Image description

উন্নত প্রযুক্তি, কে-পপ ও কে-ড্রামা দিয়ে বিশ্বকে প্রভাবিত করে এমন একটি গতিশীল, প্রাণবন্ত দেশের ভবিষ্যৎ বেশ অন্ধকারাচ্ছন্ন। বিশ্বের দরবারে দক্ষিণ কোরিয়ার সামগ্রিক চিত্র যেভাবে তুলে ধরা হয়, তার থেকে আলাদা এ দেশটির বাস্তব অবস্থা। দেশটির ভেতরে রয়েছে অন্য একটি ‘দেশ’।

দক্ষিণ কোরিয়া নাম শুনলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে কোরিয়ান ব্যান্ড থেকে শুরু করে সিরিয়াল ও সিরিজগুলো। ‘কোরিয়ান ড্রামা’ অথবা রোমান্টিক ঘরানার সিনেমা কিংবা ওয়েব সিরিজের দিকে বরাবর দর্শকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন কোরিয়ান সিনেমা নির্মাতারা। চীনের উপকণ্ঠে অবস্থিত এ দেশটির বিনোদন জগৎ নিয়ে ভারতসহ সমগ্র বিশ্বের উৎসাহের অন্ত নেই। কিন্তু ড্রামায় দেশটির সামগ্রিক চিত্র যেভাবে তুলে ধরা হয় তার বাস্তবতা ভিন্ন। আত্মহত্যা, মদপান, উদ্বেগ ও হতাশার হার সর্বোচ্চ দক্ষিণ কোরিয়ায়।

এই সামাজিক ব্যাধিগুলো ধীরে ধীরে ঝাঁজরা করে দিচ্ছে কোরিয়ার তরুণ প্রজন্মকে। আর কোরিয়ান শিক্ষাব্যবস্থাও বড় অংশে দায়ী বলে মনে করা হয়। কারণ দক্ষিণ কোরিয়ার শিক্ষাব্যবস্থার শিকড়েই রয়েছে সমস্যা। কারণ প্রাথমিক পাঠেই শিশুদের মধ্যে চালিয়ে দেওয়া হয় প্রতিযোগিতার বীজ। স্কুলগুলোতে অত্যন্ত প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশে শিশুদের শিক্ষাদান শুরু হয়। কোরিয়ান শিক্ষাব্যবস্থার ভিত্তি এতটাই কঠোর যে, মাত্র চার বছর বয়সে প্রাথমিক বি‌ভাগেই প্রবন্ধ লেখায় হাত পাকানো শুরু করতে হয়। মাত্র ১৫ মিনিটে বড় বড় প্রবন্ধ লেখার কৌশল আয়ত্ত করতে হয় একরত্তি পড়ুয়াদের। এ বয়সে অন্যান্য দেশে ভালোভাবে পেন বা পেনসিল ধরতেই পারে না পড়ুয়ারা।

স্কুল শিক্ষার পাশাপাশি বাইরে গৃহশিক্ষকদের কাছে পড়তে পাঠানো হয়। অঙ্ক, ইংরেজি ও সাহিত্যের পাশাপাশি খেলাধুলা এবং শিল্পকলাতেও দক্ষ করে তুলতে বাবা-মায়েরা তাদের ছেলেমেয়েকে এই গড্ডলিকা প্রবাহে ঠেলে দেন। তাদের এমন পাঠ দেওয়া হয়, যাতে তাদের মনে ‘সব কিছু পেতেই হবে’— এমন একটি প্রতিযোগিতামূলক মানসিকতা তৈরি হয়ে যায় শৈশবেই। আর হাইস্কুলের ছাত্রছাত্রীরা স্কুলের নির্ধারিত সময়ের পর মধ্যরাত পর্যন্ত পড়াশোনা চালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। অভিভাবকরা ‘প্রাইভেট টিউশন’কে সন্তানের জন্য বিনিয়োগ বলে ধরে নেন। তারা ধরে নেন এটিই সন্তানের ভবিষ্যতের ভিত্তি। আর এভাবেই দক্ষিণ কোরিয়ায় গৃহশিক্ষকতার ‘বাজার’ লাভজনক বাণিজ্যে পরিণত হয়েছে। পরিসংখ্যান অনুসারে এ দেশে ২৯ হাজার কোটি টাকার লেনদেন হয় শুধু ছাত্রছাত্রী পড়িয়েই।

 

এ অত্যধিক প্রতিযোগিতার অভিশাপের ফল পেতে শুরু করে দিয়েছে বর্তমান প্রজন্মের মধ্যে। দক্ষিণ কোরিয়ার ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে প্রতিযোগিতা মানসিক অসুস্থতার রূপ নিচ্ছে। ফলে  বাড়ছে আত্মহত্যার প্রবণতা। ২০২৫ সালের গোড়ার দিকে একটি আত্মহত্যা প্রতিরোধ সংস্থা জানিয়েছে, দক্ষিণ কোরিয়ায় আত্মহত্যার সংখ্যা গত ১৩ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চপর্যায়ে গেছে।

‘কোরিয়া ফাউন্ডেশন ফর সুইসাইড’-এর তথ্য অনুসারে, গত বছর মোট ১৪ হাজার ৪৩৯টি আত্মহত্যার ঘটনা রিপোর্ট করা হয়েছিল। দৈনিক গড়ের হিসাবে, যা ৩৯.৫। শুধু তাই নয়, ২০২৪ সালে প্রতি ১ লাখ কোরীয় অধিবাসীর মধ্যে ২৮.৩ জন আত্মহত্যা করেছেন। আর এটাই প্রমাণ করে, তরুণ প্রজন্ম অসুস্থ প্রতিযোগিতা সহ্য করতে না পেরে আত্মহননের পথ বেছে নিতে বাধ্য হচ্ছে।

২০৬০ সালে দেশটিতে শুধু বৃদ্ধরাই বেঁচে থাকবেন বলে মনে করা হচ্ছে। এমনিতেই দক্ষিণ কোরিয়ায় জন্মহার খুবই কম। তার ওপর জীবনযাত্রার জটিল পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে সন্তান জন্ম না দেওয়ার প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে দক্ষিণ কোরিয়ায়। গড় জন্মহারে ব্যাপক পরিবর্তন লক্ষ করা গেছে।

এ ছাড়া যেসব দেশে কয়েক দশক ধরে নবজাতকের সংখ্যা তলানিতে ঠেকেছে, তাদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে দক্ষিণ কোরিয়া। বিশ্বব্যাপী উন্নত দেশগুলোতে জন্মের হার কমতে দেখা গেছে, তবে কোরিয়ার মতো চরম সংকটের মুখোমুখি নয় কোনো দেশই। দেশটির জন্মহার এতটাই নেমে গেছে যে, এ প্রবণতা অব্যাহত থাকলে শতাব্দীর শেষ নাগাদ দক্ষিণ কোরিয়ার জনসংখ্যা বর্তমানের তুলনায় এক-তৃতীয়াংশে সঙ্কুচিত হয়ে যেতে পারে।

একটি দেশের সুস্থ ও স্থিতিশীল জনসংখ্যা বজায় রাখার জন্য এই গড়ের প্রয়োজনীয় মান হলো ২.১। অর্থাৎ একজন দক্ষিণ কোরীয় তরুণীকে কমপক্ষে দুজন শিশুর জন্ম দিতে হবে। কমতে কমতে এখন জন্মহার এসে দাঁড়িয়েছে ০.৭ শতাংশে, যা সব রেকর্ডকে ছাপিয়ে গেছে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, তরুণ প্রজন্মের দম্পতিরা একজন শিশুকেও জন্ম দিতে নারাজ।

দক্ষিণ কোরিয়া বর্ণবাদী দেশ। চামড়ার রঙ থেকে শুরু করে মুখের গড়ন ও বাহ্যিক সৌন্দর্যই কোরীয় সমাজে সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য পায়। আর এ বাহ্যিক সৌন্দর্যকে এতটাই প্রাধান্য দেওয়া হয় যে, কলেজ পাশ করার পর ছেলেমেয়েরা বাবা-মায়ের কাছ থেকে উপহার হিসাবে পান প্লাস্টিক সার্জারির খরচ। অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে নিজেদের আরও ‘সুন্দর’ করে তোলেন তারা। সে দেশে প্রতি তিনজনের মধ্যে একজন তরুণী প্লাস্টিক সার্জারি করান।

দেশের বিভিন্ন সংস্থায় চাকরির ইন্টারভিউতেও সৌন্দর্যকে বিশেষভাবে গুরুত্ব দেওয়া হয়। কে কত সুন্দর দেখতে, কার গায়ের রঙ কতটা উজ্জ্বল ও ফর্সা, তার ভিত্তিতে চাকরি দেওয়া হয়। সৌন্দর্য ও বর্ণের ভিত্তিতে বৈষম্য কোরিয়ার চাকরির বাজারে একসময় এতটাই বেড়ে গিয়েছিল যে, নিয়োগ নিশ্চিত করার আগে কোনো কর্মচারীর মুখ না দেখার নিয়ম চালু হয়েছিল বেশ কিছু সংস্থায়। আর কর্মজীবনে প্রবেশ করার পর কোরীয় চাকরিজীবীদের জীবন থেকে অবসর সময় বা ব্যক্তিগত সময় নামক বস্তুটি উধাও হয়ে যায়। সকাল ৯টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত কাজ করার কারণে তাদের ব্যক্তিগত জীবন তলানিতে ঠেকেছে।

 

এ ছাড়া উন্নত দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি কাজ করার জন্য পরিচিত রয়েছে দেশটি। ২০২১ সালে দক্ষিণ কোরিয়ানরা বছরে গড়ে ১,৯১৫ ঘণ্টা কাজ করেছিলেন। নির্দিষ্ট মাপকাঠির চেয়ে প্রায় ২০০ ঘণ্টা বেশি। সে কারণে অতিরিক্ত কাজের চাপ প্রভাব ফেলেছে ব্যক্তিগত জীবনেও।

ন্যাশনাল হেল্‌থ ইনস্যুরেন্স সার্ভিসের গবেষণা বলছে, শুধু কিশোর-কিশোরী নয়, জীবনযাত্রার মান পরিবর্তনের কারণে অকালে বুড়িয়ে যাচ্ছেন সেখানকার তরুণ-তরুণীরাও। ২০ থেকে ৩০ বছর বয়সিদের মধ্যে ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, গাউট এবং আর্থ্রাইটিসের মতো রোগের তীব্রতা বৃদ্ধি পেয়েছে।