সুইস শহর দাভোসে বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের (ডব্লিউইএফ) বার্ষিক সভা এবং অন্যান্য উচ্চপর্যায়ের পার্শ্ব ইভেন্টের সময় কমপক্ষে ৪৭টি অনুষ্ঠানে যোগ দেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। অথচ তার সফর নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে নানা গুজব। অনলাইনে প্রচারণা চালানো হয়, তিনি আর ফিরবেন না। এমনকি সরকারের উপদেষ্টারাও পালাচ্ছেন— এমন প্রচারণাও চালানো হয় বিভিন্ন মাধ্যমে। যদিও প্রধান উপদেষ্টা নির্ধারিত সময়েই দেশে ফিরে আসেন এবং গুজবের মোক্ষম জবাব দেন প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম।
তিনি বলেন, ‘যারা পালিয়েছে, তারাই (প্রচারণা) চালাচ্ছে। শেখ হাসিনা পালায় না বলে, তিনি পালিয়ে গেলেন।’ এটি পালিয়ে যাওয়া ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের ‘বড় রকমের প্রোপাগান্ডা ক্যাম্পেইন’ বলেও উল্লেখ করেন শফিকুল আলম।
এমন গুজবের মধ্যে যেন ঘি ঢেলে দিলেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। ‘অন্তর্বর্তী সরকারের নিরপেক্ষতা’ এবং সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য ‘নিরপেক্ষ সরকারের প্রয়োজন’— তার এমন মন্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে রাজনৈতিক মহলে নতুন করে তৈরি হয় উত্তেজনা, চলে বাহাস। মির্জা ফখরুলের ওই বক্তব্যের জবাবে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয় এবং ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম বলেন, ‘বিএনপি মহাসচিবের নিরপেক্ষ সরকারের দাবি মূলত আরেকটা এক-এগারো সরকার গঠনের ইঙ্গিত বহন করে।’
এমন গুজবের মধ্যে যেন ঘি ঢেলে দিলেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। ‘অন্তর্বর্তী সরকারের নিরপেক্ষতা’ এবং সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য ‘নিরপেক্ষ সরকারের প্রয়োজন’— তার এমন মন্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে রাজনৈতিক মহলে নতুন করে তৈরি হয় উত্তেজনা, চলে বাহাস। মির্জা ফখরুলের ওই বক্তব্যের জবাবে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয় এবং ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম বলেন, ‘বিএনপি মহাসচিবের নিরপেক্ষ সরকারের দাবি মূলত আরেকটা এক-এগারো সরকার গঠনের ইঙ্গিত বহন করে
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, বাংলাদেশে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য দুটি সম্ভাব্য সময় নির্ধারণ করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। হয় ডিসেম্বর ২০২৫ অথবা ২০২৬ সালের মাঝামাঝিতে অনুষ্ঠিত হবে জাতীয় সংসদ নির্বাচন। তবে এটিও বলা হচ্ছে যে, নির্বাচনের সময়সূচি নির্ভর করছে জনগণ কতটুকু সংস্কার চায়, তার ওপর। ইতোমধ্যে নির্বাচন সংস্কার কমিশন গঠন করা হয়েছে। তারা তাদের প্রতিবেদনও জমা দিয়েছে। বর্তমান সরকার নির্বাচনে আগে সংস্কার করতে চায়। তবে, রাজনৈতিক দলগুলো সংস্কারের সঙ্গে সঙ্গে নির্বাচনও চায়। বিএনপি চলতি বছরের জুন-জুলাইয়ের মধ্যে নির্বাচন দেওয়ার কথা বলেছে। অন্যদিকে, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকে সংস্কারের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
সময় যতই যাচ্ছে নির্বাচনের বিষয়ে আলাপ-আলোচনা আরও বেশি তীব্র হচ্ছে। ইতোমধ্যে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর একটি গণমাধ্যমে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেছেন, অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার নিরপেক্ষতা বজায় রাখতে না পারলে নির্বাচন করতে পারবে না। তিনি বলেন, ‘নিরপেক্ষতার প্রশ্ন আসতে পারে। কেননা, এখানে আমরা জিনিসটা লক্ষ্য করছি যে, আপনার ছাত্ররা একটা রাজনৈতিক দল তৈরি করার কথা চিন্তা করছেন। সেখানে যদি ছাত্রদের প্রতিনিধি এ সরকারে থাকে, তাহলে তো নিরপেক্ষ থাকতে পারবে না। ওইটা হচ্ছে, সম্ভাব্য কথা। কিন্তু যদি তারা মনে করে যে, সরকারে থেকেই তারা নির্বাচন করবেন, তাহলে তো রাজনৈতিক দলগুলো মেনে নেবে না।’
বর্তমান সরকার নির্বাচনে আগে সংস্কার করতে চায়। তবে, রাজনৈতিক দলগুলো সংস্কারের সঙ্গে সঙ্গে নির্বাচনও চায়। বিএনপি চলতি বছরের জুন-জুলাইয়ের মধ্যে নির্বাচন দেওয়ার কথা বলেছে। অন্যদিকে, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকে সংস্কারের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে
মির্জা ফখরুল বলেন, ‘যদি অন্তর্বর্তী সরকার পূর্ণ নিরপেক্ষতা পালন করে, তাহলেই তারা নির্বাচন কন্ডাক্ট (পরিচালনা) করা পর্যন্ত থাকবে। তা না হলে তো নিরপেক্ষ সরকারের প্রয়োজন হবে।’
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলামের এমন মন্তব্যের কঠোর সমালোচনা করেন তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয় এবং ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম। নিজ ভেরিফায়েড ফেসবুক অ্যাকাউন্টে দেওয়া এক স্ট্যাটাসে তিনি উল্লেখ করেন, ‘বিএনপি মহাসচিবের নিরপেক্ষ সরকারের দাবি মূলত আরেকটা এক-এগারো সরকার গঠনের ইঙ্গিত বহন করে।’ বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম এ সমন্বয়ক বলেন, ‘বিএনপি মহাসচিবের বক্তব্যে সামনে আরেকটা এক-এগারো সরকার, সংসদীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতা ও নতজানু পররাষ্ট্রনীতির ধারাবাহিকতা এবং গুম-খুন ও জুলাই হত্যাকাণ্ডের বিচার না হওয়ার আলামত রয়েছে। এই এক-এগারোর বন্দোবস্ত থেকেই আওয়ামী ফ্যাসিজমের উত্থান ঘটেছিল।’
তিনি আরও বলেন, “ছাত্ররাই এই সরকারের এবং বিদ্যমান বাস্তবতার একমাত্র ফ্যাক্টর যেটা এক-এগারোর সরকার থেকে বর্তমান সরকারকে সম্পূর্ণভাবে আলাদা করে। বিএনপি কয়েকদিন আগে মাইনাস টু’র আলোচনা করলেও এখন ক্ষমতায় যাওয়ার পথ সুগম করার জন্য নিরপেক্ষ সরকারের নামে আরেকটি এক-এগারো সরকারের প্রস্তাবনা করছে। এ ধরনের পরিকল্পনা গণতন্ত্র ও জাতীয় স্বার্থের বিরুদ্ধে যাবে এবং ছাত্র-জনতা কোনোভাবেই এটা মেনে নেবে না। আমি মনে করি এটা বিএনপির বিরুদ্ধেও ষড়যন্ত্র।”
বিএনপি মহাসচিব ও বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সমন্বয়কের পাল্টাপাল্টি এমন মন্তব্য রাজনৈতিক মাঠে আবারও নিরপেক্ষ অর্থাৎ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিষয়টি সামনে এসেছে। শুধু বিএনপি নয়, এরই মধ্যে আওয়ামী লীগও বিষয়টি নিয়ে মুখ খুলেছে। আওয়ামী লীগের ফেসবুক পেজে গত শুক্রবার দেওয়া এক পোস্টে মোহাম্মদ আলী আরাফাতকে উদ্ধৃত করে বলা হয়, অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সরকার ‘অনির্বাচিত ও অসাংবিধানিক সরকার’। এই সরকারের অধীনে আগামী নির্বাচন হবে না এবং পরবর্তী নির্বাচন একটি নতুন (তত্ত্বাবধায়ক) সরকারের অধীনে হতে হবে।
বর্তমান সরকার চলতি বছরের শেষে কিংবা আগামী বছরের মাঝামাঝি সময়ে জাতীয় সংসদ নির্বাচন দেবে। আওয়ামী লীগ তো মাঠে নেই। দলকেও নিষিদ্ধ করা হয়নি। সেক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ কি নির্বাচনে অংশ নেবে, নিলে প্রক্রিয়াটি কী হবে? এমন প্রশ্নের জবাবে দলের সাংগঠনিক সম্পাদক শফিউল আলম চৌধুরী নাদেল ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘এই সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন হবে না। তারা (বর্তমান সরকার) সারাদেশে জনবিরোধী কার্যকলাপ শুরু করেছে। ভ্যাটের নামে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য বাড়িয়ে দিয়েছে। সারা দেশের সার্বিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ধ্বংস করে দিয়েছে। আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী ও সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতন চালিয়েছে। সর্বোপরি তারা (বর্তমান সরকার) দেশের সার্বভৌমত্বকে হুমকির মুখে ঠেলে দিয়েছে। আমরা বিশ্বাস করি, খুব অল্পদিনের মধ্যে জনগণই তাদের বিদায় করবে। তাদের বিদায়ের পর যে পরিস্থিতি তৈরি হবে তখন আমরা সিদ্ধান্ত নেব।’
তিনি আরও বলেন, ‘আওয়ামী লীগ একটি গণতান্ত্রিক দল, নির্বাচনমুখী দল। আমরা অবশ্যই নির্বাচন করব। পূর্বের মতো আমাদের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও গণতান্ত্রিক যে দলগুলো ছিল তাদেরকে নিয়ে জোটবদ্ধভাবে নির্বাচন করব।’
দলের প্রধান দেশে নেই। আপনারাও অনেকে দেশের বাহিরে অবস্থান করছেন, অনেকে গ্রেপ্তার। নির্বাচন করতে হলে রাজনীতির মাঠেও সক্রিয় হতে হবে। কিন্তু আপনারা তো মাঠে নেই— এমন প্রশ্নের জবাবে শফিউল আলম চৌধুরী নাদেল বলেন, তারা তো (অন্তর্বর্তী সরকার) সবসময় ক্ষমতায় থাকবে না। এক সময় নির্বাচন দিতেই হবে। আওয়ামী লীগের ওপর যে নির্যাতন হয়েছে, হামলা-মামলা হয়েছে, পরিকল্পিতভাবে মব কিলিং করা হয়েছে; আমরা আশা করছি দেশের জনগণই তাদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে যাবে। তাদেরকে রাষ্ট্রক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেবে। সেই অপেক্ষায় আছি আমরা। এ কারণে বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচনে যাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না।’
এদিকে, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক নাহিদ ইসলামের বক্তব্যের সমালোচনা করে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, ‘রাজনীতিবিদরা কোন বিষয়ে কথা বলবেন, কোনটাকে সমর্থন করবেন আর কোনটাকে করবেন না— এটা কি উপদেষ্টারা শেখাবেন?’ বিএনপির সিনিয়র এ নেতা বলেন, ‘নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম কেজিপ্রতি দুই থেকে ১০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে সরকারের এমন উদাসীনতার কি সমালোচনা করা যাবে না? সরকারের প্রশাসন যদি নিরপেক্ষভাবে কাজ না করে সেজন্য কি সমালোচনা করা যাবে না? তাহলে কীসের ভয় দেখান যে ১/১১-এর পুনরাবৃত্তি হবে।’
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস বলেন, ‘কেউ কেউ বলছেন, বিএনপি আবারও ১/১১ (ওয়ান-ইলেভেন) আনার পাঁয়তারা করছে। ১/১১-এর ভয়াবহ পরিণতির শিকার বিএনপির চেয়ে কেউ বেশি হয়নি। বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া থেকে শুরু করে ওই সরকারের নির্যাতন থেকে দলের কোনো নেতাকর্মীই রেহাই পাননি। এভাবে কথা বললে দেশের গণতন্ত্রের চেহারা কেউ দেখতে পারবেন না।’
“একটি দল ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য পাগল হয়ে গেছে। ‘গাছে কাঁঠাল গোঁফে তেল’— তারা তো এখন বিএনপির বিরুদ্ধেই কথা বলছে। শিশুদের যখন নতুন দাঁত ওঠে তখন উল্টাপাল্টা কথা বলে। এখন কেউ কেউ এমনভাবে কথা বলছেন যে, বিএনপি আওয়ামী লীগের দোসর, বিএনপি ভারতের দোসর। যারা এগুলো বলছেন, তারা যেন নিজেদের চেহারা আয়নায় দেখেন।”
অন্যদিকে, ‘আগে সংস্কার পরে নির্বাচন’— ৫ আগস্টের পর থেকে এমন দাবি জানিয়ে আসছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। দলটির আমির ডা. শফিকুর রহমান বিভিন্ন সময় এমন দাবি উপস্থাপন করেন। সম্প্রতি কুমিল্লার দাউদকান্দিতে অনুষ্ঠিত দলটির কর্মী সম্মেলনে কেন্দ্রীয় সিনিয়র নায়েবে আমির ও সাবেক এমপি অধ্যাপক মুজিবুর রহমান বলেন, ‘আগে সংস্কার পরে নির্বাচন। স্বাধীনতার দীর্ঘ সময় চলে গেছে, জনগণ ভোটের অধিকার পায়নি। দেশে কেয়ারটেকার সরকার ছিল। দুবার নির্বাচন হয়েছিল। কিন্তু তারা কেয়ারটেকার সরকারকেও সংবিধান থেকে বাদ দিয়েছে। যারা জাতীয়ভাবে ভোট চুরি করতে পারে, তারা মানুষের জান, মাল, সম্পদ লুট করতে পারে; সেই খুনি-ডাকাতদের হাতে রাষ্ট্র তুলে দেওয়া যাবে না।’
নির্বাচন প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ বিষয়ক সম্পাদক আমিনুল ইসলাম আমিন বলেন, ‘আমরা সবসময় নির্বাচনমুখী দল। নির্বাচনের চ্যালেঞ্জ যেকোনো মুহূর্তে গ্রহণ করতে প্রস্তুত। কিন্তু বর্তমান সরকারের কর্মসূচি বা পরিকল্পনায় নির্বাচন নামে কিছু নেই। তাদের পরিকল্পনায় আছে ৭২-এর সংবিধানকে কবর দেওয়া, মুক্তিযুদ্ধকে মুছে ফেলা, আওয়ামী লীগকে হত্যা করা। তাদের পরিকল্পনায় নির্বাচন কোথায়? আমরা তো দেখছি না।’