Image description

দেশের সবচেয়ে বেশি পেঁয়াজ উৎপাদন হয় পাবনার সাঁথিয়া ও সুজানগরে। চলতি মৌসুমে সাঁথিয়ার কৃষক সুমিত মন্ডল পাইকারি বাজারে প্রতি কেজি নতুন মুড়িকাটা পেঁয়াজ বিক্রি করে পেয়েছেন প্রায় ৬০ টাকা। এক হাত ঘুরেই একই পেঁয়াজ ৭৫-৮০ টাকা বিক্রি করছেন পাইকারি ব্যবসায়ীরা। তাদের কাছ থেকে খুচরা বিক্রেতারা কিনে নিয়ে বিক্রি করছেন ৯০-১০০ টাকা। সেই পেঁয়াজ রাজধানীতে গিয়ে হয়ে যাচ্ছে ১২০ টাকা।

সোমবার (০৮ ডিসেম্বর) সাঁথিয়া ও সুজানগর উপজেলার বৃহৎ পেঁয়াজের বাজার করমজা চতুরহাটে গিয়ে এমন চিত্র দেখা যায়। মৌসুমের শুরুতে চড়া দামে বিক্রি হচ্ছে পেঁয়াজ। কৃষকের কাছ থেকে ৬০ টাকায় কিনে দ্বিগুণ দামে বিক্রি করছেন ব্যবসায়ীরা। এতে কৃষকদের লাভ কম থাকলেও বেশি মুনাফা হাতিয়ে নিচ্ছেন মধ্যস্বত্বভোগী ব্যবসায়ীরা। হাত ঘুরলেই বাড়ছে দাম। এতে ঠকছেন সাধারণ ক্রেতারা।

নতুন পেঁয়াজের কেজি ৯০-১০০

স্থানীয় ক্রেতা ও কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দুই সপ্তাহ আগে থেকে স্থানীয় বাজারে মুড়িকাটা পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে। শুরুতে দাম বেশি ছিল। এখন কমতির দিকে। আমদানির খবরে গত দুই দিনে দাম কমেছে কেজিতে অন্তত ২০ টাকা। গত সপ্তাহে ১০০-১১০ টাকায় বিক্রি হওয়া মুড়িকাটা এখন ৯০-১০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। পাশাপাশি দেশি পুরোনো পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ১৪০ টাকা কেজি দরে।

কৃষক, পাইকারি ব্যবসায়ী ও খুচরা বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মুড়িকাটা পেঁয়াজ সাধারণত ডিসেম্বরের শুরু থেকে জানুয়ারির আগ পর্যন্ত তোলা হয় এবং বাজারে আসে। এটি অক্টোবরের প্রথম দিকে রোপণ করা হয়। ৪৫ থেকে ৬০ দিনের মধ্যে ফসল তোলার উপযোগী হয়। এবার আবহাওয়া অনুকূলে এবং বাজারে দাম বেশি থাকায় নভেম্বরের শেষ সপ্তাহ থেকেই বাজারে আসতে শুরু করে। আগামী দুই সপ্তাহ থাকবে এর মৌসুম। এবার শুরুতেই দাম বেশি ছিল। কিন্তু গত দুই দিনে আমদানির খবরে দাম কমে গেছে। ইতিমধ্যে চারা কাটা পেঁয়াজ রোপণ শুরু হয়েছে। আগামী এক থেকে দেড় মাস অর্থাৎ চারা কাটা তোলা শুরু না হওয়া পর্যন্ত বাজার কিছুটা ঊর্ধ্বমুখী থাকবে। চারা কাটা জানুয়ারির শেষ দিকে থেকে শুরু হয়ে ফেব্রুয়ারিতে পুরোদমে বাজারে আসবে। তখন বাজার স্বাভাবিক হয়ে যাবে। মূলত চারা কাটা পেঁয়াজই দেশের মানুষের চাহিদা মেটায় এবং সারা বছর সংরক্ষণ করা যায়।

 

pabnaমৌসুমের শুরুতে চড়া দামে বিক্রি হচ্ছে নতুন পেঁয়াজ

পাইকারিতে ৫৮-৬০ টাকা কেজি

সাঁথিয়া ও সুজানগর উপজেলার বৃহৎ পেঁয়াজের বাজার করমজা চতুরহাট। এই হাটের পেঁয়াজের অন্যতম আড়তদার মিনজার আলী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘দুই সপ্তাহ ধরে মুড়িকাটা পেঁয়াজ বাজারে আসছে। তবে এখন সরবরাহ কম। গত সপ্তাহে মুড়িকাটার মণ তিন হাজার ৮০০ থেকে চার হাজার টাকা ছিল। চলতি সপ্তাহের শুরুতে দাম কমে দুই হাজার ৫০০ থেকে তিন হাজারে নেমে যায়। ইতিমধ্যে আমদানির খবরে রবিবার ও সোমবার দুই হাজার থেকে দুই হাজার ৪০০ টাকায় নেমেছে মণ। সরবরাহ সংকটের কারণে গত সপ্তাহে দাম বেড়ে গিয়েছিল। এখন কমেছে। বর্তমানে পাইকারিতে ৫৮-৬০ টাকা কেজি দরে কৃষকরা বিক্রি করলেও উৎপাদন খরচের তুলনায় লাভ আছে। আমরা ১০ টাকা লাভে খুচরা বাজারে বিক্রি করে দিচ্ছি।’

পুরোনো পেঁয়াজ ১৪০ টাকা

পাবনার শরৎনগর বাজারের খুচরা বিক্রেতা মুকুল হোসেন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‌‘গত সপ্তাহে মুড়িকাটা পেঁয়াজ পাইকারি আড়ত থেকে ৭৫-৮০ টাকা কেজি দরে কিনে ১০০-১১০ টাকায় বিক্রি করেছি। পুরোনো পেঁয়াজ বিক্রি করেছি ১৫০ টাকা। সোমবার মুড়িকাটা ৯৫ টাকায় বিক্রি করছি। আর দেশি পুরোনো পেঁয়াজ বিক্রি করছি ১৪০ টাকায়। তবে আমদানি শুরু হওয়ায় দাম আরও কমবে বলে আশা করছি।’

তার দোকানে থাকা খুচরা ক্রেতা মানিক হোসেন বলেন, ‘দাম বেড়ে যাওয়ায় অল্প পরিমাণ কিনছি। দাম বেড়ে গেলে কম করে খাই আর কমে গেলে একটু বেশি খাই। আর নাগালের বাইরে গেলে খাওয়া বন্ধ করে দেবো।’

ভালো দাম পেয়ে কৃষকদের মুখে হাসি, আমদানিতে অসন্তোষ 

দেশে মোট উৎপাদিত পেঁয়াজের বড় অংশ আসে সাঁথিয়া ও সুজানগর থেকে। দুই উপজেলা ছাড়াও বেড়া, ভাঙ্গুড়া, চাটমোহর, ফরিদপুর, ঈশ্বরদী ও আটঘরিয়াতে উৎপাদন হয়। সাধারণত নভেম্বরের শেষ থেকে ডিসেম্বরের মাঝামাঝি পর্যন্ত মুড়িকাটা তোলা হয়। একই সময়ে চারা কাটার রোপণ শুরু হয়। বিগত কয়েক বছর মুড়িকাটা পেঁয়াজে কৃষকরা লাভ পাননি। চলতি মৌসুমের প্রথম দিকে ভালো দাম পেয়ে কৃষকদের মুখে হাসি ফুটেছে। পরে আমদানি শুরু হলে দাম কমে যাওয়ায় কিছুটা অসন্তোষ তারা।

এমনটি জানিয়েছেন করমজা চতুরহাটে নতুন পেঁয়াজ বিক্রি করতে আসা সাঁথিয়ার সুমিত মন্ডল। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘গত কয়েক বছর লাভ না হওয়ায় পেঁয়াজ আবাদ ছেড়ে দেওয়ার কথা ভেবেছিলাম। এবার আট বিঘায় লাগিয়েছি। শুরুতেই ভালো দাম পেয়েছি। গত কয়েক বছরের হাড়ভাঙা খাটুনির টাকা উঠে গেছে। তবে এখন যারা তুলছেন তাদের লাভ কম হবে। কারণ আমদানি শুরু হওয়ায় দাম কমেছে।’

সুজানগরে উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ৩ লাখ ৫০ হাজার টন

সুজানগর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. আসাদুজ্জামান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘চলতি মৌসুমে সুজানগরে পেঁয়াজ আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ১৯ হাজার ৩২০ হেক্টর জমি। এখান থেকে উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা তিন লাখ ৫০ হাজার মেট্রিক টন। ইতিমধ্যে মুড়িকাটা বাজারে উঠেছে। বর্তমানে মুড়িকাটার মণ দুই হাজার থেকে দুই হাজার ৪০০ টাকা। যা পাঁচ দিন আগেও ছিল তিন হাজার থেকে তিন হাজার ৫০০ টাকা। গত সপ্তাহে ছিল চার হাজার টাকা পর্যন্ত। উৎপাদন খরচ কেজিতে ৩১ টাকা হিসেবে এই দামে লাভে আছেন কৃষকরা।’ 

pabna-3ইতিমধ্যে চারা কাটা পেঁয়াজ রোপণ শুরু হয়েছে পাবনায়

একইসঙ্গে চারা কাটা পেঁয়াজ রোপণ শুরু হয়েছে এবং লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হবে বলে আশা প্রকাশ করেন কৃষি কর্মকর্তা মো. আসাদুজ্জামান। তিনি বলেন, ‘আমি প্রান্তিক পর্যায়ের কৃষকদের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখছি। এতে কৃষকদের যেকোনো সহযোগিতা দেওয়া সহজ হয়। বর্তমানে চারা কাটা রোপণের বিষয়টি দেখভালের জন্য মাঠে থাকার চেষ্টা করি। কোনও কৃষকের সহযোগিতা লাগলে তাও করছি।’

সাঁথিয়ায় উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ২৫ হাজার ৫৬৬ মেট্রিক টন

সাঁথিয়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. মাহমুদুল হাসান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘উপজেলায় চলতি মৌসুমে আবাদের লক্ষ্যমাত্রা এক হাজার ৬১০ হেক্টর জমি। এখান থেকে উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ২৫ হাজার ৫৬৬ মেট্রিক টন। আশা করছি, লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হবে। প্রতি হেক্টরে খরচ দুই লাখ ৯০ হাজার টাকা। সে হিসাবে মণপ্রতি খরচ ৭৩০ টাকা। বাজারে বর্তমানে নতুন পেঁয়াজের মণ দুই হাজার ৪০০-৫০০ টাকা। এতে কৃষকরা লাভে আছেন। চারা কাটার রোপণ শুরু হয়ে গেছে। আশা করছি এটিতেও লাভবান হবেন কৃষকরা।’

জেলায় উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা আট লাখ ৫০ হাজার টন

পাবনা জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপপরিচালক কৃষিবিদ মো. জাহাঙ্গীর আলম প্রামানিক বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘জেলায় চলতি মৌসুমে ৫৩ হাজার ৬০৫ হেক্টর জমিতে পেঁয়াজ আবাদ হবে। তা থেকে উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা আট লাখ ৫০ হাজার মেট্রিক টন। গড় উৎপাদন খরচ কেজিতে ৪২ টাকা। মুড়িকাটার লক্ষ্যমাত্রা ইতোমধ্যে পূরণ হয়েছে। লাভও করেছেন কৃষকরা। চারা কাটাতেও লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হবে এবং কৃষকরা লাভবান হবেন বলে আশা করছি আমরা।’