Image description

চট্টগ্রামের সরকারি-বেসরকারি ৯টি ব্যাংক থেকে প্রায় সাড়ে ৭ হাজার কোটি টাকা লুটের ঘটনা ঘটেছে। ভুয়া প্রতিষ্ঠান, নামধারী ব্যক্তি এবং অদৃশ্য ব্যবসায়িক লেনদেন দেখিয়ে বছরের পর বছর ধরে গড়ে ওঠা জালিয়াতি চক্র ঋণ অনুমোদন করিয়ে এই অর্থ আত্মসাৎ করে। ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ অসাধু কর্মকর্তাদের সহযোগিতায় এসব অর্থ লুট করেছে বড় বড় ব্যবসায়ী গ্রুপ ও আওয়ামী লীগের সাবেক মন্ত্রীরা।

চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) চট্টগ্রাম জেলা কার্যালয়-১-এ দায়ের করা মামলার পরিসংখ্যান বিশ্লেষণে দেখা যায়, মোট ৪৩টি মামলার মধ্যে ১৯টি ব্যাংক অর্থ আত্মসাৎ সংক্রান্ত। এই ১৯ মামলায় অভিযোগের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৭ হাজার ৬১৮ কোটি ৬০ লাখ ৭০ হাজার ৩৫৫ টাকা। এসব মামলায় ৪২৬ জনকে আসামি করা হয়েছে। অর্থাৎ মোট দায়েরকৃত মামলার প্রায় ৪৪ শতাংশই ব্যাংক লুটের।

আত্মসাতের অভিযোগ থাকা ব্যাংকগুলো হলোÑ ইসলামী ব্যাংক, ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক, প্রাইম ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক, পূবালী ব্যাংক, জনতা ব্যাংক, ডাচ্-বাংলা ব্যাংক, অগ্রণী ব্যাংক এবং ফাস্ট সিকিউরিটি ব্যাংক। অবশিষ্ট ২৪টি মামলা ছিল বিভিন্ন আর্থিক অপরাধের। এর মধ্যে ১০টি মামলায় অবৈধ সম্পদ অর্জন, পাঁচটি জাল কাগজ তৈরি ও সরকারি অর্থক্ষতি, ছয়টি প্রাতিষ্ঠানিক অর্থ আত্মসাৎ এবং তিনটি ঘুষ গ্রহণ-সংক্রান্ত। অর্থাৎ, ব্যাংক লুটের ঘটনা চট্টগ্রামের আর্থিক দুর্নীতির প্রায় অর্ধেক ভাগ দখল করেছে।

শুধু জনতা ব্যাংক, ইসলামী ব্যাংক ও ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকের ৫ হাজার ৪৯২ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে ১৯টি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় এস আলম গ্রুপের সাইফুল আলম মাসুদ ও তাঁর পরিবার, সাবেক মন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ ও তাঁর পরিবার, সাদ মুছা গ্রুপের মো. মহসিন ও তাঁর পরিবার এবং নূরজাহান গ্রুপের জহির আহম্মেদ রতন ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের আসামি করা হয়েছে। এ ছাড়া ২৪২ জন ব্যাংকের সাবেক কর্মকর্তার মধ্যে সাবেক চেয়ারম্যান, পরিচালক, উপমহাব্যবস্থাপক, ব্যবস্থাপক থেকে ক্যাশ অফিসার পর্যন্ত মামলার আওতায় এসেছে। একই সঙ্গে ৯ জন সাবেক মন্ত্রী, সংসদ সদস্য, পৌরসভার মেয়র ও রাজনৈতিক নেতাকেও অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে আসামি করা হয়েছে।

দুদক কর্মকর্তারা বলেছেন, ম্যাজিক ঋণের মাধ্যমে এত দ্রুত টাকা হস্তান্তর সম্ভব হয়েছে ব্যাংক কর্মকর্তাদের সরাসরি সহযোগিতার কারণে। ব্যাংকিং সেক্টরে স্বচ্ছতা ও কঠোর অডিট ব্যবস্থার অভাবে এ ধরনের জালিয়াতি বেড়ে চলেছে। সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, এত বিপুল অর্থ লুট দেশের ব্যাংকিং খাতের দুর্বলতা এবং প্রাতিষ্ঠানিক শৃঙ্খলার অভাবকে স্পষ্ট করেছে। লুটের ঘটনায় জড়িত সবাইকে আইনের আওতায় আনার দাবি অর্থনীতিবিদদের।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার ও অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. সাইফুল ইসলাম আমাদের সময়কে বলেন, ব্যাংক খাতে যে ধরনের জালিয়াতি এখন প্রকাশ্যে আসছে, তা কোনো একক ঘটনার ফল নয়। এটি বহু বছরের কাঠামোগত দুর্বলতা এবং তদারকির অভাবের প্রতিফলন। তারল্য সংকট থেকে শুরু করে গ্রাহকের আমানতের নিরাপত্তাÑ সবকিছুই এতে ঝুঁকির মুখে পড়ে। তাই জরুরি ভিত্তিতে ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা শক্তিশালী করতে হবে। পাশাপাশি ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ প্রক্রিয়াকে আরও স্বচ্ছ করা ছাড়া বিকল্প নেই।

ড. সাইফুল ইসলাম আরও বলেন, বিপুল অর্থ লুটপাটের কারণে দেশে মুদ্রাস্ফীতি বেড়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক যে পরিমাণ অর্থ উৎপাদন করে, তার সমান হারে দ্রব্য ও সেবা উৎপাদন হওয়া উচিত। কিন্তু লুট হয়ে যাওয়া বিপুল অর্থের কোনো হিসাব থাকে না। ফলে বাজারে টাকার প্রবাহ বাড়ে, কিন্তু তার বিপরীতে উৎপাদন বাড়ে নাÑ এ কারণেই মুদ্রাস্ফীতি কমছে না।

ড. সাইফুল ইসলামের মতে, এই জালিয়াতি বিনিয়োগ খাতেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। যারা লুটপাট করেছে, তারাই সহজে ঋণ পেয়েছে। অথচ যাদের সত্যিকার অর্থে ঋণ দরকার ছিল, তারা তা পায়নি। এতে অনেক প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে। নতুন বাজার তৈরি হয়নি। বেকারত্ব বেড়েছে। তাই লুটের অর্থ ফেরত আনতে সরকারকে কাজ করতে হবে। পাশাপাশি এসব ঘটনায় যারা জড়িত, তাদেরকে শাস্তির আওতায় আনতে হবে।