অতীতে দেখা গেছে, প্রতিটি বেতন কমিশনের সুপারিশ কার্যকরের পর বাড়ি ভাড়া এবং নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য বেড়েছে। এ বৃদ্ধির কারণে সরকারের অনুমোদিত ১৯ লক্ষাধিক পদের বিপরীতে কর্মরত প্রায় ১৫ লাখ কর্মচারী যত না ক্ষতিগ্রস্ত তার চেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় দেশের সাধারণ মানুষ। দেশের সাধারণ মানুষ এ ক্ষতি থেকে রেহাই পেতে পারে যদি সরকারি কর্মচারীরা দেশের সমৃদ্ধি ও উন্নতির বিষয় এবং সাধারণ মানুষের কল্যাণের বিষয় বিবেচনায় নিয়ে নিজেদের দুর্নীতিমুক্ত রাখেন। নবম বেতন কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়ন হোক এটা সবাই চায়। কিন্তু দেশের সাধারণ মানুষের জন্য এ চাওয়া তখনই সার্থক হবে, যখন আমরা দেখব বর্ধিত বেতন ভাতা দেয়ার পর সরকারি চাকরিজীবীরা সার্বিক বিবেচনায় দুর্নীতিমুক্ত।
সরকারি কর্মচারীদের দ্রব্যমূল্য ও জীবনযাত্রার ব্যয়বৃদ্ধির সাথে সঙ্গতি রেখে আমাদের দেশসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বেতন বৃদ্ধি করা হয়ে থাকে। আমাদের দেশে বেতন বৃদ্ধির ক্ষেত্রে স্থায়ী বেতন কমিশনের অনুপস্থিতিতে দুই ধরনের প্রথা অনুসৃত হয়। এর একটি হলো মূল বেতনের একটি নির্দিষ্ট হারে মহার্ঘ্য ভাতাযুক্ত করে বেতন বৃদ্ধি এবং অপরটি হলো বেতন কমিশন গঠনের মাধ্যমে মূল বেতনসহ ভাতাদি বৃদ্ধি। মহার্ঘ্য ভাতা প্রদানের মাধ্যমে বেতন বৃদ্ধি একটি সাময়িক পদক্ষেপ। অন্যদিকে বেতন কমিশন গঠনের মাধ্যমে যে বেতন ও ভাতাদি বাড়ানো হয় তা সাধারণত ৫-৬ বছর কার্যকর থাকে। পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোতে স্থায়ী বেতন কমিশন থাকায় প্রতি বছর যে হারে মূল্যস্ফীতি হয় তা বিবেচনায় নিয়ে বেতন ও ভাতাদি বাড়ানো হয়ে থাকে।
আমাদের দেশে সরকারি কর্মচারী বলতে প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিযুক্ত সামরিক ও অসামরিক ব্যক্তিদের বুঝায়। আমাদের সংবিধানে প্রজাতন্ত্রের কর্মের যে সংজ্ঞা দেয়া হয়েছে তাতে বলা হয়েছে- ‘প্রজাতন্ত্রের কর্ম’ অর্থ অসামরিক বা সামরিক ক্ষমতায় বাংলাদেশ সরকার সংক্রান্ত যে কোনো কর্ম, চাকরি বা পদ এবং আইনের দ্বারা প্রজাতন্ত্রের কর্ম বলে ঘোষিত হতে পারে এরূপ অন্য কোনো কর্ম।
প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী বা সরকারি কর্মচারী বিষয়ে সহজে বলতে গেলে বলতে হয়, রাষ্ট্রীয় বা সরকারি কোষাগার হতে যারা বেতন ও ভাতাদি গ্রহণ করে থাকেন তারা সবাই প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী বা সরকারি কর্মচারী। সে বিবেচনায় রাষ্ট্রপতি থেকে শুরু করে অফিস সহায়ক (এমএলএসএস) পর্যন্ত সবাই বাংলাদেশ সরকারসংক্রান্ত যে কোনো কর্ম, চাকরি বা পদে নিয়োজিত থাকায় এরা সবাই প্রজাতন্ত্র বা সরকারের কর্মে নিযুক্ত ব্যক্তি। কিন্তু প্রজাতন্ত্রের বা সরকারের কর্মে নিযুক্ত সাংবিধানিক পদধারী ব্যক্তি এবং সরকারি কর্মচারীদের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। সাংবিধানিক পদধারী ব্যক্তি যেমন রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রীসহ মন্ত্রিপরিষদের সদস্যরা, সুপ্রিম কোর্টের বিচারকরা, প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন কমিশনাররা, সরকারি কর্মকমিশনের চেয়ারম্যান ও সদস্য প্রভৃতির বেতন ও ভাতাদি ভিন্ন ভিন্ন আইন দ্বারা নির্ধারিত হয়ে থাকে। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা যায়, সরকারি কর্মচারীদের বেতন ও ভাতাদি বৃদ্ধির অব্যবহিত পর প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিযুক্ত সাংবিধানিক পদধারীদেরও বেতন ও ভাতাদি বাড়ানো হয়ে থাকে।
বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর হতে সরকারি কর্মচারীরা যে হারে বেতন ভাতাদি পেয়ে আসছেন তার সাথে স্বনামধন্য দেশীয় ও বহুজাতিক কোম্পানির কর্মচারীদের বেতন ও ভাতাদির ক্ষেত্রে তারতম্য স্পষ্টত প্রতিভাত। দেশের সুশীলসমাজ ও বিশিষ্টজনদের পক্ষ থেকে বলা হয় সরকারি চাকরিতে বেতন ভাতা আকর্ষণীয় না হওয়ায় মেধাবী ছাত্রছাত্রীরা তাদের শিক্ষাজীবন শেষে সরকারি চাকরিতে যোগ দিতে অনাগ্রহী। তাই সরকারি চাকরিতে মেধাবীদের নিয়োগ দিয়ে দক্ষ ও দুর্নীতিমুক্তভাবে সরকারের কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতে হলে অবশ্যই সরকারি চাকরিতে বেতন ভাতা বৃদ্ধির অন্য কোনো বিকল্প নেই।
একজন সরকারি কর্মচারী যে ক্ষমতা ভোগ করেন বেসরকারি সংস্থায় কর্মরতদের সে তুলনায় ক্ষমতা সীমিত। ক্ষমতার কারণে একজন সরকারি কর্মচারীর পক্ষে দুর্নীতি বা অসদুপায় অবলম্বনের মাধ্যমে যেভাবে নিজের জন্য সম্পদ আহরণ এবং অপরকে সম্পদ আহরণের সুযোগ দেয়া সম্ভব তা বেসরকারি চাকরিজীবীদের ক্ষেত্রে একেবারে সীমিত।
একজন সরকারি কর্মচারীর বেতন ও ভাতাবহির্ভূত তার কর্মসংশ্লিষ্ট যেকোনো ধরনের উপার্জন অবৈধ। এ ধরনের অবৈধ উপার্জন দুর্নীতি বা ঘুষের সমার্থক। দেশে সরকারি কর্মচারীদের মধ্যে ঘুষ ও দুর্নীতির মাত্রা বৃদ্ধির প্রবণতা বিগত দুই যুগ সময়ে যেভাবে বেড়েছে তা নিরসনে এ সময়ের মধ্যে যে বেতন কমিশন গঠনপূর্বক বেতন ও ভাতাদি বৃদ্ধির পদক্ষেপ নেয়া হয়েছিল তা যে ফলপ্রসূ হয়নি এ বিষয়ে দেশের সচেতন নাগরিকদের মধ্যে কোনো সংশয় নেই।
বিশ্বব্যাপী পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের দুর্নীতি নিয়ে যে প্রতিষ্ঠানটি গবেষণা করে থাকে তার নাম ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল (টিআই)। টিআইয়ের বাংলাদেশে শাখা রয়েছে। বাংলাদেশে টিআইয়ের কার্যক্রম যে সংস্থাটি পরিচালনা করে এটিকে বলা হয় ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। টিআইবির জরিপে দেখা যায়, বাংলাদেশ সরকারসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিভাগ যেমন ভূমি প্রশাসন, রাজস্ব প্রশাসন, পুলিশ প্রশাসন, বিচার ব্যবস্থাপনা, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, জনপ্রশাসন প্রভৃতির কোনো না কোনোটি প্রতি বছর শীর্ষ দুর্নীতিগ্রস্ত বিভাগ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান সরকারসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান না হলেও রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের ব্যক্তিরাই সরকার পরিচালনা করে থাকে। তাই রাজনীতিবিদরা দুর্নীতিগ্রস্ত হলে সরকারি কর্মচারীরা দুর্নীতিমুক্ত হবেন; এমনটি ভাবার কোনো অবকাশ নেই। রাজনীতিবিদরা দুর্নীতিগ্রস্ত হওয়ায় সঙ্গত কারণে টিআইবির জরিপে রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান এক বছর শীর্ষ দুর্নীতিগ্রস্ত প্রতিষ্ঠান হিসাবে চিহ্নিত হয়েছিল।
সরকারের একটি বিভাগের কতভাগ কর্মচারী দুর্নীতির সাথে সম্পৃক্ত সেটি নিরূপণের দু’টি পদ্ধতি রয়েছে। এর একটি হলো একটি বিভাগের ১০০ কর্মচারীর মধ্যে ৮৫ জন দুর্নীতির সাথে সম্পৃক্ত হয়ে থাকলে সে বিভাগে দুর্নীতির হার ৮৫ ভাগ। অন্যটি হলো সরকারের একটি বিভাগের সব কর্মচারী সরকারের নিকট প্রতি বছর বেতন ও ভাতাদি বাবদ যে অর্থ পেয়ে থাকে উক্ত বছর ওই বিভাগের কিছু সংখ্যক কর্মচারীর দুর্নীতিলব্ধ আয় যদি সরকার প্রদত্ত বেতন ভাতাদির সমপরিমাণ হয় সেক্ষেত্রে ওই বিভাগে দুর্নীতির হার শতভাগ। এভাবে কিছু সংখ্যক কর্মচারীর দুর্নীতিলব্ধ আয় সরকার প্রদত্ত বেতন ও ভাতাদির দ্বিগুণ বা ঊর্ধ্বমুখী যতগুণ হবে দুর্র্নীতির হারও সেভাবে ততগুণ ঊর্ধ্বমুখী হবে।
সরকারি যেকোনো বিভাগের দুর্নীতির বর্তমান যে চিত্র; তার সাথে দ্বিতীয় পদ্ধতি বিবেচনায় নেয়া হলে আমাদের সরকারি বিভিন্ন বিভাগে দুর্নীতি যে শতভাগ নয় এমন দাবি যে অযৌক্তিক তা বলা যাবে না।
সরকারি কর্মচারীদের বেতন ও ভাতাদি দেশের জনগণের প্রদত্ত করের (ট্যাক্স) টাকা থেকে নির্বাহ করা হয়। একটি দেশের সরকারের রাজস্ব আহরণ যত বেশি হবে ওই দেশের সরকারের পক্ষে সরকারি কর্মচারীদের জন্য সে হারে বেতন ও ভাতাদি আকর্ষণীয় দেয়া সম্ভব। আমরা প্রতি বছর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ করের মাধ্যমে যে পরিমাণ রাজস্ব আহরণ করে থাকি; আমাদের রাজস্ব প্রশাসন শতভাগ দুর্নীতিমুক্ত হলে তা হতে ন্যূনপক্ষে বর্তমানে আহরিত রাজস্বের দ্বিগুণ রাজস্ব আহরণ সম্ভব।
আমাদের বিভিন্ন রাজস্ব প্রশাসনের শীর্ষ আকর্ষণীয় পদসমূহে যারা নিয়োজিত রয়েছেন, সরকার প্রদত্ত বেতন ভাতার সাথে তাদের জীবনযাপন মান বিবেচনায় নিলে দেখা যায়, সরকার থেকে বেতন ভাতা বাবদ তারা মাসিক যে অর্থপ্রাপ্ত হন তাদের মাসিক জীবনযাপন ব্যয় তার চেয়ে কয়েক গুণ বেশি। তাছাড়া নামে বেনামে তাদের যে স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তি রয়েছে, তা কোনোভাবে বৈধ আয়ের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। সরকারের অন্যান্য বিভাগের কর্মচারীদের দুর্নীতির চিত্র এত ব্যাপক না হলেও এর চেয়ে কোনো অংশে কম, বোধ করি এমনটি বলার অবকাশ নেই।
সরকারি কর্মচারীদের জন্য ২১ ডিসেম্বর, ২০১৪ যে বেতন ভাতাদির সুপারিশ করা হয়েছিল তা হলো অষ্টম বেতন কমিশনের সুপারিশ। এর আগে যে সাতটি বেতন কমিশনের মাধ্যমে সরকারি কর্মচারীদের বেতন ভাতা বাড়ানো হয়েছিল তাতে আশা করা হয়েছিল সরকারি কর্মচারীদের দক্ষতা বৃদ্ধি পাবে। সেই সাথে তারা দুর্নীতিমুক্তভাবে জনগণকে প্রকৃত সেবা দেয়ার মানসে কাজ করবেন। কিন্তু অষ্টম বেতন কমিশনসহ ইতঃপূর্বেকার সাতটি বেতন কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়ন পরবর্তী দেখা গেছে, কর্মচারীদের দক্ষতাও বাড়েনি এবং দুর্নীতিও কমেনি। অতীতের অভিজ্ঞতার আলোকে স্বভাবত প্রশ্ন দেখা দিয়েছে নবম বেতন কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়ন করা হলে বাস্তব অর্থে কি সরকারি কর্মচারীদের কর্মদক্ষতা বাড়বে এবং দুর্নীতির হ্রাস ঘটবে? প্রশ্নটির উত্তর খুঁজে পেতে হলে সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগে শীর্ষ পদে ও আকর্ষণীয় পদে কারা কর্মরত রয়েছেন সেদিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করা আবশ্যক।
সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সচিব পদ সরকারি কর্মচারীদের জন্য নির্ধারিত শীর্ষ পদ। অধুনা কিছু জ্যেষ্ঠ সচিবের পদকে সিনিয়র সচিব পদে উন্নীত করা হয়েছে। তা ছাড়া মন্ত্রিপরিষদ সচিব ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মুখ্যসচিব এই দু’জন সচিব সিনিয়র সচিব হলেও পদমর্যাদা ও বেতন ভাতাদির দিক থেকে অপরাপর সিনিয়র সচিবের ঊর্ধ্বে অবস্থান করেন। অতীতে সরকারের সচিব পদে পদায়নে দেখা যেত জ্যেষ্ঠতার তালিকায় শীর্ষে অবস্থানসহ সততা ও দক্ষতা মূল বিবেচ্য ছিল। কিন্তু বিগত দু’দশক ধরে সরকারি কর্মচারীরা যেভাবে দেশের বৃহৎ রাজনৈতিক দলের রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত হয়ে পড়েছেন তাতে তাদের মধ্যে দ্বিধাবিভক্তি সুস্পষ্ট। এ দ্বিধাবিভক্তির কারণে যখন যে দল ক্ষমতাসীন তার বিপরীত দলের মতাদর্শী চাকরিজীবীরা শুধু পদোন্নতি বঞ্চিতই নন, বরং অনেকের ক্ষেত্রে বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার অমর্যাদাকর পদায়ন; আবার অনেকের জুটেছে বাধ্যতামূলক অবসরের খড়গ।
সরকারের শীর্ষ সচিব পদ এবং বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের আকর্ষণীয় পদসমূহে পদায়নে রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা মুখ্য বিবেচ্য হওয়ায় রাজনীতির সাথে একেবারে সম্পৃক্ত নন, নিরপেক্ষ মর্মে খ্যাত কর্মকর্তারা জ্যেষ্ঠতা, সততা, দক্ষতা ও মেধা থাকা সত্ত্বেও কাঙ্ক্ষিত পদোন্নতি বা পদপ্রাপ্তিতে বঞ্চিত হচ্ছেন।
সরকারের এমন একটি বিশেষায়িত মন্ত্রণালয় রয়েছে যেখানে বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে সচিব পদে পদায়নে দু’শতাধিক কর্মকর্তাকে অতিক্রান্ত করা হয়েছিল। ঘটনাটি ঘটেছে নবম সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিজয় পরবর্তী মধ্যবর্তী অবস্থায়। নবম সংসদ নির্বাচনে যে ফল ঘোষণা করা হয়; তাতে দেখা যায় আওয়ামী লীগ এককভাবে তিন-চতুর্থাংশের বেশি আসনপ্রাপ্ত হয়েছে। এর অর্থ দাঁড়ায় প্রদত্ত চারটি ভোটের তিনটি ভোট আওয়ামী লীগপ্রাপ্ত হয়েছে। এখন প্রশ্ন প্রকৃতই আওয়ামী লীগ প্রদত্ত চারটি ভোটের তিনটি প্রাপ্ত হয়ে থাকলে কেন আওয়ামী লীগে জ্যেষ্ঠতা, সততা, দক্ষতা ও মেধা মূল্যায়নের এ দৈন্যতা এবং কেন একটি বিশেষায়িত মন্ত্রণালয়ে সচিব পদে পদায়নে প্রায় দু’শতাধিক কর্মকর্তাকে অতিক্রান্ত করা হয়েছিল।
অষ্টম বেতন কমিশনের সরকারের প্রতি সুপারিশ প্রদান পরবর্তী দেখা যায়, আগের ২০টি গ্রেড কমিয়ে ১৬টি নির্ধারণ করা হয়েছিল; যদিও পরবর্তীতে বেতন কমিশন ২০টি গ্রেড অক্ষুণ্ণ রাখে। এই ১৬টি গ্রেডের মধ্যে দেখা যায়, সর্বনিম্ন ১৬তম গ্রেডে মূল বেতন ৮২০০ টাকা, যা আগে ছিল ৪১০০ টাকা আর সর্বোচ্চ প্রথম গ্রেডে মূল বেতন ৮০,০০০ টাকা, যা আগে ছিল ৪০,০০০ টাকা। উভয় গ্রেডে সুপারিশকৃত বর্ধিত বেতনের হার ১০০ ভাগ। বেতন কমিশনের চেয়ারম্যান যদিও দাবি করেছিলেন সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন বেতনের ব্যবধান প্রায় ১০ গুণ। কিন্তু সিনিয়র সচিব এবং মন্ত্রিপরিষদ সচিব ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মুখ্যসচিব তাদের জন্য সুপারিশকৃত বেতন বিবেচনায় নিলে দেখা যায়, বেতন বৃদ্ধির হার প্রায় ১১ গুণ ও ১২ গুণের বেশি। সরকারের সর্বোচ্চ পদের বেতন এক লাখ টাকা সুপারিশ করার পর বেতন কমিশনের চেয়ারম্যানের পক্ষ থেকে সর্বোচ্চ বেতন ৮০ হাজার টাকা সুপারিশ করা হয়েছে- এমন বক্তব্য জাতিকে বিভ্রান্ত করার শামিল। এ ধরনের বক্তব্য একজন নীতিবান ব্যক্তির কাছে থেকে কখনো প্রত্যাশিত হতে পারে না।
অষ্টম বেতন কমিশনের চেয়ারম্যান সরকারের নিকট তার সুপারিশ হস্তান্তর-পরবর্তী ব্যক্ত করেছিলেন ছয় সদস্যবিশিষ্ট পরিবারের জীবনযাপন ব্যয়ভার বিবেচনায় নিয়ে সর্বনিম্ন ও সর্বোচ্চ বেতন সুপারিশ করা হয়েছে। সেক্ষেত্রে সর্বনিম্ন বেতনপ্রাপ্ত একজন সরকারি কর্মচারীর পরিবারের প্রতি সদস্যের মাসিক ব্যয় ১৩৬৬ টাকা আর সরকারের সর্বোচ্চ বেতনধারীর একজন কর্মচারীর পরিবারের প্রতি সদস্যের মাসিক ব্যয় ১৬৬৬৬ টাকা। সরকারের শীর্ষ পদধারীরা বেতনের বাইরে যেসব আনুষঙ্গিক সুযোগ-সুবিধা প্রাপ্ত হয়ে থাকেন তা বিবেচনায় নেয়া হলে তাদের সাকুল্য বেতন অষ্টম সুপারিশকৃত বেতনের ৩-৫ গুণ হবে। এ অর্থ সরকারের শীর্ষ পদে কর্মরত একজন কর্মচারীর পরিবারের অবশিষ্ট সদস্যসমেত ব্যয় নির্বাহে যথেষ্ট নয় এমন কথা বলা সঙ্গত হবে না। কিন্তু সরকারের সর্বনিম্ন পদে কর্মরত একজন কর্মচারীর ছয় সদস্যবিশিষ্ট পরিবারের জন্য মাসিক মূল বেতন ৮২০০ টাকা আদৌ কি সঙ্গত- বিষয়টি বেতন নির্ধারণের সময় বেতন কমিশনের অবশ্যই ভেবে দেখা উচিত ছিল।
বাংলাদেশ একটি সম্ভাবনাময় দেশ। স্বাধীনতার ৫৪ বছরে বাংলাদেশ যতটুকু অর্জন করেছে তার অনেক বেশি অর্জন সম্ভব ছিল যদি এ দেশে নিরবচ্ছিন্নভাবে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা বজায় থাকত, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বিরাজ করত। সেই সাথে দুর্নীতিমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠা করা যেত। এ তিনটির কোনোটি যে অর্জিত হয়নি এর জন্য রাজনীতিবিদদের পাশাপাশি সরকারের শীর্ষ পদে কর্মরত সামরিক অসামরিক আমলারা কম দায়ী নন। সরকারি কর্মচারীরা সরকারের প্রতিটি বিভাগের কর্মকাণ্ড সুষ্ঠু ও দক্ষভাবে পরিচালনায় মুখ্য ভূমিকা পালন করে থাকেন। সরকারি কর্মচারীদের কাছ থেকে কাক্সিক্ষতমানের সেবা পেতে হলে তাদের জীবনযাপন ব্যয় বিবেচনায় অবশ্যই যুক্তিসঙ্গত বেতন ভাতা প্রদান করতে হবে। তবে এর পূর্বে যা প্রয়োজন তা হলো সরকারের শীর্ষ পদধারীদের কাছ থেকে দুর্নীতিমুক্ত থাকার অঙ্গীকার। আর সরকারের শীর্ষ পদধারীরা দুর্নীতিমুক্ত থাকলে নিম্ন পর্যায়ে যে দুর্নীতি হ্রাস ঘটবে এ বিষয়ে কোনো বিতর্ক নেই।
অতীতে দেখা গেছে, প্রতিটি বেতন কমিশনের সুপারিশ কার্যকরের পর বাড়ি ভাড়া এবং নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য বেড়েছে। এ বৃদ্ধির কারণে সরকারের অনুমোদিত ১৯ লক্ষাধিক পদের বিপরীতে কর্মরত প্রায় ১৫ লাখ কর্মচারী যত না ক্ষতিগ্রস্ত তার চেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় দেশের সাধারণ মানুষ। দেশের সাধারণ মানুষ এ ক্ষতি থেকে রেহাই পেতে পারে যদি সরকারি কর্মচারীরা দেশের সমৃদ্ধি ও উন্নতির বিষয় এবং সাধারণ মানুষের কল্যাণের বিষয় বিবেচনায় নিয়ে নিজেদের দুর্নীতিমুক্ত রাখেন। নবম বেতন কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়ন হোক এটা সবাই চায়। কিন্তু দেশের সাধারণ মানুষের জন্য এ চাওয়া তখনই সার্থক হবে, যখন আমরা দেখব বর্ধিত বেতন ভাতা দেয়ার পর সরকারি চাকরিজীবীরা সার্বিক বিবেচনায় দুর্নীতিমুক্ত।
লেখক : সাবেক জজ, সংবিধান, রাজনীতি ও অর্থনীতি বিশ্লেষক