Image description

দেশের আর্থিক খাত নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ব্যাংক আবারো অর্থ পাচারে দায়ী কর্মকর্তাদের নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে। সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকার পরও এই কর্মকর্তাদেরকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গুরুত্বপূর্ণ পদে বসানো হয়েছে। গেল ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর বাংলাদেশ ব্যাংকের কিছু গুরত্বপূর্ণ পদে পরিবর্তন হলেও ফের সেইসব পদে বসানো হয়েছে অর্থ পাচার ও রিজার্ভ চুরির সহায়তাকারীদের সহযোগীদের। এতে প্রতিষ্ঠানটি আবারো অর্থপাচারকারীদের নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।


পতিত স্বৈরাচার আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলে গেল ১৬ বছরে শত শত কোটি টাকা পাচার করা হয়েছে। লুট করা হয়েছে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভও। আর এই লুটপাটে প্রত্যেক্ষ ও পরোক্ষভাবে সহায়তা করেছিলেন খোদ বাংলাদেশ ব্যাংকেরই কর্মকর্তারা। তাদের কাছে জিম্মি ছিল দেশের ব্যাংক পাড়া। ব্যাংক খাত লুটের সাথে আওয়ামী লীগ সরকারের বিভিন্ন প্রভাবশালী ব্যক্তি এবং কিছু ব্যবসায়ী গ্রুপ জড়িত থাকলেও এদের সহায়তায় মাস্টারমাইন্ড হিসেবে কাজ করছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বেশ কিছু কর্মকর্তা। তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন- বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)-এর সদ্য সাবেক প্রধান মাসুদ বিশ্বাস। বিএফআইইউর প্রধান পদে থাকাকালেই ৫ আগস্টের পরে তিনি পালিয়ে যান, অর্থ পাচারের দায়ে গ্রেফতারের আশংকায়। জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগে গত ২ জানুয়ারি মাসুদ বিশ্বাসের বিরুদ্ধে মামলা করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। তবে অর্থ পাচারের অভিযোগগুলো নিয়ে তার বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত কোনই ব্যবস্থা নেয়নি সরকার।


মামলার এজাহার সূত্রে জানা যায়, মাসুদ বিশ্বাস তার নিজ নামে ১ কোটি ৮৭ লাখ ৭২ হাজার ৬২২ টাকার জ্ঞাত আয় বহির্ভূত অবৈধ সম্পদ অর্জন করে তা নিজে ভোগ দখলে রেখে শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেছেন। এজন্য তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশন আইন, ২০০৪ এর ২৭(১) ধারা ও দুর্নীতি প্রতিরোধ আইন, ১৯৪৭ এর ৫(২) ধারায় মামলা রুজু করা হয়। এছাড়া স্ত্রী এবং সন্তানদের নামেও গড়েছেন বিপুল সম্পত্তি।


আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর মাসুদ বিশ্বাস কিছুটা আইনের আওতায় আসলেও তার সহযোগীরা রয়েছেন এখনো কেন্দ্রীয় ব্যাংকে বহাল তবিয়তে। এছাড়া বিভিন্ন সময়ে অনিয়মের দায়ে শাস্তিমূলক বদলি হওয়া কর্মকর্তারাও বিভিন্ন কৌশলে ফিরতে চাইছেন প্রধান কার্যালয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদে। খাত সংশ্লিষ্টদের মতে, অর্থ পাচারে অভিযুক্তদের দোসররা বহাল তবিয়তে থাকলে, পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনার স্বপ্ন থেকেই যাবে।


মাসুদ বিশ্বাসের অত্যন্ত বিশ্বস্ত এবং আস্থাভাজন হিসেবে পরিচিত এ এফ এম শাহীনুল ইসলামকে বানানো হয়েছে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) এর প্রধান। শাহীন আওয়ামী সরকারের আমলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক ছিলেন। এ দায়িত্ব পাওয়ার পরই নানা অপ-কৌশল শুরু করেন তিনি। অভিযুক্তদের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে বসানোর জন্য মরিয়া হয়ে উঠেন এবং অর্থপাচারের অভিযোগ যারা তদন্ত করছিলেন সেইসব কর্মকর্তাকে শাস্তিমূলক বদলি করেন।


শহীদুল ইসলাম ছাড়াও আওয়ামী লীগ আমলে দুর্নীতি ও অর্থপাচারের দায়ে অভিযুক্তদের মধ্যে কূট-কৌশল চালনার তালিকায় যারা রয়েছেন এদের  অন্যতম হলেন- বাংলাদেশ ব্যাংকের ফরেন এক্সচেঞ্জ অপারেশন ডিপার্টমেন্ট এর ডিরেক্টর কামাল হোসেন, নির্বাহী পরিচালক কাজী রফিকুল হাসান, নির্বাহী পরিচালক মেজবাউল হক ও ডেপুটি গভর্নর জাকির হোসেন চৌধুরীসহ আরও অনেকে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের ফরেন এক্সচেঞ্জ অপারেশন ডিপার্টমেন্ট এর ডিরেক্টর কামাল হোসেন বিএফআইইউ এর সাবেক প্রধান মাসুদ বিশ্বাসের অত্যন্ত আস্থাভাজন এবং একান্ত সহযোগী হিসেবে পরিচিত। এই কর্মকর্তা আওয়ামী সরকার ক্ষমতার আসার পরপরই ২০০৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে বিএফআইইউ-তে পদায়ন পেয়েছেন এবং একটানা ১৫ বছর একই পদে কর্মরত ছিলেন। সরকারের উচ্চ পর্যায়ের বিভিন্ন ব্যক্তিদের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করে সরকারের আস্থাভাজন এবং প্রবল ক্ষমতার অধিকারী হয়ে উঠেছিলেন তিনি।

এছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির ঘটনায় তদন্ত শুরু হলে এই কর্মকর্তা তৎকালীন গভর্নরকে বিভ্রান্ত করে অর্থ উদ্ধার জটিল করে দিয়েছেন। দেশের আর্থিক খাত লুটের হোতা এস আলমের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ ছিলেন এই কর্মকর্তা। তিনি চার্টার্ড বিমানে করে এস আলমের ছেলের বিয়েতে যোগদান করেন।

এদিকে লবিংয়ে ব্যস্ত বেক্সিমকো গ্রুপ ও এস আলম গ্রুপের ‘একনিষ্ঠ শুভাকাক্সিক্ষ’ বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক কাজী রফিকুল হাসান। তিনি বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) এর নির্বাহী পরিচালক পদ বাগিয়ে নিতে মরিয়া। রফিকুল হাসান বাংলাদেশ ব্যাংকের চট্টগ্রাম অফিসে দায়িত্ব পালনকালে এস আলম গ্রুপকে বিশেষ সুবিধা দিয়ে ‘আস্থাভাজন’ হয়েছেন। এছাড়া বিএফআইইউ এর সাবেক প্রধান মাসুদ বিশ্বাস এর একান্ত সহযোগী তিনি।  সম্প্রতি তার অবৈধ সম্পত্তি অর্জনের বিষয়টিও সামনে এসেছে।

গেল ৫ আগস্ট হাসিনা সরকার পতনের পরও নিয়ম বহির্ভূতভাবে একাধিক পদের প্রধান ছিলেন রিজার্ভ চুরির মামলার আসামি মেজবাউল হক। পরবর্তীতে এসব বিষয় নিয়ে সমালোচনা বাড়তে থাকলে তাকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের  রাজশাহী শাখায় বদলি করা হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তাদের দুর্নীতি এবং অনিয়মের ব্যাপারে সম্প্রতি দুদকের দেয়া প্রতিবেদনে দেখা যায়, মোবাইল ব্যাংকিং সিস্টেম নগদের সব অনিয়ম ও মানি লন্ডারিংয়ের হোতা এই কর্মকর্তা। সীমাহীন অনিয়মে জড়িয়ে অগাধ সম্পদের মালিক বনে গিয়েছেন। ক্ষমতাচ্যুত ও পতিত আওয়ামী সরকারের সাবেক প্রধানমন্ত্রীর পুত্র জয় ও আইসিটি মন্ত্রী জুনায়েদ আহমেদ পলকের স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট প্রজেক্ট ‘বিনিময়’, ‘আইডিটিপি’ ও অন্যান্য কয়েকটি প্রজেক্ট নিয়েছেন, যা কোনো কাজেই আসেনি।

তবে এসব প্রজেক্ট থেকে এই কর্মকর্তা বিপুল অর্থ আত্মসাৎ করেছেন এবং প্রকল্পের সুবিধাভোগীদের কাছ থেকে একাধিক বিদেশ সফর পুরস্কার পেয়েছেন। এফএসএসএসপিডির পরিচালক থাকা অবস্থায় বিভিন্ন শিল্প গ্রুপের অনুকূলে বৈদেশিক মুদ্রায় ঋণ ছাড়করণের মাধ্যমে বিপুল পরিমাণে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ করা হয়েছে দুদকের প্রতিবেদনে। এই কর্মকর্তা একাধিক মন্ত্রী ও একাধিক শিল্প গ্রুপের হয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকে কাজ করতেন। শুধু তাই নয়, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ হ্যাকিংয়ের তথ্য নষ্টে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন বলেও অভিযোগ আছে।

এতসব অভিযোগের পরেও মেজবাউল হককে বহাল তবিয়তে রাখতে জোরালো ভূমিকা পালন করেছেন বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) এর প্রধান এ এফ এম শাহীনুল ইসলাম এবং ডেপুটি গভর্নর জাকির হোসাইন চৌধুরী ।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক এই মুখপাত্র নিজেকে এস আলমের ভাগনে জামাই হিসেবেও পরিচয় দিতেন। এবং এই পরিচয়ে দাপিয়ে বেড়াতেন ব্যাংক পাড়ায়। দুদকের প্রতিবেদন প্রকাশের পর মেসবাউল হকের পাসপোর্টও জব্দ করে বাংলাদেশ সরকার। 

শীর্ষনিউজ