
শেখ হাসিনার দেড় দশকে হাসিনার ফ্যাসিবাদী শাসনের প্রধান সহযোগী ছিল জাতীয় পার্টি। আওয়ামী লীগের সঙ্গে জাতীয় পার্টির এই বোঝাপড়া নতুন নয়। জেনারেল এরশাদের ক্ষমতা দখল ও রাজনৈতিক দল গঠনের পর থেকে জাতীয় পার্টিকে সমর্থন দিয়ে এসেছে আওয়ামী লীগ। এরশাদ দেশের প্রথম নির্বাচিত সরকারকে উৎখাত করে ক্ষমতা দখল করেছিলেন। এরশাদের সেনাশাসনকে প্রথম যে রাজনৈতিক দলটি সমর্থন দিয়েছিল, সেটি হচ্ছে আওয়ামী লীগ। এরশাদের ক্ষমতা দখলের পর শেখ হাসিনার মন্তব্য ছিল আই অ্যাম নট আনহ্যাপি। অর্থাৎ আমি অখুশি নই। এর মাধ্যমে নির্বাচিত সরকারকে উৎখাত করে সেনাশাসনকে বৈধতা দিয়েছিলেন শেখ হাসিনা। বিনিময়ে শেখ হাসিনা এরশাদের ৯ বছরের স্বৈরশাসনে রাজনৈতিক ও আর্থিক সুবিধা পেয়েছেন। এরশাদ-হাসিনার দীর্ঘ এই সম্পর্ক ছিল মান-অভিমান ও রোমাঞ্চে ভরা। দুটি দলই এ দেশে শাসন করেছে পরস্পরের পরিপূরক হিসেবে। এই সম্পর্ক এখনো বিদ্যমান। কারণ দুজনের রাজনীতির কিবলা একই স্থানে। সেটি হচ্ছে দিল্লি।
এরশাদ ক্ষমতা দখলের পর বিএনপির ওপর নির্যাতনের স্টিম রোলার চালিয়েছেন, অন্যদিকে আওয়ামী লীগকে দিয়েছেন বিশেষ সুবিধা। বিএনপি নেতা মওদুদ আহমদ ছিলেন এরশাদের ভাইস প্রেসিডেন্ট। বাংলাদেশের রাজনীতিতে সশস্ত্র বাহিনীর ভূমিকা এবং জিয়াউর রহমান ও এরশাদের শাসনকাল নিয়ে ‘ডেমোক্রেসি অ্যান্ড দ্য চ্যালেঞ্জ অব ডেভেলপমেন্ট’ নামে একটি বই লিখেছেন। এই বইয়ে হাসিনা ও এরশাদের সম্পর্কের নানা দিক তুলে ধরা হয়েছে। মওদুদ আহমদ তার বইয়ে লিখেছেন, ‘এরশাদ তার শাসনামলে ভারতের প্রতি নমনীয় আচরণ প্রকাশ করলে আওয়ামী লীগ ও এরশাদের মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতা নিয়ে জনমনে সন্দেহ আরো দানা বেঁধে ওঠে। এর ফলে এরশাদ যেমন তার সুনির্দিষ্ট কোনো রাজনীতি না থাকা সত্ত্বেও ক্ষমতায় টিকে থাকতে সক্ষম হন। তেমনি আওয়ামী লীগ বিএনপির মোকাবিলা করে জাতীয় রাজনীতিতে নিজের অবস্থান সংহত করে নিতে সক্ষম হয়।’
এরশাদের পুরো শাসনামলে আওয়ামী লীগ সামরিক স্বৈরশাসককে সমর্থন দিয়ে গেছেন। ৮৬ সালের নির্বাচনের আগে এক জনসভায় শেখ হাসিনা ঘোষণা দিয়েছিলেন, এরশাদের অধীনে যদি কেউ নির্বাচনে অংশ নেন, তারা জাতীয় বেঈমান হিসেবে চিহ্নিত হবেন। এরপর হাসিনা নিজে সেই নির্বাচনে অংশ নেন। এরশাদ ও হাসিনার মধ্যে ব্যক্তিগত পর্যায়ে ছিল নিবিড় যোগাযোগ। মওদুদ আহমদ তার বইয়ে এরশাদ ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় হাসিনার সঙ্গে যোগাযোগের প্রসঙ্গ তুলে লিখেছেন, ‘কমপক্ষে দুবার এরশাদ গোপনে হাসিনার সঙ্গে দেখা করেছেন। একবার তিনি হাসিনাকে লং ড্রাইভে নিয়ে যান এবং তাকে আশ্বস্ত করেন যে, শেখ মুজিবকে সরকারিভাবে জাতির পিতা হিসেবে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করা হবে, মুজিব হত্যাকারীদের বিচারের ব্যবস্থা করা হবে।’
এরশাদ ক্ষমতায় থাকাকালে যেমন শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগ তার পাশে ছিল, তেমনি হাসিনা ক্ষমতা গ্রহণের পর সবসময় এরশাদ তার পাশে ছিলেন। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে ১৯৯৬ সালে। এই নির্বাচনের যে মন্ত্রিসভা গঠিত হয়, তাতে জাতীয় পার্টির নেতা আনোয়ার হোসেন মঞ্জু মন্ত্রী হিসেবে যোগ দেন। ঐকমত্যের সরকারের নামে হাসিনার এই মন্ত্রিসভায় জাসদের আ স ম রব যোগ দিয়েছিলেন। পরে আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর সঙ্গে এরশাদের দ্বন্দ্ব তৈরি হয়। কারণ আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর সঙ্গে শেখ পরিবারের সম্পর্ক ছিল অনেক পুরোনো।
হাসিনার সঙ্গ ত্যাগ করে এরশাদ অল্প সময়ের জন্য জাতীয়তাবাদী শক্তির সঙ্গে জোট করেছিলেন। ভারতের চাপে তিনি সেই সিদ্ধান্তে স্থির থাকতে পারেননি। শেখ হাসিনার শাসনের বিরুদ্ধে বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে চারদলীয় জোট গঠন করা হয়। ১৯৯৯ সালের ৬ জানুয়ারি জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ, জামায়াতের তৎকালীন আমির গোলাম আযম এবং ইসলামী ঐক্যজোটের তৎকালীন চেয়ারম্যান শায়খুল হাদিস আজিজুল হককে সঙ্গে নিয়ে চারদলীয় জোট গঠনের ঘোষণা দেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এরশাদ এই জোটে ছিলেন না। দিল্লির চাপে ২০০১ সালের নির্বাচনের আগে জোট ত্যাগ করেন এরশাদ। তবে নাজিউর রহমান মঞ্জুর নেতৃত্বে জাতীয় পার্টির একটি অংশ চারদলীয় জোটে থেকে যায়। দিল্লির ধারণা ছিল এরশাদকে জোট থেকে সরানো গেলে আওয়ামী লীগ হয়তো আবার ক্ষমতায় আসবে। যদিও ২০০১ সালের নির্বাচনে চারদলীয় জোট ভূমিধস বিজয় পায়। এই নির্বাচনে বিএনপি এককভাবে ১৯৩ আসনে জয়লাভ করে। জামায়াত ১৭ এবং জাতীয় পার্টির আসনসংখ্যা কমে দাঁড়ায় ১৪টি। আগের নির্বাচনে জাতীয় পার্টি ৩২ আসন পেয়েছিল।
এরপর চারদলীয় জোট সরকারের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের ধ্বংসাত্মক আন্দোলনের সহযোগী ছিল জাতীয় পার্টি। ওয়ান-ইলেভেনের সুবিধাভোগী ছিলেন এরশাদ। ২০০৮ সালের নির্বাচনের পর হাসিনার মন্ত্রিসভার সদস্য ছিলেন জাতীয় পার্টির তিন নেতা। তারা হলেন এরশাদের ভাই ও বর্তমান জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদের, আনিসুল ইসলাম মাহমুদ ও রহুল আলম হাওলাদার। মন্ত্রিসভা বহাল রেখে হাসিনা যে তিনটি ভোটারবিহীন ২০১৪, ২০১৮ এবং ২০২৪-এর নির্বাচনে জাতীয় পার্টি অংশ নিয়েছিল। এভাবেই হাসিনার অবৈধ নির্বাচনে বৈধতা দিয়েছে জাতীয় পার্টি।
এরশাদের জাতীয় পার্টি সবসময় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধানের বিরোধিতা করে এসেছে। হাসিনা আদালতের ঘাড়ে বন্দুক রেখে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বিলোপ করলে জাতীয় পার্টি নীরব ভূমিকা পালন করে। হাসিনা প্রতিটি অবৈধ নির্বাচনের পর যে সরকার গঠন করেছে, প্রতিটিতে জাতীয় পার্টির প্রতিনিধিত্ব ছিল। ২০১৪ সালের নির্বাচনে ১৫৩ জন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছিলেন। সেই নির্বাচনের আগে জাতীয় পার্টি দর-কষাকষিতে সরকারের সঙ্গে নানা নাটক করতে থাকে। হাসিনা তার বড় ভাই ও লং ড্রাইভের বন্ধু এরশাদকে ভালো করে চিনতেন। এ সময় ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুজাতা সিং এসে এরশাদকে নির্বাচনে অংশ নিতে নির্দেশ দেন। অবশেষে তাকে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে ভর্তি করে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচনে বিজয়ী ঘোষণা করা হয়। এরশাদের নাকে রশি লাগানোর জন্য হাসিনা তার স্ত্রী রওশনকে ব্যবহার করতেন। এরশাদের মতো এই নারীও প্রবল ক্ষমতালোভী। তাকে বানানো হয়েছিল বিরোধী দলের নেতা। সর্বশেষ ২০২৪ সালের ডামি নির্বাচনে অংশ নিয়েছিল জাতীয় পার্টি। নির্বাচনের আগে দিল্লি সফর করেন জি এম কাদের। তাকে সাংবাদিকরা জিজ্ঞেস করেছিলেন দিল্লিতে নির্বাচন নিয়ে কী আলোচনা হলো? জি এম কাদের সাংবাদিকদের বলেন, ‘ভারত সরকারের আমন্ত্রণে সেখানে গিয়েছি। সেখানে বেশ কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির সঙ্গে আমার খোলামেলা আলাপ-আলোচনা হয়েছে। কার কার সঙ্গে, কী কী বিষয় নিয়ে আলাপ-আলোচনা হয়েছে, তা আমি বিস্তারিত বলতে পারব না। কারণ আলাপগুলো ওভাবেই হয়েছে। যদি ওনারা কিছু প্রকাশ করতে চান, তা তাদের বিষয়। তারা করবেন। আমি ওনাদের অনুমতি ছাড়া এ বিষয়ে কোনো কথা বলতে পারব না।’
জাতীয় পার্টি সবসময় দিল্লির বি টিম হিসেবে কাজ করেছে। দিল্লির নির্দেশনা অনুযায়ী আওয়ামী লীগের স্বার্থে দলটি পরিচালিত হয়েছে। সর্বশেষ ডামি নির্বাচনে হাসিনা জাতীয় পার্টিকে ১১ আসন দিয়েছিলেন। এই সংসদের বিরোধী দলের নেতা ছিলেন জি এম কাদের এবং উপনেতা ছিলেন আনিসুল ইসলাম মাহমুদ। এর মাধ্যমে বিরোধী দলের বর্জন করা আন্তর্জাতিকভাবে অগ্রহণযোগ্য এই নির্বাচনকেও বৈধতা দিতে এগিয়ে এসেছিল জাতীয় পার্টি। বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, দেড় দশকের ফ্যাসিবাদী শাসনের প্রধান বৈধতা উৎপাদনকারী দলটি দেশের রাজনীতিতে বহাল তবিয়তে আছে। ৫ আগস্ট হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পর সেনাভবনে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সেনাপ্রধানের যে বৈঠক হয়েছিল, সেখানে জি এম কাদের ও আনিসুল ইসলাম মাহমুদ উপস্থিত ছিলেন। এরপর তারা অন্যান্য দলের নেতাদের সঙ্গে বঙ্গভবনের অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলেন। বঙ্গভবনে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনার সময় জি এম কাদের সেনাশাসন দেওয়ার দাবি করেছিলেন। কিন্তু অন্য রাজনৈতিক দলের নেতাদের তীব্র আপত্তির মুখে তিনি তার বক্তব্য প্রত্যাহার করে নেন।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে হাসিনার পতনের পর ফ্যাসিস্ট সরকারের মন্ত্রীদের স্থান হয়েছে কারাগারে। বাকিরা পালিয়ে গেছে। কিন্তু হাসিনার মন্ত্রিসভার সদস্য জি এম কাদের-আনিসুল ইসলাম মাহমুদরা রাজনীতির মাঠ কাঁপানোর চেষ্টা করে যাচ্ছেন। ফ্যাসিবাদের দোসর জি এম কাদের এখন ড. ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত সরকারকে ফ্যাসিস্ট বলে আখ্যায়িত করেছেন। মে দিবস উপলক্ষে এক আলোচনা সভায় অন্তর্বর্তী সরকারপ্রধান ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকারকে ক্ষমতায় চান না বলে জানান জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদের। এমনকি সংস্কার চান না বলেও জানান তিনি। এ সময় অন্তর্বর্তী সরকারকে নব্য ফ্যাসিবাদ বলে আখ্যা দেন জি এম কাদের। শ্রমিক সমাবেশে জি এম কাদের ড. ইউনূস এবং অভ্যুত্থানের নেতাদের কটাক্ষ করে বলেন, আমরা চাই সরকারপ্রধান ও তার নিয়োগকর্তারা ক্ষমতা ছেড়ে রাজনীতিতে আসুক। জনগণ যদি তাদের গ্রহণ করে, আমরা গ্রহণ করব। আবার বলছি, এই মুহূর্তে অবাস্তব সংস্কার চাই না। নির্বাচিত সরকার ছাড়া কেউই সংস্কার করতে পারবে না। (সমকাল : ২ মে ২০২৫)
এরশাদের ক্ষমতা গ্রহণ থেকে এখন পর্যন্ত জাতীয় পার্টি পরিচালিত হচ্ছে দিল্লির ইচ্ছায়। যার প্রধান লক্ষ্য আওয়ামী লীগের রাজনীতির পরিপূরক হিসেবে কাজ করা। আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক কার্যক্রম যে কারণে নিষিদ্ধ, ঠিক একই কারণে জাতীয় পার্টির রাজনীতি নিষিদ্ধ হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু তা তো হয়নি; বরং দিল্লির সুতার টানে জাতীয় পার্টির নেতারা আস্ফালন করছেন। জাতীয় পার্টির সরব হওয়ার চেষ্টা প্রমাণ করে দিল্লি আবার দেশের রাজনীতিতে দাবার ঘুঁটি সাজাচ্ছে।
লেখক : সহযোগী সম্পাদক, আমার দেশ