ছোটবেলায় হ্যাংলা-পাতলা ছিলেন বেগম খালেদা জিয়া। মাছ মোটেও খেতে চাইতেন না, পছন্দ করতেন মাংস। তরকারির মধ্যে আলু আর ঢেড়শ। গান গাইতেন, নাচেও জিতেছেন পুরস্কার। বাংলাদেশের ৩ বারের প্রধানমন্ত্রী বাল্যকালে কেমন ছিল চলুন জানা যাক।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষ বছর—১৯৪৫। বিশ্বজুড়ে যুদ্ধের ভয়াবহতা তখনও থামেনি পুরোপুরি। জাপানি বাহিনী মিয়ানমারের সীমানা ঘেঁষে চলে এসেছে। সুভাষচন্দ্র বসুর নেতৃত্বে আজাদ হিন্দ ফৌজ পৌঁছে গেছে আসামে। এমনই অস্থির এক সময় বাংলাদেশের উত্তরবঙ্গের ছায়াঘেরা শহর— দিনাজপুরে জন্ম নেন ভবিষ্যতের জাতীয় নেতা ও প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া।
সাংবাদিক মাহফুজ উল্লাহ বেগম জিয়ার জীবনীগ্রন্থ ‘বেগম খালেদা জিয়া: জীবন ও সংগ্রাম’–এ লিখেছেন, “বেগম জিয়া ১৯৪৫ সালের ১৫ আগস্ট জন্মগ্রহণ করেন।”
তিনি আরও বলেছেন, “ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের মাধ্যমে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হওয়ার পর ১৯৯১ সালের ১৯ মার্চ সংবাদমাধ্যমে খালেদা জিয়ার প্রকৃত জন্ম তারিখ ১৫ আগস্ট বলে প্রকাশিত হয়। সেই সময় জন্ম তারিখ নিয়ে প্রশ্ন ওঠেনি।”
শিশুটি ছিল অপার সুন্দর। যেন পুতুল! পরিবারের ডাক্তার অবনী গোস্বামী পরামর্শ দিয়েছিলেন নবজাতকের নাম রাখা হোক “শান্তি”। তিনি বলেছিলেন, যুদ্ধের এত ধ্বংসের মাঝে এই শিশুর জন্ম মানুষকে শান্তির বার্তা দিক।
কিন্তু পরিবারের কাছে সে ছিল অন্যরকম। মাহফুজ উল্লাহ লিখেছেন, “শিশুটি পুতুলের মতো কমনীয় ও সুন্দর হওয়ায় সবাই তাকে ‘পুতুল’ নামে ডাকতে পছন্দ করতেন। নামটি তার বড় বোন সালিমা আক্তার বিউটির দেওয়া।”
মাসিক ম্যাগাজিন ‘নিপুণ’-এর প্রধান সম্পাদক মোস্তাফা জব্বার খালেদা জিয়ার বাবা এস্কান্দার মজুমদার এবং মা তৈয়বা মজুমদারের সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন। ‘নিপুণ’-এর ১৯৮৪ সালের মে সংখ্যায় সাক্ষাৎকারটি ছাপা হয়েছিলো। সাক্ষাৎকারে এস্কান্দার মজুমদার বলেছিলেন, “খালেদা ছিল সবার আদরের। দেখতে শুনতেও সবার চেয়ে ভালো ছিল। সেজন্য আমরা পুতুল বলেই ডাকতাম।”
এছাড়াও পরিবারে তার ছিল আরও একটি আদরের নাম—“টিপসি”। মাহফুজ উল্লাহ উল্লেখ করেছেন, “তার বড় বোন খুরশিদ জাহান চকলেট তাকে ‘টিপসি’ বলে ডাকতেন, যদিও পরে এ নামে কেউ আর তাকে ডাকতেন না।”
এভাবেই ‘শান্তি’, ‘পুতুল’ এবং ‘টিপসি’— এই তিন নামেই বেড়ে ওঠেন ভবিষ্যতের দেশনেত্রী। তবে তার বাবা-মা আনুষ্ঠানিকভাবে তার নাম রেখেছিলেন খালেদা খানম। পরে জিয়াউর রহমানের সঙ্গে বিয়ের পর এটি হয়ে ওঠে— বেগম খালেদা জিয়া।
শৈশবে খালেদা জিয়া ছিলেন প্রাণবন্ত, উচ্ছল, আর নিজের জগতে মগ্ন। মাহফুজ উল্লাহর বইতে পাওয়া যায়, তিনি ৫ বছর বয়সে তিনি ভর্তি হন সেন্ট জোসেফ কনভেন্ট স্কুলে।
সেখানে গ্রেড ফোর পর্যন্ত পড়েন। ১৯৬০ সালে দিনাজপুর সরকারি স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করেন এবং সুরেন্দ্রনাথ কলেজে ভর্তি হন। ১৯৬৩ সালে ইন্টারমিডিয়েট পাস করেন। পড়াশোনা, খেলাধুলা, নাচ— সব জায়গাতেই ছিল তার উজ্জ্বল উপস্থিতি।
খালেদা সবসময় স্কুলের বিভিন্ন ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় পারদর্শিতা প্রদর্শন করতেন। আরবি শেখার জন্য বাসায় একজন গৃহশিক্ষকও ছিল। তার বাবা আশেপাশে কোথাও না থাকলে তিনি বোনদের সঙ্গে সিনেমা দেখতে যেতেন।
খালেদার জিয়ার চুল অনেক লম্বা ছিল। “গোসল করার পর চুল শুকানো তার পক্ষে কঠিন হয়ে যেত। হেয়ার ড্রায়ার ছিল না। বাইরে কোথাও যেতে হলে মা তার চুল বেঁধে দিতেন।” লিখেছেন মাহফুজ উল্লাহ।
পুতুল ভালোবাসতেন ফুল। আর ভালোবাসতেন শিল্পচর্চা—বিশেষ করে নাচ। মাহফুজ উল্লাহর ভাষায়,
পুতুল তার চাচাতো বোন নার্গিসের সঙ্গে স্কুলে নাচ শিখতেন। দিনাজপুরের বাইরেও অনেক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করতেন। তার মা নাচ শেখার জন্য গৃহশিক্ষকও নিয়োগ করেছিলেন।
তার বোনদের সঙ্গে সম্পর্কও ছিল গভীর। “বিউটির সঙ্গে ছিল বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক। একই বিছানায় ঘুমাতেন। তিন বোনের মধ্যে পুতুলই ছিলেন সেরা রাঁধুনি।”
চকলেট ছিল তার খুব প্রিয় এবং আজীবন তিনি ভালো মানের চকলেটের অনুরাগী ছিলেন।
তার মা তৈয়বা মজুমদার স্মৃতিচারণ করে বলেন,
ছোটবেলা থেকেই হালকা-পাতলা ছিলো খালেদা। মাছ একেবারেই খেত না। মাংস ছিলো খুব প্রিয়… ভালো খাবারদাবারের প্রতি ঝোক ছিলো।
এছাড়াও তিনি যোগ করেছিলেন, “তরকারির মধ্যে আলু আর ঢেড়শ বেশি পছন্দ করতেন। খুব গোছানো ও পরিষ্কার থাকতে ভালোবাসতো। নিজ হাতে ঘর গোছাতো। ছোট দুই ভাইকেও নাওয়া-খাওয়া করাতো।”
আরও বলেন, “অন্যের কাজ পছন্দ হতো না… বায়না ধরত না… অপচয় পছন্দ করতো না। তবে পড়াশুনায় ভালো ছিল। নাচ শিখেছে ওস্তাদের কাছে। অনেক ফাংশনে নেচে পুরস্কার পেয়েছে।”