 
              ঢাকাই চলচ্চিত্রে নব্বইয়ের দশকের শুরুর দিকে হঠাৎ করেই একঝলক আলো ছড়িয়ে পড়েছিল—সেই আলোয় দেখা মিলেছিল সালমান শাহ নামের এক তরুণ নায়কের। তাঁর সঙ্গে জুটি বেঁধে পর্দায় হাজির হন শাবনূর। চার বছরের সংক্ষিপ্ত সময়েই তাঁরা একসঙ্গে ১৪টি চলচ্চিত্রে অভিনয় করে বাংলা সিনেমার ইতিহাসে গড়ে তোলেন এক অধ্যায়। সময় গড়িয়ে গেছে, কিন্তু সালমান–শাবনূরের জুটির জনপ্রিয়তা আজও অমলিন।
বর্তমানে অস্ট্রেলিয়ায় পরিবারের সঙ্গে বসবাস করছেন শাবনূর। এর মধ্যে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেন তিনি। দীর্ঘদিন পর সালমান শাহকে নিয়ে খুলে বলেন মনের কথা, ভাঙেন নীরবতার দেয়াল। শাবনূর বলেন, ‘সালমান শাহ আর আমাকে নিয়ে অনেক কথা হয়েছে। তাঁদের উদ্দেশে শুধু বলব, এসবের কোনো কথাই সত্য নয়। সালমানের কোনো বোন ছিল না, তাই আমাকে ছোট বোনের মতোই দেখতেন। আমাকে “পিচ্চি” বলে ডাকতেন। তাঁর মা-বাবাও আমাকে খুব আদর করতেন, মেয়ের মতোই ভালোবাসতেন।’
নিজের অনুভবের কথা জানাতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘আমিও সালমানকে ভাইয়ের মতোই দেখতাম। তবে আমাদের মধ্যে ছিল দারুণ বন্ধুত্ব। সালমান নাচে একটু দুর্বল ছিল। প্রায়ই বলতেন, “আমাকে একটু নাচ দেখিয়ে দে তো।” আমি হাসতে হাসতে দেখিয়ে দিতাম।’
সালমান-শাবনূরের সম্পর্ক ভাইবোনের মতো ছিল বলে জানান সালমান শাহর সেই সময়ের সহকারী মুনসুর আলী । বলেন, ‘আমি সাড়ে চার বছর সালমান ভাইয়ের সঙ্গে ছিলাম। তাঁদের প্রেমের সম্পর্কের বিষয়ে কিছু জানি না। বরং ভাই সব নায়িকাকেই সম্মান করতেন। শাবনূরকে প্রথম দেখেই বলেছিলেন, “আমার তো কোনো বোন নেই, তুমি আমার ছোট বোনের মতো।”’
সালমানের সঙ্গে শাবনূরের প্রথম দেখা হয়েছিল এফডিসিতে, সেদিন মৌসুমীর সঙ্গে সালমানের শুটিং চলছিল। পরবর্তী সময়ে ‘তুমি আমার’ ছবিতে সালমানের সঙ্গে কাজের সুযোগ হয় শাবনূরের। সেই ছবির সাফল্যের পর দর্শকেরা তাঁদের নতুন জুটিকে ভালোবাসতে শুরু করেন। শাবনূর বললেন, ‘আমাদের বোঝাপড়াটা ছিল অসাধারণ, একই দৃশ্যে আমরা একে অন্যের চোখের ইশারা বুঝতে পারতাম।’
সালমান–শাবনূরের মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক ছিল—এমন গুঞ্জন দুজনের কাজের শুরু থেকেই প্রচলিত। শাবনূরের ভাষায়, ‘সালমানকে আমি ভাই ছাড়া অন্য কোনো চোখে দেখিনি। কিছু মানুষ আমাদের সম্পর্ক নিয়ে নানা মুখরোচক গল্প বানিয়েছে। কেউ কেউ সেটা দিয়ে ব্যবসাও করেছে। এতে আমার কষ্ট হয়েছে; কারণ, আমি আমার ক্যারিয়ারটা অনেক কষ্ট করে গড়েছি।’
সালমানের স্ত্রী সামিরা হক সম্পর্কেও কথা বলেন শাবনূর। ‘সামিরা আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিল। শুটিংয়ে প্রায় সব সময়ই সে থাকত। আমাদের মধ্যে কখনো কোনো মনোমালিন্য হয়নি। সামিরা নিজে আমার হাতে চুড়ি পরিয়ে দিয়েছে, পোশাক মিলিয়ে দিয়েছে, কানের দুল বেছে দিয়েছে—আমরা সত্যিই খুব ভালো সময় কাটিয়েছি।’ বললেন শাবনূর।
সালমানের মৃত্যুসংবাদ পাওয়ার মুহূর্তটিকে জীবনের সবচেয়ে বড় ধাক্কা বলে মনে করেন শাবনূর। ‘হঠাৎ কেউ একজন জানাল, সালমান মারা গেছে। আমি বিশ্বাসই করতে পারিনি। ভেবেছিলাম কেউ মজা করছে। পরে নিশ্চিত হয়ে পুরোপুরি ভেঙে পড়েছিলাম। এরপর এফডিসিতে গিয়ে ওকে শেষবার দেখি।’ বললেন শাবনূর।
স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে শাবনূর বলেন, ‘সালমান যদি বেঁচে থাকত, বাংলা চলচ্চিত্রের চেহারাটা আজ ভিন্ন হতো। যেমন উত্তম কুমার আর সুচিত্রা সেনের জুটি এখনো কিংবদন্তি, আমরা হয়তো তেমনভাবেই জায়গা করে নিতে পারতাম।’ শেষে তিনি বলেন, ‘যদি কোনো দিন সালমানের সঙ্গে দেখা হতো, আমি তাঁকে জিজ্ঞেস করতাম—সালমান, তুমি কেন মরে গেলে? তোমার কী কষ্ট ছিল? এত সাফল্য, এত ভালোবাসা থাকা সত্ত্বেও কেন তুমি চলে গেলে?’
সালমান-শাবনূর অভিনীত চলচ্চিত্রের সংখ্যা ১৪টি। ছবিগুলো হচ্ছে ‘তুমি আমার’, ‘বিক্ষোভ’, ‘সুজন সখি’, ‘স্বপ্নের ঠিকানা’, ‘মহামিলন’, ‘বিচার হবে’, ‘তোমাকে চাই’, ‘স্বপ্নের পৃথিবী’, ‘জীবন সংসার’, ‘চাওয়া থেকে পাওয়া’, ‘প্রেম পিয়াসী’, ‘স্বপ্নের নায়ক’, ‘আনন্দ অশ্রু’ ও ‘বুকের ভেতর আগুন’।
সালমান শাহ হয়তো আজ নেই, কিন্তু তাঁর উপস্থিতি এখনো জীবন্ত বাংলা সিনেমার পর্দায়, দর্শকের স্মৃতিতে। শাবনূর জানেন, সময় যতই পেরিয়ে যাক, তাঁদের নাম একসঙ্গেই উচ্চারিত হবে—বাংলা চলচ্চিত্রের সবচেয়ে প্রিয় ও জনপ্রিয় জুটি হিসেবে।
 
       
                 
                
 
                                                  
                                                  
                                                  
                                                  
                                                 