
ডুবতে বসছে রাষ্ট্র খাতের এক সময়ের উদীয়মান প্রতিষ্ঠান জনতা ব্যাংক। টেক্সটাইল, তৈরী পোশাক খাতসহ শিল্প খাতে বিনিয়োগ করে জাতীয় অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখা জনতা ব্যাংকের গড় দেড় দশকে আওয়ামী ফ্যাসিস্টদের দৌরাত্ম্য, রাষ্ট্রযন্ত্র ব্যবহার করে পানির মতো অর্থ বের করে ব্যাংকটিকে ফাঁপা করে ফেলা হয়েছে। পতিত প্রধানমন্ত্রীর বাণিজ্যিক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানই ব্যাংক থেকে বের করে নিয়েছেন ২৭ হাজার কোটি টাকা। ব্যাংক খেকো এস আলম বের করে নিয়েছে প্রায় ১৪ হাজার কোটি টাকা। এভাবে নাসা গ্রুপের নজরুল ইসলাম মজুমদার, এনন টেক্সসহ ডজন খানেক ব্যবসায়ী মাফিয়া ব্যাংকটি থেকে অর্থ বের করে আর ফেরত দিচ্ছেন না। শুধু তা-ই নয় বছরের পর বছর সুদ পরিশোধ না করে উল্টো তা মওকুফ করে নিয়েছেন। শুধু নাসা গ্রুপের নজরুল ইসলাম মজুমদারের ২৬১ কোটি টাকার সুদ মওকুফ করে নিয়েছেন। এভাবে এক সময়ের শক্ত মূলধনের ওপর গড়ে ওঠা জনতা ব্যাংক গত এক বছরে লোকসান করেছে ২২ শ’ কোটি টাকা। আর জানুয়ারি থেকে মার্চ তিন মাসে লোকসান করেছে ৯০০ কোটি টাকা।
ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের নিয়োগ পাওয়া চেয়ারম্যান ও এমডিরা মিলেই মাফিয়াদের অর্থ বের করে নিতে সহযোগিতা করেছেন। এতে তারাও যেমন আখের গুছিয়েছেন, আবার ব্যাংকটিকেও দেউলিয়ার পথে নিয়ে গেছেন। তাদের দাবি জনতা ব্যাংকের বর্তমান অবস্থার জন্য দায়ীদের বিরুদ্ধে দ্রুত আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। পাশাপাশি যারা ঋণ নিয়ে ফেরত দিচ্ছেন না বরং বছরের পর বছর সুদ মওকুফ করে নিয়েছেন তাদের কাছ থেকে সুদে আসলে ঋণ আদায়ের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
সালমান রহমানের ঋণ ২৭ হাজার কোটি টাকা : ব্যাংকিং খাতের নানা অনিয়ম, দুর্নীতি আর লুটপাটের সাথে জড়িয়ে আছে বেক্সিমকো গ্রুপ সালমান এফ রহমান। রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে ঋণের নামে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন তিনি। সালমান এফ রহমানের বেক্সিমকো গ্রুপ একাই ফোকলা করে দিয়েছে জনতা ব্যাংককে। গ্রুপের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে হাতিয়ে নেয়া হয় ২৭ হাজার কোটি টাকা। মানা হয়নি একক ঋণ গ্রহীতার সীমাও। বিপুল অর্থ করায়ত্তে আনতে এক মাসেই আটটি নতুন কোম্পানি খোলা হয়। বাধা না দিয়ে উল্টো অনিয়মে সহায়তা করেন সাবেক গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার। জনতা ব্যাংক মোট ঋণ বিতরণ করেছে ৯৮ হাজার কোটি টাকা। যার মধ্যে বেক্সিমকো গ্রুপ একাই নিয়েছে ২৭ হাজার কোটি টাকা, যা ব্যাংকটির বিতরণ করা ঋণের এক-চতুর্থাংশের বেশি অর্থাৎ ২৬ শতাংশ। এতে লঙ্ঘন হয়েছে একক ঋণগ্রহীতার সীমাও। এসব ঋণের বড় অংশই এখন খেলাপি হওয়ার পথে। ফলে জনতা ব্যাংক ঝুঁকিতে পড়ে গেছে। জানা যায়, ২০১৫ সালে বেক্সিমকো গ্রুপের ঋণ ছিল ২ হাজার কোটি টাকার কিছু বেশি। ২০২০ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় সাড়ে ৬ হাজার কোটিতে। পরের সাড়ে তিন বছরে ঋণ বেড়েছে প্রায় ১৯ হাজার কোটি টাকা। ঋণ নিতে এক বছরে নতুন কোম্পানি খুলেছে ৯টি। এক মাসেই খোলা হয় আটটি। প্রভাব খাটিয়ে এসব নতুন কোম্পানির নামে ঋণ নিয়েছেন সালমান এফ রহমান। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, নিয়ম লঙ্ঘন করে দেয়া এ অর্থ ফেরত আনা কঠিন।
এস আলম গ্রুপের ১৪ হাজার কোটি টাকা : ব্যাংক খেকো এস আলম শুধু দেশের ইসলামী ব্যাংকগুলোকেই ডুবাননি, জনতা ব্যাংকেও ডুবাতে তার ভূমিকা রয়েছে। ব্যাংকটি থেকে প্রায় ১৪ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে এস আলম গ্রুপ। ব্যাংক সূত্র জানিয়েছে কোনো অর্থ পরিশোধ তিনি করতেন না।
নজরুল ইসলাম মজুমদারের ২৬১ কোটি টাকার সুদ মওকুফ : রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে জনতা ব্যাংক থেকে ২৬১ কোটি টাকা সুদ মাফ করিয়ে নিয়েছেন নাসা গ্রুপের চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদার। ১৫৬ কোটি টাকা ঋণের বিপরীতে তিনি এক টাকাও সুদ দেননি। জনতা ব্যাংক থেকে নেওয়া ১৫৬ কোটি টাকার ঋণ সুদ-আসলে দাঁড়ায় ৪১৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে ২৬১ কোটি টাকাই সুদ। এ সুদ মাফ করিয়ে নিয়েছেন। অথচ যে সাত কারণে সুদ মওকুফ হয়ে থাকে, এর একটিও নজরুল ইসলাম মজুমদারের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। এক্ষেত্রে আরোপিত-অনারোপিত সব ধরনের সুদই মাফ করিয়েছেন। নিয়ম লঙ্ঘন করে গ্রুপটিকে বড় অঙ্কের সুদ মওকুফ সুবিধা দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক ও জনতা ব্যাংক।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নজরুল ইসলাম মজুমদার ব্যাংক খাতে অঘোষিত মাফিয়া। টানা দেড় দশক বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্সের (বিএবি) চেয়ারম্যান ছিলেন তিনি। তার কথার ওপর কেউ কথা বলতে পারতেন না। শেখ হাসিনার খুব ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত তিনি। হাসিনার নামেই তিনি বিভিন্ন ব্যাংক থেকে চাঁদা তুলতেন। প্রতি বছর কয়েক শ’ কোটি টাকার চাঁদা তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে জমা দিতেন। ছোট ও নতুন ব্যাংক থেকে দুই-তিন কোটি, মধ্যম সারির ব্যাংক থেকে চার-ছয় কোটি এবং বড় ব্যাংক থেকে ১০-২০ কোটি টাকা চাঁদা তুলতেন নজরুল ইসলাম মজুমদার। এ ছাড়া আন্তঃব্যাংক ফুটবল টুর্নামেন্ট ছেড়ে কামিয়েছেন মোটা অঙ্কের টাকা। প্রতিটি ব্যাংকের শুধু এন্ট্রি ফিই ছিল ২৫ লাখ টাকা। এর বাইরে অন্যান্য খরচ তো আছেই। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক ব্যাংকের চেয়ারম্যান নয়া দিগন্তকে বলেন, সব ব্যাংকের চেয়ারম্যান তখন জিম্মি ছিলেন, কেউ কথা বলতে পারতেন না। নজরুল ইসলাম মজুমদার যা বলতেন, তাই হতো। ব্যাংক খাতের আজকের দুর্দশার জন্য বিএবি বড় অংশে দায়ী। তিনি বলেন, বিএবির মতো একটা প্রতিষ্ঠান তখন খেলাধুলায় ব্যস্ত ছিল।
আব্দুস সালামের ভূমিকা : পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় নিয়োগ পাওয়া চেয়ারম্যান এমডিরাই জনতা ব্যাংকটিকে ডুবাতে বড় ভূমিকা রেখেছেন। এর মধ্যে অন্যতম হলেন, জনতা ব্যাংকের সাবেক ও পলাতক এমডি আব্দুস সালাম আজাদ। তার আমলেই ব্যাংকটি থেকে সবচেয়ে বেশি অর্থ বের হয়ে গেছে। নিজে নিরাপদে থেকে বিভিন্ন গ্রাহকের কাছ থেকে হাতিয়ে নিয়েছেন কোটি কোটি টাকা। সেই টাকা পাচার করে দুবাইয়ে বাড়ি বানিয়েছেন। বিপরীতে ডুবিয়েছেন জনতা ব্যাংককে। সর্বশেষ ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালকের (এমডি) দায়িত্বে থেকে সাড়ে পাঁচ বছরে দ্বিগুণ করেছেন খেলাপি ঋণ। এর বেশির ভাগই পুঞ্জীভূত হয়েছে বড় গ্রাহকদের কাছে।
জনতা ব্যাংকের চলমান অবস্থায় যারা ঋণ নিয়েছিলেন তারা কেউ আর পরিশোধ করছেন না। প্রতিনিয়তই লোকসানের মুখে পড়ছে ব্যাংকটি। বর্তমান কর্তৃপক্ষও ঋণ আদায়ের প্রতি তেমন গুরুত্ব না দিয়ে আমানত সংগ্রহে বেশি ব্যস্ত বলে অভিযোগ করেছেন কর্মকর্তারা। ঋণ আদায়ের জন্য নতুন কোনো কৌশল অবলম্বন করা হচ্ছে না। তবে আমানত সংগ্রহ করতে প্রত্যেক কর্মকর্তাকে চাপ প্রয়োগ করা হচ্ছে। মাসে ন্যূনতম ৫ লাখ টাকা করে আমানত সংগ্রহ করতে বলা হচ্ছে। ক্ষুব্ধ এক কর্মকর্তা গতকাল নয়া দিগন্তকে জানিয়েছেন, এখন সবচেয়ে গুরুত্ব দেয়া দরকার ঋণ আদায়ের দিকে। কারণ ঋণ হলে ব্যাংকের সম্পদ। ঋণ আদায় যত বাড়বে ব্যাংকের মূলধন কাঠামো তত শক্তিশালী হবে। আর আমানত হলো ব্যাংকের দায়। অথচ ঋণ আদায়ের ওপর জোর না দিয়ে দায় বাড়ানোর দিকে বেশি গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। অভিযোগ রয়েছে, ফ্যাসিস্ট সরকারের আমলে নিয়োগ পাওয়া ব্যাংকের প্রধান আর্থিক কর্মকর্তা বা সিএফও আমানত সংগ্রহে নতুন নতুন লক্ষ্যমাত্রা বেঁধে দিচ্ছেন। তিনিই ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহীকে বিপদের মুখে ঠেলে দিচ্ছেন।
তাদের মতে, এমনিতেই রাষ্ট্রায়ত্ত অন্য ব্যাংকগুলোর মতো জনতা ব্যাংকের সাধারণ কর্মকর্তাদের পদোন্নতি দেয়া হয়নি। অনেকেই পদোন্নতি বঞ্চিত রয়েছেন। এর ওপর নতুন নতুন আমানত সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা সাধারণ কর্মকর্তাদের মধ্যে অসন্তোষ বিরাজ করছে। এ থেকে রক্ষা পেতে সঠিক সিদ্ধান্তের মাধ্যমে জনতা ব্যাংককে রক্ষার জন্য কর্তৃপক্ষের কাছে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়ার দাবি জানান তারা।