Image description

ভোটের অনেক আগে থেকে ফল প্রকাশের পর পর্যন্ত শুধু টাকার খেলা। নির্বাচনে ধনী গোষ্ঠী ও ব্যবসায়ীদের অংশগ্রহণ বাড়ার সঙ্গে টাকা খরচের হার পাল্লা দিয়ে বেড়েছে। এতে করে অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচনের দেখা মিলছে না। প্রাজ্ঞ রাজনীতিবিদ বা তরুণ ও নারীদের অংশগ্রহণ কঠিন হয়ে পড়ায় বাংলাদেশের রাজনীতি গণমানুষের আকাঙ্ক্ষা পূরণ করতে পারছে না। যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্র দপ্তরের অর্থায়নে ওয়েস্টমিনস্টার ফাউন্ডেশন ফর ডেমোক্রেসি (ডব্লিউএফডি) গতকাল এক প্রতিবেদনে এমন তথ্যই প্রকাশ করেছে। অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন বলতে প্রতিবেদনে শুধু রাজনৈতিক দলগুলোই নয়, সাধারণের অংশগ্রহণের বিষয়টিও তুলে ধরা হয়েছে।

বাংলাদেশের নির্বাচনী রাজনীতিতে অর্থ খরচের বৈশিষ্ট্য রয়েছে। আর এটি এখনকার রাজনৈতিক সংস্কৃতিও। তবে এ খরচ ক্রমে বাড়ছে, যা এখন সাধারণের নাগালের বাইরে। ফলে রাজনীতিতে আসার যারা অভিপ্রায় রাখেন, বিশেষ করে প্রান্তিক পর্যায়ের প্রতিনিধিসহ নারী ও তরুণদের জন্য এ খরচ নির্বাচনে তাদের প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেই সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলো থেকে প্রার্থিতা পেতে দলীয় ফান্ডে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ চাঁদা দেওয়ার রেওয়াজ রয়েছে। ফলে রাজনীতিতে ধনীদের আনাগোনা বেড়ে গেছে। দেখা গেছে, প্রার্থীরা অর্থ খরচ শুরু করে প্রতিদ্বন্দ্বীর বিরুদ্ধে প্রচারণা বা ভোটারদের কাছে ভোট চাইতে যাওয়ার অনেক আগে থেকেই। যাদের অর্থ কম, তারা দলীয় এবং নিজস্ব ফান্ড তৈরি করেন। এমন প্রার্থীরা শেষ পর্যন্ত জনগণের প্রতি দায়বদ্ধ না হয়ে অর্থদানকারীদের প্রতি বেশি ঝুঁকে পড়েন। এতে জনগণের রাজনৈতিক ব্যবস্থার ওপর থেকে বিশ্বাস উঠে যায় এবং নির্বাচনী ব্যবস্থার সততা নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপন শুরু করে।

 
 

ডব্লিউএফডির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৮ সালে সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) এক প্রতিবেদনে দেখানো হয়, প্রায় ৮২ শতাংশ সংসদ সদস্যের এক কোটি টাকার ওপর সম্পদ রয়েছে। এদের মধ্যে ৩২ শতাংশের সম্পদ পাঁচ কোটি টাকার অধিক। ২০২৪ সালে নির্বাচনে অংশ নেওয়া ৯২ দশমিক ৮ শতাংশ আওয়ামী লীগ প্রার্থীর বার্ষিক আয় দুই কোটির বেশি। বাংলাদেশের নিয়ম অনুযায়ী একজন প্রার্থী সর্বোচ্চ ২৫ লাখ টাকা নির্বাচনের জন্য ব্যয় করতে পারবেন। তবে পূর্বে অভিজ্ঞতা অনুযায়ী, রাজনৈতিক দলের ২০০-এর বেশি প্রার্থী নির্বাচনী প্রচারণায় সাড়ে চার কোটি টাকার ওপর খরচ করেছেন।

 

প্রতিবেদন তৈরির সঙ্গে যুক্ত জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের বাংলাদেশ সেন্টার ফর ইন্দো-প্যাসিফিক অ্যাফেয়ার্সের নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক সাহাব এনাম খান সমকালকে বলেন, যে গতানুগতির সংস্কার কার্যক্রম চলছে, তার থেকে বের হয়ে আমরা প্রতিবেদনে রাজনীতিতে অন্তর্ভুক্তির বিষয়টি আরও বিস্তৃত করে দেখিয়েছি। নির্বাচন অন্তর্ভুক্তিমূলক বলতে আমরা শুধু রাজনৈতিক দলগুলোর অংশগ্রহণই বুঝে থাকি। অন্তর্ভুক্তি বলতে এখানে সাধারণ মানুষের কথাও তুলে ধরেছি। বিশেষ করে বাংলাদেশে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার যে খরচ, তাতে অনেক সৎ ও যোগ্যরা অংশ নিতে পারছেন না। ভোটে অতিরিক্ত খরচ সাধারণের অংশ নেওয়ার সুযোগ কমিয়ে দেয়।

 

স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশে সংসদ সদস্যের পেশা উল্লেখযোগ্য হারে পরিবর্তন হয়েছে। ২০১৮-এর সংসদে ৬১ শতাংশ সদস্য ব্যবসায়ী ছিলেন। যদিও ১৯৭৩ সালের সংসদে আইনজীবীর অংশগ্রহণ ছিল ৩১ শতাংশ। সে সময়টিতে ১৮ শতাংশ ব্যবসায়ী সংসদ সদস্য ছিলেন। তবে ১৯৯১ সালে সংসদে ব্যবসায়ীর সংখ্যা একলাফে ৩৮ শতাংশে চলে যায়। আর ২০০৮ সালে ব্যবসায়ীর সংখ্যা ৫৭ শতাংশে পৌঁছে।

২০২৪ সালে নির্বাচিত সংসদ সদস্যের মধ্যে ৬৬ শতাংশ ছিলেন ব্যবসায়ী। এদের ৬৪ দশমিক ১৫ শতাংশ আওয়ামী লীগের, ৬৬ দশমিক ৩ শতাংশ ছিলেন জাতীয় পার্টির। রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা বা চর্চার পরিবর্তে বাংলাদেশের রাজনীতিতে ব্যবসায়ীদের প্রভাব মূলত অর্থনৈতিক কারণে বেড়েছে। প্রতিবেদনে মোহাম্মদ শহিদুল ইসলাম ওরফে কাজী পাপুলের উদাহরণ দেওয়া হয়েছে, কীভাবে তিনি লক্ষ্মীপুর-২ আসনের সংসদ সদস্য হয়েছিলেন।

প্রতিবেদনে নির্বাচন কমিশনের অদক্ষতার কথা তুলে ধরা হয়েছে। নির্বাচন কমিশনে দেওয়া হিসাব অনুযায়ী, ২০০৮ সাল থেকে খরচ ক্রমান্বয়ে বেড়েছে। সেই নির্বাচনে প্রার্থীপ্রতি ৮ লাখ ৩৪ হাজার ৫৩৬ টাকা খরচের হিসাব দেখানো হয়েছে। এ অঙ্ক ২০১৪ সালে জনপ্রতি প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে, যা ১৯ লাখ ৬ হাজার ৫২৬ টাকা। ২০১৮ সালে খরচ ১৪ লাখে নেমে এলেও ২০২৪ সালে এ খরচ জনপ্রতি ১৬ লাখ ২৭ হাজার ৩১১ টাকায় গিয়ে পৌঁছে। বাংলাদেশে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার আর্থিক বোঝা এ হিসাব থেকেই বোঝা যায়। এ ছাড়া প্রার্থিতা পেতে পার্টি ফান্ডে চাঁদার প্রতিযোগিতাসহ অন্যান্য খরচের বিষয় তুলে ধরা হয়। যদিও এমন খরচের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। নির্বাচন কমিশনও এসব হিসাব খতিয়ে দেখে না।

প্রতিবেদনে প্রার্থীর এসব খরচের কারণে নির্বাচন-পরবর্তী প্রভাবের বিষয় তুলে ধরা হয়। বিজয়ী হিসেবে নিশ্চিত হওয়ার পর বাংলাদেশের নির্বাচিত এমপিদের বিভিন্ন আর্থিক বাধ্যবাধকতার সম্মুখীন হতে হয়। নির্বাচন-পরবর্তী এই খরচের মধ্যে রয়েছে সামাজিক প্রকল্পের তহবিল, স্থানীয় অফিস রক্ষণাবেক্ষণ এবং নিয়মিতভাবে দলীয় তহবিলে অবদান রাখা। অনেক এমপি তাদের নির্বাচনী এলাকার চাহিদা পূরণের জন্য ক্রমাগত আর্থিক চাপের মধ্যে পড়েন– প্রায়ই স্থানীয় মিছিলকে সমর্থন করে, অনুষ্ঠান আয়োজন করে এবং তাদের প্রচারণার সময় দেওয়া প্রতিশ্রুতি পূরণ করে। এই প্রতিশ্রুতিগুলো পরিচালনা করার জন্য এমপিদের বেসরকারি সংস্থা বা স্থানীয় ব্যবসার আর্থিক অনুদানের ওপর নির্ভর করতে হয়। 

রাজনৈতিক প্রচারণার অত্যধিক আর্থিক চাহিদা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার বিকৃতি ঘটায়। এগুলোর সঙ্গে দুর্নীতি, সংঘটিত অপরাধের ব্যাপক প্রভাব এবং বৃহত্তর অর্থনৈতিক অস্থিরতার দৃঢ় সম্পর্ক রয়েছে। যেসব প্রার্থীর উল্লেখযোগ্য আর্থিক সম্পদ রয়েছে, তারা প্রায়ই শক্তিশালী ব্যবসায়িক গোষ্ঠী এবং সন্দেহজনক তহবিল ব্যবস্থা দ্বারা সমর্থিত, তারা প্রতিনিধিত্বকারী জনসাধারণের প্রকৃত চাহিদার চেয়ে তাদের অর্থনৈতিক এজেন্ডাগুলোকে অগ্রাধিকার দেওয়ার প্রবণতা রাখে। এই প্রবণতা কেবল গণতন্ত্রের মৌলিক নীতিগুলোই দুর্বল করে না; বরং পৃষ্ঠপোষকতা এবং স্বার্থপরতাকেও স্থায়ী করে তোলে।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রক্রিয়াকে ন্যায়সংগত, অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং গণতান্ত্রিক করতে বিদ্যমান আইনি কাঠামোকে সংষ্কার এবং শক্তিশালী করতে হবে। রাজনৈতিক দলের কার্যক্রম, নির্বাচনী পদ্ধতি এবং প্রচারণার অর্থায়ন নিয়ন্ত্রণকারী আইনগুলোর পুনর্বিবেচনা করতে হবে, যাতে তারা ন্যায্যতা এবং অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করতে পারে। মনোনয়ন প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি বাড়াতে হবে। এটি অর্জন করতে মনোনয়নের মানদণ্ড ও পদ্ধতিগুলো স্পষ্টভাবে সংজ্ঞায়িত করতে হবে এবং জনসাধারণের কাছে সহজলভ্য করতে হবে।

প্রচারণার অর্থ কার্যকরভাবে পর্যবেক্ষণ, বাস্তবসম্মত সীমা প্রয়োগ এবং প্রচারণার খরচ প্রতিফলিত করার জন্য পর্যায়ক্রমে সেগুলো নির্বাচন কমিশনকে পর্যালোচনা করতে হবে। প্রার্থীদের আয়ের উৎস ও প্রচারণা ব্যয়ের একটি পুঙ্খানুপুঙ্খ তদন্তও অপরিহার্য। এখানে প্রার্থীরা যাদের থেকে তহবিল সংগ্রহ করছেন, তাদের নাম ও চাঁদার পরিমাণ উল্লেখ করার আইন থাকতে হবে।

নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় আর্থিক অসদাচরণ, দুর্নীতি এবং সম্পদের অবৈধ ব্যবহার রোধে আইনি কাঠামো শক্তিশালীকরণ এবং সমন্বিত পদ্ধতির প্রচারের জন্য গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সহযোগিতা বৃদ্ধি অপরিহার্য। এ জন্য নির্বাচনের সময়ে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), বাংলাদেশের তথ্য কমিশন, অডিট জেনারেল এবং নির্বাচন কমিশন সমন্বয়ের মাধ্যমে কাজ করতে পারে।

সেই সঙ্গে হুইসেলব্লোয়ার বা জনস্বার্থ-সংক্রান্ত তথ্য প্রকাশে সুরক্ষা প্রদান করতে হবে, যা সাধারণত হুইসেলব্লোয়ার সুরক্ষা আইন নামে পরিচিত। বাংলাদেশে এর বাস্তবায়ন সীমিত। রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক, আইনজীবী, সাধারণ জনগণসহ গুরুত্বপূর্ণ অংশীদারদের মধ্যে এ আইন সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে ব্যাপক পদক্ষেপ গ্রহণের প্রয়োজন রয়েছে।

রাজনীতিতে স্বার্থান্বেষী মহলের প্রভাব কমাতে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে গণতান্ত্রিক অনুশীলন প্রতিষ্ঠা অপরিহার্য। রাজনৈতিক ক্ষমতা নির্বাচিত কিছু ব্যক্তি বা প্রভাবশালী পরিবারের হাতে কেন্দ্রীভূত। সাম্প্রতিক ছাত্র বিদ্রোহ ও এর আকাঙ্ক্ষা রাজনৈতিক নেতা এবং তরুণ ও মধ্যম স্তরের রাজনীতিবিদদের জন্য এই রাজনৈতিক রীতিনীতি পরিবর্তনের স্পষ্ট ও স্বচ্ছ পথের সুযোগ তৈরি করেছে। প্রতিবেদনে আন্তঃদলীয় সংলাপের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে।