Image description

আজ ১৬ ডিসেম্বর। ১৯৭১ সালের আজকের দিনে সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে অসংখ্য শহীদ ও মা বোনের সম্ভ্রমহানির মাধ্যমে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটি স্বাধীনতা অর্জন করে। পাকিস্তানীদের লাগাতার শোষণ ও নির্মম নৃশংসতার জবাব দিতে গিয়ে বাংলাদেশের সর্বস্তরের মানুষ সশস্ত্র যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। ভারত এই যুদ্ধে বাংলাদেশকে সামরিক ও আশ্রয়দাতা হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। সেই সময়কার প্রেক্ষাপটে এটি বোঝা না গেলেও এখন ভারতের চরম আধিপত্যবাদী আচরণের কারণে বর্তমান প্রজন্ম মনে প্রাণে বিশ্বাস করে, ভারত তাদের স্বার্থেই ১৯৭১ সালে বাংলাদেশকে সাহায্য করেছিল। সে সময়কার রাজনীতিকরাও এটি একেবারেই যে বুঝতে পারেননি, সেটিও পুরোপুরি সঠিক ধারণা নয়। কারণ বদরুদ্দিন ওমর, তাজউদ্দিন আহম্মেদ, সেক্টর কমান্ডার মেজর জলিল-সহ অনেক লেখকের গ্রন্থ থেকে জানা যায় যে, ভারত মূলত পাকিস্তানকে শায়েস্তা করেতই এই যুদ্ধে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়। এই প্রসংগে ১৯৬৫ সালের পাক ভারত যুদ্ধের ইতিহাস অত্যন্ত তাৎপর্যমণ্ডিত। এই যুদ্ধে ভারত শোচনীয় পরাজয় বরণ করে। আর তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তানের বীর সেনানীরা দোর্দণ্ডপ্রতাপে ভারত দখল করে নেয়। তখন ভারত মনে করে দুই পাকিস্তান এক থাকলে তারা কখনই পাকিস্তানকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না। সাথে সাথে দক্ষিণ এশিয়া পুরোটাই ভারতের হাতছাড়া হবে। ফলে ভারতের কুখ্যাত গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’ ষঢ়যন্ত্র শুরু করে এবং শেখ মুজিব সেই ষঢ়যন্ত্রে বুঝে- না বুঝেই পা দেয়। চলতে থাকে পূর্ব পাকিস্তান নিয়ে ষঢ়যন্ত্র। সেই ষঢ়যন্ত্র যুদ্ধে গড়ায়। পাকিস্তান সরকারও চিরশত্রু ভারতের সাথে সম্পর্ক রাখার জন্য বাংলাদেশের [পূর্ব-পাকিস্তান] উপর মারাত্মক আক্রমণাত্মক হয়। দুই পাকিস্তানের মাঝে বাধে মহাযুদ্ধ। ২৫ মার্চের কাল রাত্রির জঘণ্য হত্যাকাণ্ড পাকিস্তানকে সারা বিশ্বে মারাত্মক সমালোচনার মধ্যে ফেলে।


বাংলাদেশের উত্তম বন্ধু হিসেবে দাবি করা হলেও ভারত বাংলাদেশকে দাসী মনে করে। একজন লেন্দুপ দর্জির জন্য সিকিম ভারতের সাথে মিশে গেলেও ভাংলাদেশে গুরুত্বপূর্ণ সব সেক্টরেই বহু লেন্দুপ দর্জি থাকলেও বাংলাদেশ ভারতের অংগরাজ্যে পরিণত হয়নি। কারণ আলেম ওলামা ও দেশপ্রেমিক জাতীয়তাবাদি শক্তির জন্যই সেটি সম্ভব হয়নি বলেই এদেশের আলেম ওলামা ও ডানপন্থী জাতীয়তাবাদী শক্তি বরাবরই ভারতের কাছে চরম শত্রু হিসেবে চিহ্নিত। প্রকৃতপক্ষে, ভারত ও বাংলাদেশের সম্পর্ক কখনই মর্যাদাপূর্ণ ছিলো না। আর বিগত ১৮-২৪ মাসে সম্পর্কের টানাপোড়েন এমন মাত্রায় পৌঁছেছে যে, তা দিল্লি-ঢাকা এবং বৃহত্তর অঞ্চলকে একটি সূক্ষ্ম প্রশ্নের মুখোমুখি হতে বাধ্য করেছে। বাংলাদেশে ভারতের প্রভাব ও নগ্ন হস্তক্ষেপে সার্বভৌমত্বের উপর আক্রমণে পরিণত হয়েছে।

জুলাই বিপ্লবের পর বাংলাদেশে সাম্প্রতিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতিতে জনমনে মারাত্মক ভীতি ও গভীর উদ্বেগ লক্ষ্য করা যাচ্ছে। রাজনৈতিক সহিংসতা, পরিকল্পিত নৈরাজ্য, সীমান্ত উত্তেজনা, গুপ্ত হামলা, গুজব ও সাইবার অপারেশন সব মিলিয়ে রাষ্ট্রের নিরাপত্তা ব্যবস্থার ভেতরে মারাত্মক অস্থিরতা দৃশ্যমান। এই অস্থিরতার পেছনে কেবল অভ্যন্তরীণ দুর্বলতা নয়, বরং এর সঙ্গে যুক্ত আছে আঞ্চলিক শক্তির গোয়েন্দা কৌশল। বিশেষ করে আলোচনায় বারবার উঠে আসছে ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালাইসিস উইং (RAW) এর নাম। ‘র’ ও তাদের এদেশীয় দোসর মিলে সাম্প্রতিক সময়গুলোতে আইনশৃংখলার ব্যাপক অবনতির পরিল্পনা গ্রহণ ও পর্যায়ক্রমিক বাস্তবায়ন করছে। রাজনৈতিক প্রতিহিংসা ও সহিংস রাজনীতি। প্রশাসনের দুর্বলতা ও দলীয়করণ। বিচারহীনতার সংস্কৃতি। সামাজিক বিভাজন ও অর্থনৈতিক চাপ। সরকার গঠন ও ভাঙনে প্রভাব। রাজনৈতিক দল বা উপদলকে নীরব সমর্থন। সীমান্তে উত্তেজনা সৃষ্টি। অভ্যন্তরীণ বিভাজনকে উসকে দেওয়া ভারতের প্রত্যক্ষ তত্বাবধানে হচ্ছে। এই অভিযোগগুলো ভারত সরকার বরাবরই অস্বীকার করে এসেছে। কিন্তু ভূরাজনীতিতে অস্বীকার মানেই সত্যতার অনুপস্থিতি নয়। এ কথাও অত্যন্ত বিশ্বাসযোগ্য বাস্তবতা। এছাড়াও তথ্যযুদ্ধ (Information Warfare), গুজব ও মনস্তাত্ত্বিক অপারেশন (PsyOps), সাইবার অপারেশন, প্রক্সি অ্যাক্টর ব্যবহার ইত্যাদির জন্য একদল ভারতপ্রেমিক অপপ্রচারকারী খরিদ করা হয়েছে, যারা জুলাই বিপ্লবকে বিতর্কিত করতে এবং দক্ষিণপন্থী তথা বাংলাদেশ পন্থী রাজনীতিকে নানাভাবে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী বা রাজাকারী রাজনীতির ধারক, এমন বয়ান সৃষ্টি করছে। ভারতের অর্থ ও ক্ষেত্রবিশেষে স্বেচ্ছা হানিট্রাপের শিকার হয়ে বাংলাদেশে সাম্প্রতিক সহিংসতার ঘটনাকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার হীণচক্রান্তে লিপ্ত। অনেক ঘটনাতেই দেখা গেছে ভুয়া ভিডিও ও ছবি, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পরিকল্পিত মিথ্যা প্রচারণা, নির্দিষ্ট গোষ্ঠীকে উসকানি, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিরুদ্ধে আস্থা ক্ষুণ্ণ করার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। মোটা দাগে এরা সকলেই ভারতপন্থী তথা আধুনিক বাংলাদেশের নিকৃষ্ট রাজাকার।

ভারত ফ্যাসিস্ট হাসিনা ও তার খুনি বাহিনীকে আশ্রয় দিয়েছে যা, বাংলাদেশের সার্বভৌম মর্যাদার মূলে আঘাত করে। বাংলাদেশের সাথে ভারতের অব্যাহত বেয়াদবি আন্তর্জাতিক আইনকে লংঘন করছে এবং ভারতীয় ভূখণ্ড বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের জন্য একটি প্ল্যাটফর্ম হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে বিভিন্ন সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের সাথে ‘র’ জড়িত। এমনকি বাংলাদেশের শীর্ষ সন্ত্রাসীরা ভারতের আশ্রয়ে নিরাপদে থাকে। জুলাই বিপ্লবের অগ্রসেনানী ইনকিলাব মঞ্চের আহ্বায়ক হাদির ওপর সাম্প্রতিক প্রাণঘাতী হামলাটি কেবল একজন রাজনৈতিক কর্মীর ওপর আঘাত নয়, এটি বাংলাদেশের রাজনীতি, নিরাপত্তা ও সার্বভৌম মর্যাদাকে ঘিরে নতুন করে বহু প্রশ্ন উত্থাপন করেছে। হামলার পরপরই জনমনে যে প্রশ্নটি সবচেয়ে জোরালোভাবে উঠেছে তা হলো: এই হামলার দায় অভ্যন্তরীণ শক্তির দুর্বলতার চেয়েও, ভারত ও এদেশীয় তাদের দোসরদের দায় বেশি। কারণ এখনো পর্যন্ত ধারণা করা হচ্ছে হামলাকারী খুনি ফয়সাল শেখ হাসিনার নির্দেশ পালন করে নিরাপদে ভারতের আশ্রয়ে চলে গেছে। হাদিকে হত্যার মিশন ভারত নিয়েছে কারণ- হাদি ছিলেন স্পষ্টভাবে ভারতীয় আধিপত্যবাদের চরম সমালোচক। আঞ্চলিক প্রভাব ও ভারত ‘মুক্তিযুদ্ধের বন্ধু’ এই ধরনের আরোপিত বয়ান বিরোধী। জনসভা ও বক্তব্যে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের জন্য ভারত শীর্ষস্থানীয় হুমকি- এই ধরনের অকাট্য যুক্তিনির্ভর বক্তব্য দিয়ে জনমত গঠনে সক্ষম ছিলেন হাদি। বিপ্লবী হাদিদের জন্য উত্তর-পূর্ব ভারতের নিরাপত্তা, সীমান্ত ও ট্রানজিট নিয়ন্ত্রণ, আঞ্চলিক প্রভাব বজায় রাখা এবং বাংলাদেশকে শোষণ করার পথে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি হতো।

শুধু হাদি নয়, বাংলাদেশে যারাই দক্ষিণপন্থী জাতীয়তাবাদি রাজনীতির সাথে জড়িত, যারাই সততা ও স্বচ্ছতার রাজনীতির সাথে জড়িত সবাই ভারতের চরম শত্রু। এদেশের ভারত নিয়ন্ত্রিত কিছু মিডিয়া ও ‘র’ কর্তৃক কৃত গোলামেরা হাদি ও হাদির গুরুদের রাজাকার বলতে দ্বিধা করেনি। মহান মুক্তিযুদ্ধের ঘোষক শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান, সেক্টর কমান্ডার মেজর জলিল এমনকি ৩ বারের সফল প্রধানমন্ত্রী শিষ্ট ও স্বচ্ছ রাজনীতিক ম্যাডাম খারেদা জিয়াকেও তারা রাজাকার বলতে দ্বিধা করেন না। অথচ বিবিসি খ্যাত সাংবাদিক সিরাজুর রহমান যিনি প্রবাসে মুক্তিযুদ্ধকালীন বিশ্বজনমত গঠনে ব্যাপক ভূমিকা রাখেন তিনিও লিখেছেন, শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়া হত্যার সাথে ‘র’ সরাসরি জড়িত। অর্থাৎ বাংলাদেশপন্থী রাজনীতি করলেই তাকে রাজাকার বা জঙ্গি ট্যাগ দেওয়া হবে এবং প্রয়োজনে হত্যা করা হবে। এটাই ভারতের চক্রান্ত ও চূড়ান্ত উদ্দেশ্য।


ভারত ও তাদের এদেশীয় দালাল, কিছু গণমাধ্যম এবং জনবিচ্ছিন্ন এক্টিভিস্ট থেকে বাঁচতে হলে বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে জরুরি বিষয় হলো: জাতীয় ঐক্য ও অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনীতি। পেশাদার, দলনিরপেক্ষ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও সত্যিকার বাংলাদেশপন্থী স্বরাষ্ট্র, আইন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও পররাষ্ট্র উপদেষ্টা। সাথে সাথে সাইবার ও তথ্যযুদ্ধে সক্ষমতা বৃদ্ধি। গোয়েন্দা সংস্থার জবাবদিহিতা নিশ্চিত করণ ও সর্বোপরি, আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত সশস্ত্র বাহিনী গঠন করতে হবে। তবেই ভারতের সাথে সম্পর্ক হবে সম্মান ও সমতার ভিত্তিতে। দাসবৃত্তি ও নির্ভরতার নয়।

১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বরে স্বাধীনতা অর্জনের পর থেকেই বাংলাদেশে আইনশৃঙ্খলা অবনতির পেছনে ‘র’-এর ভূমিকা নিয়ে যে অভিযোগ উঠছে, তা পুরোপুরি সত্য। ভারত কর্তৃক এ ধরনের কার্যক্রম বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের উপর চূড়ান্ত আঘাত বলেই ভারতের এদেশীয় গুটিকয়েক দালাল ছাড়া সকলেই মনে করে। স্বাধীনতার পর থেকে নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের ১ নম্বর চিহ্নিত শত্রু হলো ভারত। তবে বাংলাদেশের মানুষের সাথে সত্যিকার বন্ধুত্ব ভারত তখনই করতে পারবে যখন ভারত মৃত্যুদণ্ডাদেশপ্রাপ্ত আসামি হাসিনা, কামাল ও অপারপর গুন্ডাদেরকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠাবে। পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও পারস্পরিক স্বার্থ রক্ষাই দুইরাষ্ট্রের বন্ধুত্বের মাপকাঠি।