
দক্ষিণ এশিয়ার নারীরা যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যকার নতুন বাণিজ্যযুদ্ধের বড় ভুক্তভোগী হয়ে উঠতে যাচ্ছেন—এমনই আশঙ্কা প্রকাশ করেছে প্রভাবশালী ব্রিটিশ সাময়িকী দ্য ইকোনমিস্ট। ৩১ জুলাই সংখ্যায় প্রকাশিত ‘সাউথ এশিয়ান ওমেন উইল বি হার্ট বাই দ্য ট্রেড ওয়ার’ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে বিশেষভাবে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক (আরএমজি) খাতের কথা তুলে ধরা হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তার দ্বিতীয় মেয়াদে চীনের ওপর শুল্ক আরোপের সিদ্ধান্ত পুনর্বহাল করার পাশাপাশি বাংলাদেশ, ভিয়েতনাম ও মেক্সিকোর মতো দেশ থেকেও পণ্যে বাড়তি শুল্ক বসানোর কথা বলেছেন। এতে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হবে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাত এবং এই খাতের ওপর নির্ভরশীল নারী শ্রমিকরা।
ট্রাম্পের শুল্কের ছায়া: ৩৫ শতাংশ পর্যন্ত বাড়তে পারে কর
দ্য ইকোনমিস্ট বলছে, আগামী সেপ্টেম্বর থেকে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশসহ দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার কিছু দেশের তৈরি পোশাক পণ্যের ওপর ৩৫ শতাংশ পর্যন্ত পাল্টা শুল্ক আরোপ করতে পারে। এই সিদ্ধান্ত কার্যকর হলে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশি পোশাকের বাজার প্রতিযোগিতায় মারাত্মকভাবে পিছিয়ে পড়বে।
ইকোনমিস্ট বলছে, বাংলাদেশ, যা বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম তৈরি পোশাক রপ্তানিকারক দেশ, বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের ঘোষিত ৩৫ শতাংশ শুল্ক পুনরায় আলোচনার মাধ্যমে পর্যালোচনা করার চেষ্টা করছে। এই শুল্ক কার্যকর হলে তা ওই দিন থেকেই প্রযোজ্য হবে বলে জানিয়েছেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প।
এ প্রসঙ্গে ইকোনমিস্টকে বাংলাদেশ তৈরি পোশাক প্রস্তুত ও রফতানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সাবেক পরিচালক মহিউদ্দিন রুবেল বলেন, “এটি আমাদের জন্য ভয়াবহ বিপর্যয় ডেকে আনবে।”
অবশ্য বৃহস্পতিবার (৩১ জুলাই) রাতে বাংলা ট্রিবিউনকে মহিউদ্দিন রুবেল বলেন, “দি ইকোনমিস্ট-এর প্রতিবেদনটি পূর্ববর্তী পরিস্থিতি বিবেচনায় করা হয়েছে। এতে বাংলাদেশের সাম্প্রতিক অগ্রগতি, বিশেষ করে চলমান পুনঃআলোচনা ও সম্ভাব্য সমাধানের দিকগুলো প্রতিফলিত হয়নি। আমরা আশা করছি, আলোচনার মাধ্যমে একটি ইতিবাচক ফলাফল আসবে এবং ভবিষ্যতে আমাদের অবস্থান আগের চেয়ে ভালো হবে। প্রতিবেদনে যেসব বিক্রির তথ্য তুলে ধরা হয়েছে, সেগুলো মূলত যুক্তরাষ্ট্রের খুচরা বিক্রয়ের প্রেক্ষাপটে ব্যক্তিগত পর্যায়ের চিত্র তুলে ধরে। তাই এ বিষয়ে হতাশ না হয়ে আমাদের আশাবাদী হওয়া উচিত। তিনি আরও বলেন, দেশের পোশাক খাত আন্তর্জাতিক চাপের মধ্যেও স্থিতিশীলতা রক্ষা করতে চায় এবং সরকার ও সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলো এ বিষয়ে সচেষ্ট রয়েছে।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাত থেকে যুক্তরাষ্ট্র বছরে প্রায় ৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের পণ্য আমদানি করে থাকে। ফলে শুল্ক আরোপের ফলে এই বিপুল বাজার হারানোর ঝুঁকিতে পড়বে বাংলাদেশ।
নারীকেন্দ্রিক শিল্প খাতের টিকে থাকার লড়াই
বাংলাদেশের পোশাক শিল্প খাতে প্রায় ৪০ লাখ শ্রমিক সরাসরি যুক্ত, যাদের ৬০ শতাংশেরও বেশি নারী। মূলত গ্রামীণ দরিদ্র নারীরাই এই খাতের মাধ্যমে শহরে এসে আত্মনির্ভরশীল হয়েছেন। তবে নতুন এই শুল্ক নীতির ফলে যদি রপ্তানি আদেশ স্থগিত হয়, তাহলে এই নারীদের কর্মসংস্থান ও জীবিকা মারাত্মকভাবে ঝুঁকির মুখে পড়বে।
দ্য ইকোনমিস্ট লিখেছে, ট্রাম্প প্রশাসনের নতুন শুল্ক নীতির কারণে যুক্তরাষ্ট্রে তৈরি পোশাকের দাম বৃদ্ধি পাবে, তবে সবচেয়ে বড় ক্ষতিগ্রস্ত হবেন দরিদ্র নারী শ্রমিকরা, যারা এই শিল্পে নির্ভরশীল। প্রতিবেদনটি দক্ষিণ এশিয়ার প্রসঙ্গ টেনে বলেছে, ‘ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তান, ভিয়েতনাম ও কম্বোডিয়ার তৈরি পোশাক শিল্পে কয়েক কোটি নারী কর্মরত। এই শিল্পই তাদের আর্থিক স্বাধীনতার পথ তৈরি করেছে।’
বাংলাদেশের চ্যালেঞ্জ ও করণীয়
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পরিস্থিতি মোকাবিলায় বাংলাদেশকে কূটনৈতিকভাবে দ্রুত এবং শক্ত প্রতিক্রিয়া দেখাতে হবে। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় বসে এই শুল্ক নীতি থেকে অব্যাহতি বা হ্রাস আদায়ের কৌশল নিতে হবে। পাশাপাশি নতুন বাজার অনুসন্ধান, রপ্তানি বহুমুখীকরণ ও মূল্য সংযোজন বাড়ানো ছাড়া বিকল্প নেই।
বাংলাদেশের অর্থনীতি অনেকাংশেই রফতানি নির্ভর এবং এর সিংহভাগই তৈরি পোশাক খাত থেকে আসে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বাংলাদেশের রপ্তানির ৮৪ শতাংশ এসেছে আরএমজি খাত থেকে, যার মধ্যে একক বৃহৎ বাজার ছিল যুক্তরাষ্ট্র।
নারীর ক্ষমতায়নের জন্যও হুমকি
বাংলাদেশের পোশাক শিল্প শুধু অর্থনৈতিক উন্নয়নের চালিকাশক্তি নয়, এটি নারীর ক্ষমতায়নের অন্যতম প্রধান মাধ্যম। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) এর এক তথ্যে বলা হয়েছে, পোশাক শিল্পে নারীর অংশগ্রহণ কর্মসংস্থানের মাধ্যমে পরিবার ও সমাজে তাদের মর্যাদা বৃদ্ধি করেছে।
দ্য ইকোনমিস্ট সতর্ক করে বলেছে, ‘দক্ষিণ এশিয়ায় নারীর কাজের সুযোগ সংকুচিত হচ্ছে, আর ট্রাম্পের নতুন বাণিজ্য নীতি তা আরও বাড়াবে।’ বাংলাদেশে যেখানে কর্মজীবী নারীর হার মাত্র ৩৭ শতাংশ, সেখানে আরএমজি খাতের সংকট এই হারকে আরও কমিয়ে দেবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
উল্লেখ্য, যুক্তরাষ্ট্রের নতুন শুল্ক নীতি বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাতকে কঠিন পরীক্ষার মুখে ফেলে দিয়েছে। ফলে কেবল রফতানি আয় নয়, লাখো নারী শ্রমিকের ভবিষ্যৎ এখন ঝুঁকির মুখে। এ অবস্থায় রাষ্ট্র, শিল্প মালিক ও আন্তর্জাতিক অংশীদারদের সম্মিলিতভাবে কাজ করা ছাড়া এই সংকট কাটিয়ে ওঠা সম্ভব নয়।