
প্রতিবছর ঈদুল আজহার আগে সব ধরনের মশলার চাহিদা এবং দাম বাড়বে, এটাই যেন রীতি হয়ে দাঁড়িয়েছিল। কিন্তু এবার চট্টগ্রামের বাজারে অধিকাংশ মশলার দাম কমে গেছে। এতে স্বস্ত্বি মিলছে কোরবানিদাতা ভোক্তাদের। পাইকারি ব্যবসায়ীরা বলছেন, কোরবানির ঈদের আগে মশলার দাম কমে যাওয়ার এ চিত্র অন্তঃত গত দু’দশকে দেখা যায়নি।
আমদানি ঋণপত্র খোলার ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলোর সহযোগিতা, পর্যাপ্ত আমদানি, বাজারে সরবরাহ ঘাটতি না থাকা, সিন্ডিকেট ভেঙ্গে যাওয়া এবং একইসঙ্গে তুলনামূলক চাহিদাও কমে যাবার কারণে মশলার দাম এবার কম বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।
সোমবার (২ জুন) দেশের ভোগ্যপণ্যের অন্যতম বৃহত্তম পাইকারি বাজার খাতুনগঞ্জে মশলাজাত পণ্যের দর যাচাই করে এ চিত্র পাওয়া গেছে। এছাড়া খুচরাও দর যাচাই করে বিভিন্ন ধরনের মশলার দর তুলনামূলক কম পাওয়া গেছে। তবে পাইকারি বিক্রেতারা বলছেন, পাইকারিতে যেভাবে মশলার দাম কমেছে, খুচরায় এর প্রভাব সেভাবে পড়েনি।
এদিন খাতুনগঞ্জে পাইকারিতে দেশি পেঁয়াজ ৫০-৬০ টাকা ও ভারতীয় পেঁয়াজ ৬০-৬৫ টাকায় বিক্রি হয়েছে। প্রতি কেজি দেশি আদা মানভেদে ১১০-২৫০ টাকা এবং ভারতীয় ও চীনা আদা ১১০-২২০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। প্রতি কেজি দেশি রসুন ১১০- ১৬০ টাকা ও চীনা রসুন ১৮৫-২৪০ টাকায় বিক্রি হয়েছে।
খাতুনগঞ্জের হামিদউল্লাহ মার্কেটের পেঁয়াজের আড়তদার মেসার্স বাচা মিয়া ট্রেডার্সের মালিক মোহাম্মদ ইদ্রিস সারাবাংলাকে বলেন, ‘এবার পাইকারি ও খুচরায় পেঁয়াজ, রসুন, আদার দাম গতবছরের চেয়ে অন্তঃত ৪০-৫০ টাকা কম আছে। অন্যান্যবার কোরবানির ঈদের আগে এ তিনটি পণ্যের দাম বেড়ে যেত। এবার কমেছে, তার কারণ হচ্ছে, দেশি পেঁয়াজ-রসুন এখন বাজারে পর্যাপ্ত আছে। ভারতেও দাম কম। আমদানিও প্রচুর হয়েছে।’
চাক্তাই পাইকারি বাজারের রহমানিয়া স্টোরে দেখা গেছে, শুকনো মশলার মধ্যে হলুদ প্রতিকেজি ১৯০-২৩০ টাকা, দেশি শুকনা মরিচ ১২০-১৭০ টাকা, ভারতীয় মরিচ ২১০- ২৫০ টাকা, বাদাম ১৪০ টাকা, ভারতীয় জিরা মানভেদে ৩৬০ থেকে ৬৬০ টাকা, মিষ্টি জিরা ১৬০ টাকা, লবঙ্গ ১২২০- ১২৫০ টাকা, সাদা তিল ২১০-২৪০ টাকা, কালো জিরা মানভেদে ৩৩০ থেকে ৩৭০ টাকা, সাদা ও লাল সরিষা ১০০ টাকা, মেথি ১৩০ টাকা, এরারুট ৩০০ টাকা, তিশি ১০০ টাকা, গোলমরিচ ১১৪০ টাকা, পাঁচফোড়ন ১৭০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
এছাড়া কালো তিল ১৪০ টাকা, ভারতীয় এলাচ ৪২০০-৪৬০০ টাকা, বড় দানা এলাচ মানভেদে ২৭০০-২৮০০ টাকা ও ৪৬০০ টাকা, কাজু বাদাম ১৭০০ টাকা, কাঠ বাদাম ১২০০ টাকা, কিসমিস ৫৩৫ টাকা, কালো কিসমিস ৫০০ টাকা, আলুবোকরা ৫৪০-৫৬০ টাকা, জয়ত্রি ২৭০০ টাকা, সাদা গোলমরিচ ১৩০০-১৩৮০ টাকা, কাবাব চিনি ২২০০ টাকা, জায়ফল খোলা ৬৫০ টাকা ও প্যাকেট ৫৮০ টাকা, বচ মশলা ৭০০ টাকা, দারচিনি মানভেদে ৩৭০ থেকে ৪৫০ টাকা, স্টার মশলা ৮০০ টাকা, আদাশুট ৮০০ টাকা এবং টক লবণ প্রতিকেজি ১২০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
আড়তদার ও বিক্রেতাদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ভারতীয় জিরা কেজিতে অন্তঃত ৭০ থেকে ৮০ টাকা, সাধারণ মানের জিরা ২০ টাকা, মিষ্টি জিরা ৩০ টাকা, লবঙ্গ ২০-৩০ টাকা, ভারতীয় এলাচ ২০০ টাকা, অন্যান্য এলাচ ২০০ থেকে ৩০০ টাকা, দারচিনি ৩০ থেকে ৪০ টাকা দাম গতবছরের চেয়ে কমেছে। তবে গোলমরিচ, কালোজিরা, সাদা গোলমরিচ, কাজুবাদামের দাম ৫০ থেকে ৬০ টাকা বেড়েছে।
খাতুনগঞ্জের পাইকারি মশলা ব্যবসায়ী মেসার্স ইসহাক সওদাগরের স্বত্বাধিকারী সেকান্দর হোসেন সারাবাংলাকে বলেন, ‘কোরবানির ঈদে যেসব মশলার চাহিদা বেশি থাকে, সেগুলোর মধ্যে প্রায় সবগুলোরই দাম কমেছে। বাজারে মশলার কোনো ঘাটতি নেই। তবে সে অনুযায়ী বিক্রি কম। পাইকারি থেকে খুচরায় অন্যান্য বছর যেভাবে পণ্য যেত, এবার সেরকম চাহিদা নেই। দাম কমে যাবার এটাও একটা কারণ। সামান্য লাভ এবং ক্ষেত্রেবিশেষে লোকসান মিলিয়ে আমরা কোনোমতে পুষিয়ে নিচ্ছি।’
গরম মশলার আমদানিকারক অমল সাহা সারাবাংলাকে বলেন, ‘গত ২০-২২ বছরে মশলার দাম কোরবানির ঈদের আগে এভাবে পড়ে যেতে, আমি দেখিনি। বলতে পারেন, এটা ২০-২২ বছরের রেকর্ড ভঙ্গ হয়েছে। এখানে বেশকিছু বিষয় কাজ করছে। প্রথমত, এখন কোনো সিন্ডিকেট নেই। পণ্য আমদানিতে এলসি খুলতে ব্যাংকগুলোতে কোনো সমস্যা হচ্ছে না। এজন্য আমদানিকারক বেড়েছে, আমদানিও প্রচুর হয়েছে। বাজারের চাহিদার চেয়ে সরবরাহ বেশি। এজন্য দাম কম।’
দেশে কৃষিজাত পণ্যের বড় অংশ আমদানি হয় চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে জাহাজের মাধ্যমে। আর আমদানির জন্য অনুমতি নিতে হয় বন্দরের উদ্ভিদ সংগনিরোধ কেন্দ্র থেকে।
সংস্থাটির তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের এপ্রিল পর্যন্ত গত ১০ মাসে দেশে প্রায় এক লাখ ৬৯ হাজার ৮৩৪ মেট্রিকটন মশলাজাতীয় পণ্য আমদানি হয়েছে। এর মধ্যে আছে- ৯৯ হাজার ৮৫৮ টন রসুন, এলাচ ১৬১৪ টন, দারচিনি ১০ হাজার ৫৪৩ টন, লবঙ্গ ২১৫৪ টন, জিরা ৩৭০২ টন, পেস্তাবাদাম ৮২৭ টন, কিসমিস ৪৮২৩ টন, শাহী জিরা ২ টন, জয়ত্রি ২৯০ টন, কাবাব চিনি ২ টন, জায়ফল ২৭২ টন, কালোজিরা ৭ টন, গোলমরিচ ১ হাজার টন, মেথি ৭২ টন, আদা ২১ হাজার ১৯ টন, পেঁয়াজ ১৪ হাজার ৬৩ টন, হলুদ ৪৩২৮ টন, শুকনো মরিচ ১৭৯ টনসহ আরও বিভিন্ন পণ্য।
বন্দরনগরীতে খুচরা বাজারে কোরবানিতে চাহিদা বেশি এমন মশলার মধ্যে বুটের ডাল প্রতিকেজি ১১০ টাকা, কাজুবাদাম ১৬০০ থেকে ১৭০০ টাকা, পেস্তাবাদাম ২৬০০ থেকে ২৭০০ টাকা, কাঠবাদাম ১২২০ থেকে ১৩০০ টাকা, কিসমিস মানভেদে ৫৫০ থেকে ৭৫০ টাকা, দারচিনি ৫৫০ টাকা, লবঙ্গ ১৪০০ টাকা, কালো গোলমরিচ ১৩০০ থেকে ১৪০০ টাকা, সাদা গোলমরিচ ১৫০০ থেকে ১৬০০ টাকা, জিরা ৬০০ থেকে ৭৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
বাংলাদেশ গরম মশলা ব্যবসায়ী সমিতির সহ-সভাপতি অমর কান্তি দাশ বলেন, ‘আমদানির জন্য এলসি ওপেন করার ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলোর উদার মনোভাব আমাদের জন্য সহায়ক হয়েছে। এতে আমদানি বেড়েছে। বিশ্ববাজারেও মশলার দাম এখন কম। তবে পাইকারিতে যত কম বিক্রি হচ্ছে, খুচরায় তো সেভাবে কমেনি। এজন্য মনিটরিং জোরদার করা দরকার ছিল।’