গত দুই দশকের মধ্যে এবার এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষার ফলাফলে ধস নেমেছে। সদ্য প্রকাশিত পাবলিক এই পরীক্ষায় পাসের হার ৫৮ দশমিক ৮৩ শতাংশ। পাস করেছেন ৭ লাখ ২৬ হাজার ৯৬০ পরীক্ষার্থী আর ফেল করেছেন ৫ লাখ ৮ হাজার ৭০১ জন। এ অবস্থায় দেশে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার্থী ভর্তি কমতে পারে। বিশেষ করে শিক্ষার্থী কম থাকা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার্থী সংকট আরও বাড়বে বলে ধারণা করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। তবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো উচ্চশিক্ষার গুণগত মান ধরে রাখতে পারলে এ সংকট কাটিয়ে ওঠা সম্ভব বলে মনে করছেন তারা।
জানা গেছে, বর্তমানে দেশের শতাধিক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে একেডেমিক কার্যক্রম সচল রয়েছে। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো বেসরকারি এসব বিশ্ববিদ্যালয় সরকার থেকে কোনো ধরনের আর্থিক অনুদান পায় না। ফলে এসব বিশ্ববিদ্যালয় চলে স্টুডেন্ট এনরোলমেন্ট তথা শিক্ষার্থী ভর্তি দিয়ে। যত বেশি শিক্ষার্থী ভর্তি, তত বেশি রেভিনিউ (আয়) নীতিতে চলে এসব বিশ্ববিদ্যালয়। তাই শিক্ষার্থী এনরোলমেন্ট কমলে রিভিনিউয়ে হিট হয়। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আর্থিক সংকটে পড়ে। অনেক সময় বন্ধও হয়ে যায়।
‘উচ্চশিক্ষার জন্য শিক্ষার্থীরা প্রথমে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নেয়। সেখানে চান্স না পেলে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে আসে। তবে আমি মনে করি, কোয়ালিটি নিশ্চিত করতে পারা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো শিক্ষার্থী সংকটে পড়বে না-অধ্যাপক ড. মো. আখতার হোসেন খান, উপাচার্য, স্টেট ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের (ইউজিসি) সর্বশেষ বার্ষিক প্রতিবেদনের তথ্যমতে, দেশে সচল থাকা (শিক্ষার্থী ভর্তি আছে) বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ১০২টি। এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৩ লাখ ৫৮ হাজার ৪১৪ জন। গড়ে শিক্ষার্থী সংখ্যা প্রায় সাড়ে তিন হাজার। তবে শিক্ষার্থী সংখ্যায় প্রথম সারির বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সর্বোচ্চ ২৩ হাজার থেকে সর্বনিম্ন ৬ হাজার পর্যন্ত রয়েছে। অপর দিকে শিক্ষার্থী সংখ্যায় সবচেয়ে ছোট বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সংখ্যা মাত্র ৫৩ জন।
ইউজিসি সর্বশেষ বার্ষিক প্রতিবেদন ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সংশ্লিষ্টদের তথ্যমতে, সর্বোচ্চ ২৩ হাজার থেকে সর্বনিম্ন ৬ হাজার পর্যন্ত শিক্ষার্থী রয়েছে এমন বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ২১টি। সর্বোচ্চ নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটিতে ২৩ হাজার ১১৩ জন। সর্বনিম্ন ৩ হাজার থেকে সর্বোচ্চ ৬ হাজার রয়েছে এমন মাঝারি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ১৪টি। সর্বনিম্ন ৫০ থেকে সর্বোচ্চ ৩ হাজার রয়েছে এমন সংখ্যায় ছোট বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। ১০২টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে এই সংখ্যা ৬৭টি। সর্বনিম্ন ৫৩ জন শিক্ষার্থী রয়েছে ইউনিভার্সিটি অব স্কিল এনরিচমেন্ট অ্যান্ড টেকনোলজিতে।
ইউসিজির নির্দেশনা মতে, দেশের সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক ও সমমান পর্যায়ে ভর্তিতে উচ্চমাধ্যমিক/মাধ্যমিকের সর্বনিম্ন জিপিএ-২.৫০ প্রয়োজন হয়। তবে বিশ্ববিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিষয় (সাবজেক্ট) ভেদে সেটি আরও বাড়ানো হয়। অন্যদিকে ২০২৫ সালের এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় পাস করা ৭ লাখ ২৬ হাজার ৯৬০ শিক্ষার্থীর মধ্যে জিপিএ-৩ থেকে জিপিএ-৫ পেয়েছেন ৬ লাখ ১৫ হাজার ৪৪৮ জন।
তথ্যমতে, উচ্চমাধ্যমিক শেষ করা এই ৬ লাখের বেশি শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষায় প্রবেশ করতে প্রথমে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষায় (উচ্চমাধ্যমিক/মাধ্যমিকের জিপিএর যোগ্যতা থাকলে) অংশ নেবেন। সেখানে চান্স না পেলে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে কিংবা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় অধিভুক্ত কলেজগুলোতে ভর্তি হতে আসবেন।
ইউজিসির ওয়েবসাইটের সর্বশেষ তথ্যমতে, দেশে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ১১৬টি। এর মধ্যে ২০টির মতো বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের ভর্তির আগ্রহ থাকে। তাছাড়া একাডেমিক কার্যক্রম বন্ধ/চালু নেই এমন সংখ্যা ডজন খানেক। বাকি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সাধারণত কম জিপিএ পাওয়া শিক্ষার্থীরা ভর্তি হন।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সাধারণত ডুয়াল ও ট্রাই সেমিস্টার পদ্ধতিতে শিক্ষার্থী ভর্তি করা হয়। ডুয়াল সেমিস্টার জানুয়ারি ও জুলাই মাসে শুরু হয়। আর ট্রাই সেমিস্টারের বিষয়গুলোতে স্প্রিং (জানুয়ারি-এপ্রিল), সামার (মে-আগস্ট), ফল (সেপ্টেম্বর-ডিসেম্বর)—এই তিনবার ভর্তির সুযোগ রয়েছে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সংশ্লিষ্টরা জানান, দেশের প্রথম সারির হাতে গোনা কয়েকটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া অধিকাংশ উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রতিবছর কাঙ্ক্ষিত শিক্ষার্থী ভর্তিতে হিমশিম খেতে হয়। ফলে ছাত্র সংকটে ভোগে এসব বিশ্ববিদ্যালয়। এ কারণে ছাত্র ভর্তিতে বিভিন্ন অফার দিতে হয়—ওয়েবার, বিশেষ ছাড়া, স্কলারশিপ। উচ্চমাধ্যমিকে রেকর্ড কম পাসের কারণে স্বাভাবিকভাবেই শিক্ষার্থী সংকটে পড়বে এবার।
স্টেট ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতার হোসেন খান দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ‘এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় পাসের হার কম হওয়াতে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার্থী ভর্তি কিছুটা কমতে পারে, সংকট হতে পারে। তবে এবার এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষার ফলে জিপিএ-৫ কমেছে ঠিকই। কিন্তু জিপিএ-৪, জিপিএ-৪.৫ তো আর কমেনি।’
তিনি আরও বলেন, ‘উচ্চশিক্ষার জন্য শিক্ষার্থীরা প্রথমে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নেয়। সেখানে চান্স না পেলে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে আসে। তবে আমি মনে করি, কোয়ালিটি নিশ্চিত করতে পারা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো শিক্ষার্থী সংকটে পড়বে না।’
ইস্টার্ন ইউনিভার্সিটির উপাচার্য ও বাংলাদেশ সোসাইটি ফর প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি একাডেমিকসের প্রেসিডেন্ট প্রফেসর ড. ফরিদ আহমদ সোবহানী দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ‘এবারের এইচএসসি পরীক্ষায় পাসের হার কমে যাওয়া মানে মোট পরীক্ষার্থীর তুলনায় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিযোগ্য শিক্ষার্থীর সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যাওয়া। এর সরাসরি প্রভাব পড়বে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের ভর্তি প্রক্রিয়ায়। কারণ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো প্রধানত শিক্ষার্থীদের টিউশন ফি-নির্ভর প্রতিষ্ঠান। ফলে ভর্তি সংখ্যা কমে গেলে অনেক বিশ্ববিদ্যালয় আর্থিক সংকটের মুখোমুখি হতে পারে।’
ইউজিসির সর্বশেষ বার্ষিক প্রতিবেদনের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, সর্বোচ্চ সংখ্যক শিক্ষার্থী নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটিতে ২৩ হাজার ১১৩ জন, দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে ২১ হাজার ৩০৩ জন, তৃতীয় সর্বোচ্চ ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি ১৭ হাজার ৩২৫ জন, চতুর্থ সর্বোচ্চ ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিট ১২ হাজার ২২০ জন এবং সর্বনিম্ন ৫৩ জন শিক্ষার্থী রয়েছে ইউনিভার্সিটি অব স্কিল এনরিচমেন্ট এন্ড টেকনোলজিতে।
তিনি বলেন, ‘বিশেষ করে অপেক্ষাকৃত নতুন বা ছোট আকারের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জন্য এটি একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াতে পারে। তাদের প্রশাসনিক ও একাডেমিক ব্যয় নির্বাহ করা কঠিন হয়ে পড়বে। যদি ভবিষ্যতেও এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফলের নিম্নগামী এ ধারা অব্যাহত থাকে, তবে কিছু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় টিকে থাকার সংগ্রামে পড়বে—এমন আশঙ্কা অমূলক নয়।’
‘তবে ইতিবাচক দিক হলো, এই পরিস্থিতি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে আরও মানসম্মত শিক্ষা, প্রযুক্তিনির্ভর শিক্ষণ পদ্ধতি, দক্ষ মানবসম্পদ গঠন এবং শিক্ষার্থী আকর্ষণের উদ্ভাবনী কৌশল গ্রহণে উৎসাহিত করতে পারে। মানসম্মত বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বরাবরের মতোই শিক্ষার্থী আকর্ষণে সক্ষম হবে বলে আমি মনে করি।’
রাজধানীর একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বোর্ড অব ট্রাস্টিজের এক সদস্য দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ‘কোয়ালিটি এডুকেশন নিশ্চিত করতে হিমশিম খেতে হবে বিশ্ববিদ্যালয়কে। কেননা এবার শিক্ষার্থী ভর্তিতে অনেক ছাড় দিতে হবে তাদের। নর্থ সাউথ-ব্র্যাকের মতো প্রথম সারির উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষার্থী সংকট হবে না। তবে একেবারে নতুন এবং যেসব বিশ্ববিদ্যালয় স্ট্রাগলিং করছে তারা ভালোই ক্ষতিগ্রস্ত হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘সরকার কিন্তু কোনো সাপোর্ট দেয় না বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে। তারা চলে শিক্ষার্থীদের এনরোলমেন্ট দিয়ে। যত বেশি শিক্ষার্থী ভর্তি হয়, তত বেশি তাদের রিভিনিউ আসে। তাই শিক্ষার্থী এনরোলমেন্ট কমলে রিভিনিউতে হিট হবে। ক্ষতিগ্রস্ত হবে বিশ্ববিদ্যালয়।’
‘অনেকেই (বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ) ধরে নিয়েছে আসন্ন সেমিস্টারে শিক্ষার্থী এনরোলমেন্ট কমবে। তবে আবার অনেকেই মনে করছে, এবার পাসের হার কম হওয়াতে যারা তুলনামূলকভাবে কম জিপিএ পেয়েছে, তারা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় অংশ না নিয়ে সরাসরি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে আসবে। তাই শিক্ষার্থী সংকটে পড়বে কি না, আসলে এখন বুঝা যাচ্ছে না।’
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সমিতির পরিচালক বেলাল আহমেদ দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ‘এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় পাসের হার ও জিপিএ-৫ এবার কমেছে। তার কিছুটা প্রভাব বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী ভর্তিতে পড়বে। তবে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তির যে যোগ্যতা (জিপিএ) রয়েছে, তাতে অধিকাংশ শিক্ষার্থী আবেদন করতে পারবে।’