Image description

আবদুল লতিফ মাসুম

গত কয়েক সপ্তাহের ঘটনাবলি বিশ্লেষণ করলে নির্বাচনি সংকটের চালচিত্র বোঝা যায়। অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদ, সংস্কার কার্যক্রম ও বিচারিক তাগিদে ঘোরপাক খেয়েছে নির্বাচনের তায়-তারিখ। প্রথমদিকে অন্তর্বর্তী সরকারপ্রধানের উচ্চারিত ও অনুচ্চারিত কথায় বোঝা যাচ্ছিল মেয়াদটি দীর্ঘ হওয়া উচিত। এর মানে এই নয় যে, তিনি ক্ষমতাকে দীর্ঘায়িত করতে চাচ্ছেন। তিনি রাজনীতিবিদ নন। ক্ষমতার প্রতি তার লোভ, মোহ কখনোই প্রকাশিত হয়নি। আমাদের বিশ্বাস দীর্ঘ সময়ে যে আবর্জনা ও জঞ্জাল এ জাতির ভবিষ্যৎকে ম্লান করেছে, তা তিনি একটি সংস্কার কার্যক্রমের মাধ্যমে দূরীভূত করতে চান। এটি একটি পিতৃসুলভ মমত্ব ও রাষ্ট্রিক অভিভাবকত্বের কথা হতে পারে। কিন্তু আমাদের সমাজের বৈশিষ্ট্যই হচ্ছে সবকিছুর মধ্যে নেতিবাচক কিছু আবিষ্কার করা। বঙ্কিমের সেই চিরাচরিত উচ্চারণ মনে পড়ে- ‘কুসুমে কীট আছে, গন্ধে বিষ আছে, লতায় কণ্টক আছে ও স্ত্রী জাতি বঞ্চনা জানে’। গ্লাসের অর্ধেক ভরা আর অর্ধেক খালির গল্প তো জানা কথা। প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস যেখানে জাতির উত্তরণ দেখছেন, রাজনৈতিক নেতারা সেখানে ক্ষমতার খায়েশ দেখছেন। আর রাজনীতিবিদদের দোষ দিয়ে লাভ নেই। তারা তো ক্ষমতার জন্যই রাজনীতি করেন। আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সংজ্ঞায় ‘সম্পদের কর্তৃত্বপূর্ণ বণ্টনের নামই যদি হয় রাজনীতি, তাহলে তাদের আর দোষ কী!’ ক্ষমতায় গিয়ে কর্তৃত্বের মালিক মোক্তার হবেন, রাষ্ট্রের সব উৎপাদনের উৎসের ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করবেন এবং রাষ্ট্রীয় সম্পদে ভাগ বসাবেন, সেখানে কোথাকার এক সংস্কারবিলাসী বাধা হয়ে দাঁড়াবেন, তা কি সহজে মেনে নেওয়া যায়?

তবে জুলাই বিপ্লবের আশা-আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূসের সদিচ্ছার সংগতি ছিল। বিপ্লবের সারথি তরুণ তুর্কিরা বলছিল নতুন রাষ্ট্রব্যবস্থা, নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত তথা আমূল-সংস্কারের কথা। এসব উচ্চারণের মধ্যে জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিধ্বনি ছিল। বিপ্লব যেমন চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দেয় সবকিছু, তাদের আকাঙ্ক্ষায়ও এ রকম দৃঢ়তা ছিল। কিন্তু আমরা এটাকে বিপ্লব বললেও আসলে সর্বাত্মক পরিবর্তন আকাঙ্ক্ষী হয়ে ওঠেনি এই বিপ্লব। প্রথম কারণ হচ্ছে, আমাদের সমাজ কাঠামোর রক্ষণশীলতা। এদেশের রাজনৈতিক এলিটরা নিয়ম, গঠন ও গণতান্ত্রিক বিধিব্যবস্থায় বিশ্বাস করেন। আমাদের রাজনীতিবিদরা রক্ষণশীল। তাই রক্ষা করতে চেয়েছেন পুরোনো সংবিধান, রাষ্ট্রপতির মর্যাদা এবং সমাজ কাঠামোর গতানুগতিকতা। এর মধ্যেও যে পরিবর্তন আকাঙ্ক্ষী বা সবকিছু ভেঙেচুরে দেওয়ার মনমানসিকতা সম্পন্ন ছিলেন না, তা নয়। বিপ্লবীরা গড়িষ্ঠের উচ্চারিত এবং অনুচ্চারিত কার্যব্যবস্থার কাছে আত্মসমর্পণ করেছে। পরে তারা শহীদ মিনারে শপথ অথবা রাষ্ট্রপতির গদি উৎখাতের যত কথাই বলেছে, ততটাই নিষ্ফল, আস্ফালন বলে প্রতিভাত হয়েছে। যখন আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের কথা বিপ্লবীরা বললেন, তখন রক্ষণশীলরা আওয়ামী লীগকে রক্ষা করার ভাষায় আইন ও নিয়মতান্ত্রিকতার দোহাই দিয়ে বসল। অবশেষে আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ হলো বটে, অনেক ঘাটের পানি খেয়ে অবশেষে। তাহলে বোঝা যায়, আমাদের শাসক এলিটরা আইনের ভাষায় অভ্যস্ত নন, বরং বেআইনি অথবা মার্চ টু যমুনার মতো আন্দোলনের কাছে অসহায়।

প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূসের পদত্যাগের গুঞ্জনের পর পুরো জাতি যেন নড়েচড়ে বসল। বোঝা গেল প্রফেসর ইউনূসের জন্য মানুষের হৃদয়ে এতদিনে একটু জায়গা তৈরি হয়েছে। আমরা সর্বত্র উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা লক্ষ করলাম। অবশেষে তিনি পদত্যাগ করবেন না- এমন খবরে জাতি আশ্বস্ত হলো। যারা এতদিন ধরে ইউনূসের পদত্যাগের জন্য উচ্চ স্বরে চিৎকার করছিল, তাদের কণ্ঠ একটু নমনীয় হলো। তখন সবাই এক বাক্যে বলল, আমরা তো ওনার পদত্যাগপত্র চাই না। নির্বাচন কর্মসূচি চাই মাত্র। তার পরদিন প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে যখন সংলাপ হলো, আমাদের মতো সুবোধ নাগরিকও বিশ্বাস করতে চাইল, ‘সংলাপের মাধ্যমে সমাধান হবে সংকটের’। কিন্তু না, সংলাপ ট্রেনের অবশেষে ক্ষীণ আশার আলো দেখা গেল না। যে তিমিরে ছিল, সেই তিমিরেই রয়ে গেল সংকট। ঝগড়াটি আরো উত্তপ্ত হলো এ জন্য যে, কোনো বিবেচনায় এনসিপি তৃতীয় স্থানে পৌঁছাল। নাগরিক সাধারণ যেখানে প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূসের নমনীয়-কমনীয় দৃষ্টিভঙ্গির কথা আশা করছিল, সেখানে দেখা গেলÑতিনি নাকি কঠোর হয়েছেন। রাজনীতির কুশীলবরা বলেন, ‘One step forward, two step backward, two step forward, one step backward’ রাজনৈতিক কৌশল। উপদেষ্টামণ্ডলীর এই কঠোর মনোভাব বিএনপিকে সংগতভাবেই সংক্ষুব্ধ করেছে। তা ছাড়া এই কঠোর দৃষ্টিভঙ্গি উত্তরপাড়ার দিকে এগোয় কি নাÑসেটি নিয়েও কথাবার্তা ছিল অনেক। এর ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া নিয়ে সচেতন নাগরিকরা ছিলেন উদ্বিগ্ন। খেলার ভাষ্যকারের মতো বলি, বিপদ ঘটার সম্ভাবনা ছিল, বিপদ ঘটেনি।

বাগ্‌যুদ্ধ সম্পর্কে বাঙালিদের বহুত সুনাম আছে। এক সপ্তাহ ধরে বিএনপি বনাম এনসিপির বাগ্‌যুদ্ধ নাগরিকরা বেশ উপভোগ করেছে। উভয় পক্ষের শীর্ষ নেতা থেকে পাতি নেতারা যে আস্ফালন করেছেন, তা উত্তাপ ছড়িয়েছে অনেক। এনসিপি নেতা নাহিদের শঙ্কা জুলাই অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষা অধরা থেকে যাচ্ছে। তিনি বলেন, বিচার ও সংস্কার ছাড়া শুধু নির্বাচনের দিকে গেলে সেটা জনগণ ও অভ্যুত্থানের সঙ্গে প্রতারণা হবে। আমরা সেই প্রতারণা কাউকে করতে দেব না। এর উত্তরে আমীর খসরু মাহমুদ বলেছেন, নির্বাচনের মাধ্যমে একটা নির্বাচিত সরকার না আসা পর্যন্ত কিছু বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বাংলাদেশে একটি নির্বাচিত সরকারের প্রয়োজন। এনসিপির তরফ থেকে একটি প্ল্যাটফরম থেকে বলা হয়, অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নে জুলাই ঘোষণাপত্র জরুরি। জুলাই ঘোষণাপত্র নিয়ে রাজনৈতিক মহলে অবশেষে আশা এবং আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। যেখানে গণঅভ্যুত্থান বা গণবিপ্লবের প্রাক্কালেই ঘোষণাটি করা দরকার ছিল। সময় গড়িয়ে যাওয়ায় এর শাখা-প্রশাখা গজিয়েছে অনেক। রাজনীতিকীকরণের অভিযোগ উভয় পক্ষ থেকেই আশঙ্কার সঙ্গে উল্লেখ করা হচ্ছে। বাজারে গুজব আছে এ রকমÑবর্ষপূর্তিতে এনসিপি স্বঘোষিত একক ঘোষণা দিতে পারে। এতে থাকতে পারে সংবিধানের অবলুপ্তি, রাষ্ট্রপতির অবসান এবং স্বঘোষিত সংস্কার। সত্যিই যদি এ ধরনের একক ঘোষণাপত্র জারি করা হয়, তা অরাজক অবস্থার সৃষ্টি করবে। কোনোভাবেই এটি কাম্য নয়। আবার এটাও কাম্য নয় যে, ডিসেম্বরের নির্বাচনি শিডিউল ঘোষণা না করলে মির্জা আব্বাসের কথামতো বিএনপিই নির্বাচনের ঘোষণা দেবে।

এসব বাদানুবাদের মধ্যে আরো মাত্রা ছড়িয়েছে প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূসের একটি উক্তি। গত ২৯ মে ২০২৫ তারিখ জাপানে ৩০তম নিক্কেই ফোরামে ফিউচার অব এশিয়া শীর্ষক অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, ‘আমরা জনগণকে বলছি, নির্বাচন এ বছরের শেষে ডিসেম্বরে অথবা সর্বোচ্চ আগামী বছরের জুনে হবে। তবে কিছু রাজনীতিবিদ নির্বাচনের জন্য জুন পর্যন্ত অপেক্ষা কেন, ডিসেম্বরেই নির্বাচন কেন নয়, সেই প্রশ্ন তুলছেন। দেশের সব রাজনৈতিক দল নয়, শুধু একটি দল ডিসেম্বরে নির্বাচন চাইছে’ বলে মন্তব্য করেন তিনি। দেশে তার এই মন্তব্য তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। বিশেষত, বিএনপি উল্টো নির্বাচনের বাধা হিসেবে তাকেই চিহ্নিত করে। কথাটি এখন রূপ, রস, গন্ধ দিয়ে প্রতিবাদীরা প্রকাশ করছেন। এতে ধূম্রজাল আরো বৃদ্ধি পাচ্ছে। ইতোমধ্যে ১ জুন বিকালে ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে প্রধান উপদেষ্টার উপ-প্রেসসচিব আবুল কালাম আজাদ মজুমদার প্রধান উপদেষ্টার এই বক্তব্যের ব্যাখ্যা দেন। ডিসেম্বরের মধ্যে একটি রাজনৈতিক দল নির্বাচন চায় বলে প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্যের বিষয়ে জানতে চাইলে উপ-প্রেসসচিব বলেন, ‘বড় দলগুলোর মধ্যে একটি দল ডিসেম্বরে নির্বাচন চায়, সেটি বুঝিয়েছেন।’ তার এই ব্যাখ্যা মূল বক্তব্যকে খণ্ডন করতে সক্ষম হয়েছে বলে মনে হয় না। ভুল বোঝাবুঝি অবসানে প্রধান উপদেষ্টাকে আরো কিছু বলতে হবে বলে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহল মনে করে। এদিকে গণতন্ত্রের যাত্রা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া। জিয়াউর রহমানের মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত এক সভায় তিনি বলেন, ‘যে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা আর সার্বভৌমত্ব লড়াইয়ে তিনি (জিয়াউর রহমান) শাহাদাতবরণ করেছেন, সেই গণতন্ত্রের নিরবচ্ছিন্ন যাত্রা আজও বাধাগ্রস্ত হচ্ছে প্রতি পদে। ’

আশার কথা হলো, বিএনপি এখনো প্রফেসর ইউনূস সম্পর্কে কঠোর অবস্থান গ্রহণ করেনি। বিএনপি তার প্রতি জনগণের দ্ব্যর্থহীন নিরঙ্কুশ সমর্থন প্রদর্শনের মাধ্যমে অন্তর্বর্তী সরকারকে কঠিন বার্তা দিতে চাচ্ছে। এর বিপরীতে কয়েক দিন আগে জুলাই ঐক্য নামের একটি ভুইফোঁড় সংগঠন শাহবাগে মার্চ ফর ইউনূস কর্মসূচি পালন করে। ওই সংগঠনের নেতারা আওয়াজ তুলেছেন ইউনূস সরকার পাঁচ বছর ক্ষমতায় থাকুক। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও এ ধরনের প্রচার-প্রোপাগান্ডা চলছে। কবিগুরুর কথিত পারিষদরা এখন রাজার চেয়ে উঁচু গলায় কথা বলছেন। মূলত ক্ষমতার হালুয়া-রুটির ভাগীদার এসব লোক প্রফেসর ইউনূসের ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। লক্ষণীয় যে, বিপ্লবের সঙ্গী-সাথি, পিএস-এপিএসরা গুরুতর অভিযোগের সম্মুখীন হচ্ছেন। বিপ্লবের ছাত্রনেতৃত্ব যেখানে তাদের নিরপেক্ষ, সম্মান ও সমীহ দ্বারা জনগণের আস্থাভাজন হবেন, সেখানে তারা রাজনৈতিক দল করে ঝুঁকির সম্মুখীন হয়েছেন। প্রফেসর ইউনূসের জন্য এরা বিব্রতকর অবস্থার সৃষ্টি করছেন কি না- সেটিও বিবেচ্য বিষয়।

এদিকে সংস্কার প্রশ্নে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে দ্বিতীয় ধাপের আলোচনা শুরু করতে যাচ্ছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। খুব সংগতভাবেই পুরো জাতি অপেক্ষা করছে, এ ধরনের সংলাপের মাধ্যমে জাতীয় ঐক্যে যে মৃদু ফাটল ধরেছে, তার উপযুক্ত মেরামত ঘটবে। সব ক্ষেত্রেই রাজনৈতিক সদিচ্ছাই শেষ কথা। উত্থিত এই বিতর্কগুলো মৌলিক কিছু নয়। পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া মাত্র। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহল মনে করে, ডিসেম্বর থেকে জুন খুব দীর্ঘ পথ নয়। অন্তর্বর্তী সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের দায়-দায়িত্বের কথা মনে রেখে জাতীয় নির্বাচনের ক্ষেত্রে একটি সম্মত পথরেখা নির্মাণ করবেÑগোটা জাতি অধীর আগ্রহে এমন জাতীয় ঐকমত্যের প্রত্যাশা করছে।