ে একের পর এক প্রশ্ন তোলে বিরোধী দলগুলো।
তবে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে চালানো ওই অভিযানের সাফল্য নিয়ে বেশ সরব প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সরকার। গত এপ্রিলে ভারত অধিকৃত কাশ্মীরের পেহেলগামে বন্দুকধারীদের হামলায় ২৬ জন নিহতের ঘটনায় নতুন করে ইসলামাবাদের সঙ্গে বিবাদে জড়ায় নয়াদিল্লি। ঘটনার জন্য ভারত সরকার পাকিস্তানকে দায়ী করলেও ইসলামাবাদ তা অস্বীকার করে। পাকিস্তান সরকার এর জন্য আন্তর্জাতিক তদন্তের আহ্বান জানায়।
ওই বিবাদের জেরে ৬ মে রাতে ‘অপারেশন সিঁদুর’ নামে পাকিস্তানে হামলা চালায় ভারত। এ থেকে দুই দেশ চারদিনের সংঘর্ষে জড়ায়। ওই সংঘর্ষ থামানোর সাফল্য দাবি করে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছিলেন, দুই পরমাণু শক্তির মধ্যে যুদ্ধ তিনিই থামিয়েছেন। এক্ষেত্রে ‘বাণিজ্য আলোচনা’ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ভারতের পক্ষ থেকে ওই দাবি খারিজ করে আনুষ্ঠানিক বিবৃতিও দেওয়া হয়।
এছাড়া পাকিস্তান প্রথম থেকেই একাধিক ভারতীয় যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করার দাবি করে। যদিও ওই দাবি খারিজ করে দেয় ভারত। সংঘর্ষে ভারতের ক্ষয়ক্ষতি সম্পর্কে আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু জানানো হয়নি। পার্লামেন্টে এ বিষয়গুলো নিয়েই মোদিকে প্রশ্ন করেন রাজনৈতিক বিরোধীরা।
মঙ্গলবার পার্লামেন্টে টানা দুই ঘণ্টা বিরোধীদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন নরেন্দ্র মোদি। শেষে নরেন্দ্র মোদি নিজেই ওই ‘প্রশ্নমালার’ উত্তর দেন মঙ্গলবার এবং যা চলে টানা প্রায় দুই ঘণ্টা।
পেহেলগামে হামলার পরই পাকিস্তানের বিরুদ্ধে নেওয়া সরকারের সিদ্ধান্তকে সমর্থন জানিয়েছিল ভারতের সব রাজনৈতিক দল। দুই দেশের মধ্যে যুদ্ধবিরতি ঘোষণার পর আন্তর্জাতিক স্তরে যে প্রতিনিধিদের পাঠানো হয়েছিল, সেখানেও ভারতের সব রাজনৈতিক দলকেই এক সুরে কথা বলতে শোনা গিয়েছিল।
তবে পার্লামেন্টে আলোচনায় যেন অন্য সমীকরণ ধরা পড়ে। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান নিয়ে প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিংয়ের বক্তব্যের সূত্র ধরে মঙ্গলবার কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী বলেন, ‘উনি বলেছেন যে, অপারেশন সিঁদুর রাত ১টা বেজে ৫ মিনিটে শুরু হয় এবং ২২ মিনিট ধরে চলেছিল। তার পরেই উনি মারাত্মক কথা বলেছেন, রাত ১টা ৩৫ মিনিটে আমরা পাকিস্তানকে জানাই- অসামরিক ঘাঁটিকে নিশানা করা হয়েছে এবং আমরা উত্তেজনা বাড়াতে চাই না। এ ধরনের কথা বলেন দেশের প্রতিরক্ষামন্ত্রী! অপারেশন সিঁদুরের সময়ই ভারতের ডিজিএমওকে ভারত সরকার বলেছিল রাত ১টা ৩৫ মিনিটে সংঘর্ষ-বিরতির কথা বলতে।’
বিজেপিকে কটাক্ষ করে রাহুল গান্ধী বলেন, সরকার লড়াই করতে চায়নি। সরকারের পদক্ষেপের লক্ষ্য ছিল প্রধানমন্ত্রী মোদির ভাবমূর্তি রক্ষা করা। কারণ পেহেলগামে নিহতদের রক্ত তার হাত লেগে আছে।
তিনি অভিযোগ করেন, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যেই সরকার অভিযান চালিয়েছিল।
যুদ্ধবিরতি প্রসঙ্গে রাহুল গান্ধী বলেন, ‘প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প অন্তত ২৯ বার দাবি করেন- তার কথায়ই সংঘর্ষ-বিরতি মেনে নেয় ভারত এবং পাকিস্তান। সব সময় ইন্দিরা গান্ধীর আমলের সঙ্গে তুলনা টানা হয়। ইন্দিরা গান্ধীর ৫০ শতাংশ সাহসও যদি প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে থাকে, তাহলে তিনি সংসদে দাঁড়িয়ে বলুন ট্রাম্প মিথ্যা কথা বলেছেন।’
পার্লামেন্টে নরেন্দ্র মোদি মার্কিন প্রেসিডেন্টের নাম উল্লেখ না করে বলেন, পৃথিবীর কোনো নেতা ভারতকে অপারেশন থামাতে বলেননি।
তিনি বলেন, ‘৯ মে রাতে মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট আমার সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করেন। কিন্তু সে সময় আমি সেনাদের সঙ্গে বৈঠক করছিলাম। পরে যখন আমি ফোন করি, তিনি বলেন পাকিস্তান বড় ধরনের হামলা করতে চলেছে।’
মোদি বলেন, ‘আমি বলেছিলাম যদি পাকিস্তান সত্যিই হামলা করে তাহলে আমরা আরো বড় প্রত্যাঘাত করে জবাব দেব। গুলির জবাব আমরা গোলায় দেব।’
বিশ্বস্তরে ভারত কতটা সমর্থন পেয়েছে- সে প্রশ্নের জবাবে মোদি বলেন, ‘জাতিসংঘের ১৯৩টি দেশের মধ্যে মাত্র তিনটি দেশ পাকিস্তানের পক্ষে বিবৃতি দেয়। আমরা বিশ্বের সমর্থন পেয়েছি কিন্তু এটা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক যে, কংগ্রেস আমাদের সমর্থন করেনি।’ তবে ভারতীয় সরকারের শীর্ষ নেতৃত্বের জবাবে ‘সন্তুষ্ট’ নন বিরোধীরা।
তাদের পাল্টা অভিযোগ, প্রধানমন্ত্রী একবারও ডোনাল্ড ট্রাম্পের নাম সরাসরি আনেননি। পাকিস্তানের সঙ্গে চীনের সমীকরণের বিষয়েও কিছু বলা হয়নি। সাম্প্রতিক অভিযানে ভারতের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণও জানানো হয়নি।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক আরতি জেরত বলেন, বিজেপি পুরো বিষয়টিকে এড়িয়ে যেতে চাইছে।
তার মতে, ‘অপারেশন সিঁদুর নিয়ে প্রথম থেকেই প্রশ্ন এড়িয়ে যাচ্ছে বিজেপি। তারা বিরোধী কেন, কারোরই প্রশ্নের কোনো উত্তর দিতে রাজি নয়। সাধারণ মানুষও তো জানতে চায়- পাকিস্তানের দাবি কি ঠিক? প্রধানমন্ত্রী জবাব দিয়েছেন ঠিকই কিন্তু তার বক্তব্যে কংগ্রেসকে কড়া আক্রমণ করতে বেশি সময় খরচ করেন।’