Image description

ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে প্রার্থী চূড়ান্ত তথা আসন সমঝোতা নিয়ে দফায় দফায় বৈঠক আর নিজেদের মধ্যে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছেন জামায়াতে ইসলামীসহ সমমনা আট দলের নেতারা। তবে কয়েকটি দলের প্রত্যাশা বেশি হওয়ায় চূড়ান্ত পর্যায়ে গিয়েও আসন সমঝোতার বিষয়টি এখনো ঝুলে রয়েছে। সবমিলিয়ে প্রায় ১৫০টির মতো আসনে সমঝোতার জন্য জামায়াতে ইসলামীকে প্রস্তাব দিয়েছে সমমনা অন্য দলগুলো। তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি আসনে সমঝোতা চায় ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ এবং বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস। জামায়াতসহ কয়েকটি দলের নেতারা জানান, আসন সমঝোতার বিষয়ে তারা আলোচনা অব্যাহত রেখেছেন, যা এখন চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। আজ শনিবার রাতে দলগুলোর শীর্ষ নেতাদের বৈঠক ডাকা হয়েছে। আজকের বৈঠকে না হলেও দুই-এক দিনের মধ্যেই আসনের সমঝোতা বিষয়টি চূড়ান্ত করা হবে। এরপর আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করা হবে।

ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনে জয় পেতে বহুমুখী তৎপরতা চালাচ্ছে জামায়াতে ইসলামীসহ সমমনা আটটি দল। যার মধ্যে প্রায় সব দলই এরই মধ্যে পৃথকভাবে সংসদ সদস্য (এমপি) প্রার্থী ঘোষণাও করেছে। তবে দলগুলোর মাঝে নির্বাচন নিয়ে আসন সমঝোতা হলে তারা প্রার্থী প্রত্যাহার করবেন। এককথায় নির্বাচন নিয়ে বিভিন্ন কৌশল নির্ধারণ ও আসন সমঝোতা চূড়ান্তকরণে দফায় দফায় বৈঠক করছেন আট দলের লিয়াজোঁ কমিটির নেতারা। এরই মধ্যে একক প্রার্থী ঘোষণার লক্ষ্যে আসন সমঝোতা নিয়ে কয়েক দফা আলোচনা করেছে দলগুলো। প্রথমে জামায়াতে ইসলামী সমমনা অন্য দলগুলোর প্রতিনিধির সঙ্গে পৃথকভাবে এবং পর্যায়ক্রমে অন্য দলের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে। সব দল নিয়ে একসঙ্গে বসে আসন ভাগাভাগির বিষয়ে শিগগির সমঝোতা হবে। মুখ্য উদ্দেশ্য হচ্ছে—‘ওয়ান বক্স পলিসি’, তথা একটি বাক্সে ইসলামী দলের সব ভোট পড়া নিশ্চিত এবং আট দল মনোনীত প্রার্থীকে সর্বাত্মকভাবে বিজয়ী করা।

জানা গেছে, গত ৯ ডিসেম্বর থেকে আসন সমঝোতা নিয়ে আনুষ্ঠানিক আলোচনা শুরু হয়েছে। তবে তা এখনো চূড়ান্ত হয়নি। শিগগির প্রত্যেক আসনের বিপরীতে একক প্রার্থীর নাম ঘোষণা করা হবে। তবে শতাধিক আসনে সমমনা দলগুলোর চাহিদার কথা জানিয়ে জামায়াতে ইসলামীর কাছে প্রস্তাব এসেছে। তার মধ্যে মাওলানা মামুনুল হকের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের রিকশা প্রতীকে কমপক্ষে ৩৫টি আসনে নির্বাচন করার মতো শক্ত প্রার্থী আছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে।

গত সেপ্টেম্বর থেকে অভিন্ন কয়েকটি দাবিতে যুগপতভাবে আন্দোলন শুরু করে জামায়াতে ইসলামীসহ সমমনা ৮টি দল। জামায়াত ছাড়াও অন্য দলগুলোর মধ্যে রয়েছে—ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, বাংলাদেশ নেজামে ইসলাম পার্টি, বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন, জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টি (জাগপা), বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট পার্টি, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস এবং খেলাফত মজলিস। এসব দলের দাবি হলো- অবিলম্বে জুলাই সনদের বাস্তবায়ন, সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতিতে (পিআর) জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠান, নির্বাচনের জন্য লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড (সবার জন্য সমান সুযোগ) তৈরি এবং ফ্যাসিবাদের দোসর হিসেবে জাতীয় পার্টি (জাপা) ও ১৪ দলের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করা। এসব দাবিতে এরই মধ্যে কয়েক দফায় কর্মসূচি পালন করেছে দলগুলো। সর্বশেষ নভেম্বরে বিভাগীয় পর্যায়ে সমাবেশ করেছে সমমনা ৮টি দল। এখন আবারও জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নে অনুষ্ঠিতব্য গণভোটে ‘হ্যাঁ’-এর পক্ষে জনমত গঠনের লক্ষ্যে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত নতুন কর্মসূচি পালন করছে দলগুলো।

খুব দ্রুতই আসন সমঝোতা: জানতে চাইলে জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল ও ৮ দলের লিয়াজোঁ কমিটির সমন্বয়ক ড. হামিদুর রহমান আজাদ গতকাল কালবেলাকে বলেন, ৮ দলের কার্যক্রম কোনো নির্বাচনী জোট নয়। দলগুলোর মাঝে আসন সমঝোতার বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন।

কোন দল কয়টি আসনে সমঝোতার প্রস্তাব দিয়েছে—এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘প্রস্তাব যে কেউ দিতেই পারেন। সেটি তাদের অধিকার। আমরা সবার সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে আসন সমঝোতার বিষয়টি চূড়ান্ত করব।’

এনসিপির সঙ্গে জোট করা প্রসঙ্গে হামিদুর রহমান আজাদ বলেন, ‘শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে একাধিক বৈঠক হয়েছে। এখনো আলোচনা চলমান। আমরা ওয়ানবক্স পলিসি নিয়ে কাজ করছি। অর্থাৎ এক আসনে সব দলের পক্ষে একজন প্রার্থী থাকবে, যা সমঝোতার ভিত্তিতে নির্ধারণ হবে। খুব দ্রুত সময়ের মধ্যে আমরা সমঝোতার বিষয়টি শেষ করব ইনশাআল্লাহ।’

এ বিষয়ে বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা আতাউল্লাহ আমিন গতকাল কালবেলাকে বলেন, ‘ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা ও ফরিদপুরসহ কয়েকটি জেলায় অন্তত ৩৫টি আসনে আমাদের শক্ত প্রার্থী রয়েছে। আমরা আশা করছি সব দলের সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে খুব দ্রুত সময়ের মধ্যেই আসন সমঝোতার বিষয়টি সমঝোতা হবে ইনশাআল্লাহ।’

ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের দায়িত্বশীল এক নেতা গতকাল জানান, তারা ৮০/১০০টি আসনে সমঝোতার জন্য আলোচনা উত্থাপন করেন। এসব আসনে তাদের ভালো প্রার্থী রয়েছে। তবে সব দলের সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে খুব শিগগির সমঝোতার বিষয়টির নিষ্পত্তি হবে।

খেলাফত মজলিসের একজন যুগ্ম মহাসচিব কালবেলাকে বলেন, তারা কমপক্ষে ১০টি আসনে নির্বাচনের জন্য সমঝোতা চান। এ বিষয়ে আলোচনা অব্যাহত রয়েছে। খুব শিগগির আলোচনার মাধ্যমে আসন সমঝোতা চূড়ান্ত হবে। তবে তিনি এটাও বলেন যে, জামায়াতে ইসলামী একটি বড় ইসলামী রাজনৈতিক দল। ফলে তাদের সক্ষমতাও বেশি। এখন দেখা যাক শেষ পর্যন্ত কী হয়।

জানতে চাইলে জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা আব্দুল হালিম কালবেলাকে বলেন, তারা এখনো আসন সমঝোতার বিষয়ে নতুনভাবে কোনো সিদ্ধান্ত নেননি। তবে দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা অব্যাহত রয়েছে। আরও নতুন দল তাদের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে। এ জন্য নতুনভাবে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিতে হচ্ছে। তারা দ্রুত সময়ের মধ্যেই আসন সমঝোতার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি সুরাহা করতে চান।

৮ দলের সঙ্গী হচ্ছে এবি পার্টি: খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জামায়াতে ইসলামী নেতৃত্বাধীন ৮টি দলের প্ল্যাটফর্মে নতুনভাবে যুক্ত হচ্ছে এবি পার্টি। দলটির শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে জামায়াতে ইসলামীর দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতাদের একাধিক বৈঠক হয়েছে। আলোচনা এখনো চলমান রয়েছে। আসন সমঝোতার ভিত্তিতে দলটি ৮ দলের প্ল্যাটফর্মে যুক্ত হবে।

এবি পার্টির একজন কেন্দ্রীয় নেতা জানান, তারা ৮টি দলের নির্বাচনী প্ল্যাটফর্মে যুক্ত হতে চান। জামায়াতে ইসলামী দীর্ঘদিন ধরে তাদের একসঙ্গে কাজ করার জন্য বলে আসছিল। এখন তারা নির্দিষ্ট আসনে নির্বাচনের বিষয়ে সমঝোতার জন্য আলোচনা করছেন। বিষয়টি সুরাহা হলে খুব শিগগির আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা দেওয়া হবে।

সমঝোতায় যাচ্ছে না রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন : রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের সভাপতি হাসনাত কাইয়ূম গতকাল তোপখানা রোডে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, আওয়ামী জুলুমের বিপরীতে বাংলাদেশ রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন যখন গণতন্ত্র মঞ্চ তৈরি করে, তখন সেই মঞ্চ যাতে তার নিজস্ব রাজনীতি নিয়েই এগোয় সে বিষয়ে মঞ্চের ভেতরে এবং বাইরে নিরন্তর কাজ করে এসেছিল। যখন পরিষ্কার হয়ে ওঠে মঞ্চের শরিকদের অনেকেই বড় দলের রাজনীতিকে সমর্থনের পথে হাঁটছেন, তখন তার চেষ্টা বিফল হয়েছে বলেই ধরে নিয়ে তারা মঞ্চ থেকে বেরিয়ে আসেন। রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন মনে করে যে, ঐকমত্য কমিশনে বিএনপি তার নোট অফ ডিসেন্টের অতিব্যবহার সংস্কার প্রক্রিয়াকে ভয়ানক ক্ষতিগ্রস্ত করে। একই সময় জামায়াতে ইসলামী সংস্কার প্রক্রিয়াকে তার নিজস্ব রাজনৈতিক ফায়দার জন্য ব্যবহার করে নিজেদের বাংলাদেশের স্বার্থের পক্ষের শক্তি হিসেবে প্রমাণ করতে ব্যর্থ হয়।

তিনি বলেন, বাংলাদেশের অসংখ্য শান্তিকামী নাগরিক দুই মেরুর বাইরে একটা পছন্দের রাজনীতির পক্ষে ভোট দিতে আগ্রহী। সেই লক্ষ্যেই ‘গণতান্ত্রিক সংস্কার জোট’-এর অভ্যুদয়। জোটের নামে গণতান্ত্রিক এবং সংস্কার রাখার মাধ্যমে পরিষ্কার করা ছিল যে, এই জোট অগণতান্ত্রিক জামায়াতে ইসলামী এবং সংস্কারবিরোধী বিএনপির বাইরের একটা পক্ষ।

হাসনাত কাইয়ুম বলেন, পরিতাপের বিষয় হচ্ছে যে, গণতান্ত্রিক সংস্কার জোটের দুই দল এনসিপি ও এবি পার্টি জোটের সমঝোতা ভঙ্গ করে বিএনপি ও জামায়াত জোটের সঙ্গে নির্বাচনী আসন ভাগাভাগির আলোচনা করছেন বলে সংবাদমাধ্যমে এসেছে। এ সংবাদের পরিপ্রেক্ষিতে রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন মনে করছে যে, এই জোট যে বিএনপি বা জামায়াত কোনো দিকেই ভেড়ার বিরুদ্ধে, সেটা সবার কাছে পরিষ্কার করা। জোটসঙ্গী হিসেবে এ উদ্যোগ নেওয়ার আগে রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনকে আনুষ্ঠানিকভাবে জানানোর রাজনৈতিক শিষ্টাচার করতেও জোটের বাকি দুই দল ব্যর্থ হয়েছে।