Image description

৪ জুলাই ২০২৫, শুক্রবার ভোর ৩:৩০ মিনিট। যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাসের স্থানীয় সময়। হারবার পরিবারের ঘুম ভাঙল তুমুল বৃষ্টি, বজ্রপাত এবং বিদ্যুৎ চমকানোর শব্দে। টেক্সাসের আকস্মিক বন্যায় আক্রান্ত অনেক পরিবারের মধ্যে একটি হলো এই হারবার পরিবার। গরমের ছুটি কাটাতে যারা এসেছিল টেক্সাসের হান্টের কাছে কাসা বনিটা কেবিন কমিউনিটিতে। যেখানে তাদের নিজস্ব কেবিন ছিল। 

এর কয়েক ঘণ্টা আগে বাবা আরজে হারবার অন্য এলাকায় আকস্মিক বন্যা হতে পারে বলে সতর্কবার্তা পেয়েছিলেন। কিন্তু তাঁরা যেখানে ছিলেন, সেখানকার জন্য কোনো সতর্কতা ছিল না।

আরজে হারবারের বয়স ৪৫। যুক্তরাষ্ট্রের ডালাসে আইনজীবী হিসেবে কাজ করেন। সারা জীবন ধরে তিনি এই এলাকায় ছুটি কাটিয়েছেন, গ্রীষ্মকালীন ক্যাম্পে এসেছেন। তিনি ভেবেছিলেন, নদী হয়তো কিছুটা ফুলে উঠবে। তিনি তাঁর দুই ছোট মেয়ে, ১১ বছর বয়সী ব্রুক এবং ১৩ বছর বয়সী ব্লেয়ারকে ফুলে ওঠা নদী দেখতে চেয়েছিলেন।

মেয়েরা তাদের দাদা-দাদি, মাইক এবং শার্লিন হারবারের সঙ্গে নদীর কাছাকাছি একটি ভাড়া করা কেবিনে ছিল। আরজে ভেবেছিলেন, তিনি নদী থেকে তার কায়াক এবং কিছু মাছ ধরার সরঞ্জামও সরিয়ে আনবেন।

'আমি ফ্ল্যাশলাইট জ্বেলে বাইরে দেখলাম। সাদা ফেনাযুক্ত পানিতে ভরে গেছে। আমি কায়াকিং করার অভিজ্ঞতা থেকে জানি, এটি পার হওয়া অসম্ভব ছিল।'
বাবা আরজে হারবার

তিনি তার কেবিনের মেঝেতে পা দিয়েই দেখলেন প্রায় ৪ ইঞ্চি পানিতে তলিয়ে গেছে। আরজের স্ত্রী পাশেই বিছানায় জেগে ছিলেন। তিনি বললেন, 'অ্যানি, কেবিনে বন্যা হচ্ছে।' আরজে দেখতে পাচ্ছিলেন, সামনের দরজা দিয়ে স্রোতের মতো পানি ঢুকছে। তিনি দরজা খোলার চেষ্টা করেও পারলেন না। জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখলেন, পানির স্তর জানালা থেকে প্রায় দুই ফুট নিচে।

 
হারবার পরিবারছবি: আরজে হারবার

'আমাদের এখনই বের হতে হবে,' অ্যানিকে বললেন আরজে। তাঁরা হাতের কাছে পেলেন ফোন আর একটা ব্যাগ, যেটা এখনো খোলা হয়নি। এগুলো নিয়ে জানালা দিয়ে পানিতে ঝাঁপ দিলেন। পানি তখন অ্যানির গলা পর্যন্ত পৌঁছে গেছে।


আরজে ও অ্যানি দ্রুত কাছাকাছি কিছুটা উঁচু জমিতে থাকা অন্য একটি কেবিনে গেলেন। দরজায় ধাক্কা দিয়ে সেই কেবিনে থাকা পরিবারকে জাগিয়ে তুললেন। সেই পরিবার যখন দরজা খুলল, তখন পানি বেড়ে প্রায় তাঁদের দরজায় পৌঁছে গেছে। অন্য একটি কেবিনে গিয়ে তারা তৃতীয় একটি পরিবারকেও জাগিয়ে তুললেন।

আরজে একটি কায়াক, লাইফ ভেস্ট এবং ফ্ল্যাশলাইট ধার নিলেন। কায়াক নিয়ে রওনা দিলেন সেই কেবিনের দিকে, যেখানে তার দুই মেয়ে এবং বাবা-মা ছিলেন। কেবিনটি প্রায় ১০০ ফুট নিচে ছিল। তিনি প্রায় অর্ধেক পথ যেতেই একটি ঢেউ তাঁকে একটি খুঁটিতে ধাক্কা দিল।

 
দাদা-দাদী, মাইক এবং ক্যারলিন হারবার, যারা ভেসে গেছেন আকস্মিক বন্যায়ছবি: আরজে হারবার

আরজে বলেছেন, 'আমি ফ্ল্যাশলাইট জ্বেলে বাইরে দেখলাম। সাদা ফেনাযুক্ত পানিতে ভরে গেছে। আমি কায়াকিং করার অভিজ্ঞতা থেকে জানি, এটি পার হওয়া অসম্ভব ছিল।'

তিনি দেখতে পেলেন, একটি পুরো কেবিন মাটি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। যেখানে তার মেয়ে ও বাবা-মা ছিলেন, সেই কেবিনের পাশে গিয়ে কেবিনটি আটকে আছে। 'আমার দিকে গাড়ি ভেসে আসছিল, গাছ ভেসে আসছিল। আমি জানতাম, যদি আমি আর এক ধাপও এগিয়ে যাই, তাহলে আমার নিশ্চিত মৃত্যু হবে।

আরজে তাঁর স্ত্রী এবং বাকি পরিবারগুলোকে সাহায্য করার জন্য ফিরে এলেন। তাঁরা হাইওয়ে ৩৯-এর ওপরে কাছাকাছি একটি উঁচু বাড়িতে গেলেন, যেখানে একটি পরিবার তাদেরকে ভেতরে ঢুকতে দিল। তখন বাজে ভোর ৩:৪৫।

 
ব্রুক এবং ব্লেয়ারছবি: আরজে হারবার

ঠিক তখনই আরজে তাঁর মোবাইল ফোন চেক করলেন। ভোর ৩:৩০ মিনিটে তার মেয়ে ব্রুকের পাঠানো একটি মেসেজ দেখতে পেলেন। এখানে সাধারণত ফোনের সিগন্যাল পাওয়া যায় না, সেখানে এই মেসেজ পাওয়াটা একটি অলৌকিক ঘটনা বটে। মেসেজে লেখা ছিল, 'আমি তোমাকে ভালোবাসি'।

মা অ্যানি কাজ করতেন সেন্ট রিটা ক্যাথলিক স্কুলে। তাঁদের দুই মেয়ে ব্রুক এবং ব্লেয়ার এই স্কুলেই পড়ত। দুজনের কাছ থেকেই ভোর ৩:৩০ মিনিটে তিনিও একই মেসেজ পান, যেখানে লেখা ছিল 'আই লাভ ইউ'।

মিশিগানে থাকা ব্রুক এবং ব্লেয়ারের নানাও একই মেসেজ পেয়েছিলেন। সঙ্গে মেয়েরা তাঁকে পাঠিয়েছিল তাঁর সঙ্গে মেয়েদের একটি ছবি।


অন্যদিকে হারবার এবং অন্যান্য পরিবার সারারাত বিদ্যুৎবিহীন অবস্থায় অপেক্ষা করলেন। শুনলেন ভয়ংকর সব শব্দ। পরদিন সকালে তারা বুঝতে পারলেন, আসলে এই শব্দগুলো ছিল কেবিনগুলো ভেঙে টুকরো টুকরো হওয়ার।

সূর্য ওঠার সময়ই পানি এত নেমে গিয়েছিল, আরজে নিজের কেবিনে ফিরে যেতে পেরেছিলেন। এখানকার কমিউনিটির ২০টিরও বেশি কেবিনের মধ্যে টিকে ছিল মাত্র ৬টি। বাকিগুলো মেঝে থেকে উপড়ে গিয়েছিল। শুধু মাটির ওপরে পড়ে ছিল টাইলসের মেঝে। ব্লেয়ার, ব্রুক এবং তাদের দাদা-দাদি যে কেবিনে ছিলেন, সেটি সম্পূর্ণভাবে ভেসে গিয়েছিল।

ব্লেয়ার এবং ব্রুকের মৃতদেহ কেবিন থেকে প্রায় ১২ মাইল দূরে পাওয়া যায়। দাদার মৃতদেহ সোমবার উদ্ধার করা হয়। দাদি সোমবার বিকেল পর্যন্ত নিখোঁজ ছিলেন।

হারবার পরিবার ২০২০ সাল থেকে কাসা বনিটার কেবিনটির মালিক ছিল। পরিবার প্রায়ই সেখানে কায়াক করতে, মাছ ধরতে এবং শিশুদের খেলাধুলার জন্য যেত। আরজে বলেছেন, 'দুর্ভাগ্য হলো, সে সব দারুণ স্মৃতি এখন একটি বিপন্ন স্মৃতিতে পরিণত হয়েছে।'

টেক্সাসে আকস্মিক বন্যায় এখন পর্যন্ত মারা গেছে ১০০ জন। নিখোঁজ রয়েছে অন্তত ১১ জন। নিখোঁজ মানুষদের উদ্ধারে তল্লাশি চলছে। এরই মধ্যে কিছু হৃদয়বিদারক গল্প সামনে আসতে শুরু করেছে। এই যেমন হারবার পরিবারের গল্প। 

সূত্র: ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল