
বিশ্বব্যাপী বাণিজ্য ও সরবরাহ ব্যবস্থাকে কেন্দ্র করে চীন একটি নতুন শক্তি হয়ে উঠছে। আর এই পরিবর্তনের অন্যতম ভরকেন্দ্র প্রযুক্তি প্ল্যাটফর্ম- লগইংক। এটি মূলত একটি লজিস্টিকস সফটওয়্যার, যেটি সমুদ্রপথে পণ্য পরিবহনের তথ্য ব্যবস্থাপনা এবং জাহাজ ট্র্যাকিংয়ে ব্যবহৃত হয়। যদিও যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা দেশগুলো মনে করে এটি চীনের বৈশ্বিক প্রভাব বিস্তারের একটি কৌশলগত হাতিয়ার।
সম্প্রতি চীনের ন্যাশনাল ট্রান্সপোর্টেশন অ্যান্ড লজিস্টিকস পাবলিক ইনফরমেশন প্ল্যাটফর্ম- লগইংক নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের শুল্ক ও বাণিজ্য নিয়ে বৈঠকের পর। বৈঠকে বেইজিংয়ের সঙ্গে ঢাকার বাড়তে থাকা বাণিজ্য ও সার্বিক সম্পর্ক নিয়ে নিজেদের উদ্বেগের কথা জানিয়েছে ওয়াশিংটন। ঢাকা ও ওয়াশিংটনের একাধিক সূত্রের তথ্য অনুযায়ী, বৈঠকে যেসব বিষয় যুক্তরাষ্ট্র উত্থাপন করেছে বা উদ্বেগ জানিয়েছে সেগুলোর একটি হলো লগইংক। দেশটি চায়, বাংলাদেশের কোনো বন্দর, বন্দর টার্মিনাল, পরিবহন ব্যবস্থা এবং বাণিজ্যিক জাহাজে যেন এ সফটওয়্যার ব্যবহার না হয়।
লগইংক যেভাবে কাজ করে
সফটওয়্যারটি পরিচালিত হয় চীনের পরিবহন মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে। এর উদ্দেশ্য হলো, শিপিং ও কার্গো সংক্রান্ত তথ্য সংগ্রহ করা, বিভিন্ন বন্দর, কাস্টমস ও লজিস্টিকস কোম্পানির মধ্যে রিয়েল-টাইম তথ্য বিনিময় নিশ্চিত করা।
যুক্তরাষ্ট্র-চীন অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তা পর্যালোচনা কমিশনের (ইউএসসিসি) ২০২২ সালের একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী, সফটওয়্যারটি বিভিন্ন দেশের বন্দরের সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে একটি গ্লোবাল ডেটা নেটওয়ার্ক গড়ে তুলছে। এর মাধ্যমে চীন শুধু পণ্যের গতিবিধি নয়, বিশ্বব্যাপী বাণিজ্যের গতিপ্রকৃতি পর্যবেক্ষণ করতে সক্ষম হচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্রের রাইস ইউনিভার্সিটির সহযোগী প্রতিষ্ঠান বেকার ইনস্টিটিউটের ২০২৩ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, লগইংক সরাসরি চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের (বিআরআই) ডিজিটাল মাধ্যম হিসেবে বিবেচিত। যেটি ‘স্মার্ট পোর্ট’ ও ‘ডিজিটাল সিল্ক রুট’ এর ধারণা বাস্তবায়ন করছে। বিআরআই-এর অংশীদার অনেক দেশ এখন লগইংক ব্যবহার করছে। এর মধ্যে আছে পাকিস্তান, কেনিয়া, গ্রিস, ইথিওপিয়া ও ইউরোপের একাধিক বন্দর। এশিয়া পাওয়ার ওয়াচের ২০২৪ সালের এপ্রিলের এক নিবন্ধ অনুযায়ী, বিশ্বের ৯৫টি বন্দরে এই সফটওয়্যার ব্যবহার হয়। এর মধ্যে ৩১টিই ইউরোপের বিভিন্ন দেশের বন্দর। চট্টগ্রাম বন্দরের মুখপাত্র ও সচিব ওমর ফারুক সমকালকে জানিয়েছেন, বন্দর পরিচালনার জন্য এখনো এই নামের কোনো সফটওয়্যার কেনা হয়নি।
বৈশ্বিক বাণিজ্যে প্রভাব
এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলোর অর্থনৈতিক ক্ষমতা বিশ্লেষণ ও মূল্যায়ন নিয়ে কাজ করে ‘এশিয়া পাওয়ার ওয়াচ’। সংস্থাটির ২০২৪ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, লগইংক এর বিস্তৃতি চীনের বাণিজ্যিক সক্ষমতা বহুগুণে বাড়িয়ে দিয়েছে। এটি চীনা কোম্পানিগুলোর জন্য দ্রুত ও সস্তায় পণ্য পরিবহনের সুযোগ তৈরি করছে। পাশাপাশি প্রতিযোগীদের তুলনায় তথ্যভিত্তিক কৌশল গ্রহণ সহজ করেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের উদ্বেগ, চীনের ব্যাখ্যা
সমুদ্রপথসহ বিশ্ব বাণিজ্যে লগইংক দিয়ে চীনা আধিপত্য নিয়ে বিভিন্ন সময়ই উদ্বেগ প্রকাশ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। বার্তা সংস্থা রয়টার্সের ২০২৪ সালের ১০ মার্চের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, সফটওয়্যারটির মাধ্যমে চীন গুরুত্বপূর্ণ সামরিক ও বাণিজ্যিক তথ্য হাতিয়ে নিতে পারে বলে সতর্ক করেছে মার্কিন প্রতিরক্ষা বিভাগ। তথ্যে নজরদারির বিষয়েও শঙ্কা প্রকাশ করা হয় তখন। অন্যতম উদ্বেগের মধ্যে আছে, অর্থনৈতিক অসম প্রতিযোগিতা। মার্কিন ভাষ্য হলো, লগইংক চীনা কোম্পানিগুলোকে তথ্য দিয়ে বাজারে দামে ও গতিতে এগিয়ে রাখে, যা একটি অন্যায্য প্রতিযোগিতা।
‘চীনের লগইংক প্ল্যাটফর্ম কি অর্থনৈতিক অস্ত্র?’- এই শিরোনামে গত বছরের এপ্রিলে একটি নিবন্ধ প্রকাশ করে এশিয়া পাওয়ার ওয়াচ। যেখানে সফটওয়্যারটি নিয়ে চীনের কিছু ভাষ্য তুলে ধরা হয়েছে। বলা হয়েছে, লগইংক কেবলই সামুদ্রিক পরিবহণের দক্ষতা ও নির্ভরযোগ্যতা বাড়ানোর একটি উপকরণ।
লগইংকে নির্ভরশীল বন্দর ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা দিয়ে ২০২৩ সালে মার্কিন কংগ্রেসে আইন পাস হলে এর বিপরীতে চীনের অবস্থান নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করে দেশটির গণমাধ্যম গ্লোবাল টাইমস। এতে বলা হয়, নিরাপত্তা হুমকির দোহাই দিয়ে এমন পদক্ষেপ পুরানো রাজনৈতিক কৌশলের আরেকটি উদাহরণ। বলা হয়, এই প্ল্যাটফর্মের উদ্দেশ্য হলো তথ্য আদান-প্রদানভিত্তিক ডেটাবেস গড়ে তোলা। যাতে ব্যবসায়ী ও পরিবহন সংস্থাগুলো পণ্য পরিবহন, জাহাজের অবস্থান এবং বন্দরের পরিস্থিতি সম্পর্কিত তথ্য ভাগ করে নিতে পারে। এর মাধ্যমে সামুদ্রিক পরিবহনের দক্ষতা ও নির্ভরযোগ্যতাও বাড়ানো সম্ভব।
যুক্তরাষ্ট্র শুল্ক আলোচনায় বাংলাদেশকে লগইংক ব্যবহারে জোরালোভাবে নিরুৎসাহিত করছে। চীন থেকে সামরিক কেনাকাটা কমাতেও বাংলাদেশকে চাপ দিচ্ছে।