Image description

আসন্ন সংসদ নির্বাচনে যুগপৎ আন্দোলনের মিত্র জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশকে চারটি আসনে ছাড় দিয়েছে বিএনপি। তবে এসব আসনে বিএনপির স্থানীয় নেতারা স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। বিএনপি শেষ পর্যন্ত তাদের সামলাতে না পারলে জমিয়তকে মূল্য দিতে হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

গতকাল মঙ্গলবার সংবাদ সম্মেলনে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর জমিয়তকে সিলেট-৫, ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২, নীলফামারী-১ ও নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনে ছাড় দেওয়ার কথা জানান। দলীয় নেতাদের সতর্ক করে তিনি বলেন, ‘এসব আসনে বিএনপির কেউ বিদ্রোহী প্রার্থী হলে দল তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে।’

জমিয়তকে ছেড়ে দেওয়া চারটি আসনে দীর্ঘদিন কাজ করা বিএনপি নেতারা স্ট্রিমকে জানিয়েছেন, তারা স্বতন্ত্র নির্বাচন করবেন। দল ব্যবস্থা নিলেও ফেরার সুযোগ নেই। কারণ কর্মী ও দলকে রক্ষা করতে হবে। ইতোমধ্যে কেউ কেউ মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করেছেন।

বিএনপির ‘বিদ্রোহী’ প্রার্থীদের বিষয়ে জমিয়তের মহাসচিব মঞ্জুরুল ইসলাম আফেন্দী স্ট্রিমকে বলেছেন, এটা অবশ্যই বড় চ্যালেঞ্জ। ইনশা আল্লাহ আমরা তা উতরে যেতে পারব, এই আত্মবিশ্বাস রয়েছে। বিএনপিও দলের বিদ্রোহ প্রশমনে আন্তরিক এবং প্রয়োজনে কঠোর অবস্থানের ব্যাপারে আশ্বস্ত করেছে।

তিনি বলেন, বিএনপি সাংগঠনিক ব্যবস্থা নিলেও যে কারও স্বতন্ত্র নির্বাচন করার সাংবিধানিক অধিকার রয়েছে। আমরা তাদের বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করব। আমি মনে করি, নির্বাচনের অঙ্গন কুসুমাস্তীর্ণ নয়, সব সময় কণ্টকাকীর্ণ হয়। বাধা-প্রতিবন্ধকতা বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে মোকাবেলা করতে হবে।

বিএনপি ব্যবস্থা নিলেও সিলেট-৫ আসনে নির্বাচনী লড়াই থেকে সরবেন না মামুনুর রশিদ। ছবি সংগৃহীত
বিএনপি ব্যবস্থা নিলেও সিলেট-৫ আসনে নির্বাচনী লড়াই থেকে সরবেন না মামুনুর রশিদ। ছবি সংগৃহীত

ফারুককে হারাতে শাস্তি দিলেও লড়বেন মামুন

বিএনপির সঙ্গে সমঝোতায় সিলেট-৫ (কানাইঘাট-জকিগঞ্জ) আসনে জমিয়তের সভাপতি মাওলানা উবায়দুল্লাহ ফারুক প্রার্থী হয়েছেন। এখানে স্বতন্ত্র হলেও নির্বাচন করবেন বলে জানিয়েছেন জেলা বিএনপির সহসভাপতি মামুনুর রশিদ (চাকসু মামুন)। স্ট্রিমকে তিনি বলেন, ‘দীর্ঘদিন নির্বাচনী প্রচারে রয়েছি। বৃহস্পতিবার মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেছি। আমি এলাকায় ২৫ বছর রাজনীতি করছি। ২০০৮ ও ২০১৮ সালে প্রার্থী হয়েছি। এবারের জন্য অনেক আগেই ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ডেকে নিয়ে সবুজসংকেত দিয়েছেন। এখন হঠাৎ করে জমিয়তে উলামায়ে ইসলামকে দেওয়া হলো। আমি নির্বাচন করব। এটাই ফাইনাল। শাস্তি হিসেবে বিএনপি কোনো সিদ্ধান্ত নিলেও আমাকে থামাতে পারবে না।’

সিলেট-৫ আসনে চারবার আওয়ামী লীগ, তিনবার জাতীয় পার্টি এবং দুবার স্বতন্ত্র প্রার্থী বিজয়ী হয়েছেন। বিএনপি, ইসলামী ঐক্যজোট ও জামায়াতে ইসলামীর প্রার্থী একবার করে জয়ী হয়েছেন। সবশেষ ২০১৮ সালে জমিয়তকে ছেড়ে দিলে সরে দাঁড়িয়েছিলেন মামুনুর রশিদ।

হাবিবকে ছাড় দেবেন না রুমিন ফারহানা

ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ (সরাইল-আশুগঞ্জ) আসনে জমিয়ত ছাড় পেয়েছে। এখানে দলটির সহসভাপতি মাওলানা জুনায়েদ আল হাবিব প্রার্থী হচ্ছেন। তিনি হেফাজতের ঢাকা মহানগর সভাপতি। কিন্তু হাবিবকে আসনটি ছাড়তে রাজি নন বিএনপির আন্তর্জাতিকবিষয়ক সহসম্পাদক ও সাবেক সংসদ সদস্য ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানা। স্ট্রিমকে রুমিন ফারহানা বলেছেন, ‘আমি আমার সিদ্ধান্তে অনড়। স্বতন্ত্র হলেও নির্বাচন কবর। দল ব্যবস্থা নেওয়ার মনে করলে নেবে। আমি তো বাধা দিতে পারব না।’ আজ বুধবার (২৪ ডিসেম্বর) এই আসনে তাঁর পক্ষে মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করা হয়েছে।

রুমিন ফারহানার বাবা অলি আহাদ ছিলেন প্রথিতযশা রাজনীতিক। তিনিও দলের সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে স্বতন্ত্র হিসেবে এই আসনে বিজয়ী হয়েছিলেন। অতীতে এখানে ধানের শীষ প্রতীকের প্রার্থীরা সাতটি নির্বাচনে অংশ নিয়ে ছয়বার বিজয়ী হয়েছেন। এ ছাড়া লাঙ্গল তিনবার, নৌকা একবার এবং স্বতন্ত্র প্রার্থী দুবার জয়ী হয়েছেন।

এই আসনে বিএনপির মনোনয়নপ্রত্যাশী ছিলেন রুমিন ফারহানাসহ চার নেতা। অন্যরা কিছুটা গা ছাড়া ভাব দেখালেও রুমিন ফারহানা নিয়মিত এলাকায় গণসংযোগ ও সামাজিক কর্মসূচি করেছেন। জামায়াতসহ ৮ দলের প্রার্থীরাও এই আসনে বেশ আগে থেকে সক্রিয়। বিশেষ করে জামায়াতে ইসলামীর প্রার্থী মোবারক হোসেন এবং ইসলামী আন্দোলনের প্রার্থী নেছার আহমাদ আন নাছিরী জোর প্রচার চালিয়ে যাচ্ছেন।

জমিয়ত মহাসচিবের গলার কাটা খালেদা জিয়ার ভাগনে

বিএনপির ছেড়ে দেওয়া নীলফামারী-১ (ডোমার ও ডিমলা) আসনে জমিয়তের প্রার্থী দলের মহাসচিব মঞ্জুরুল ইসলাম আফেন্দী। কিছুদিন ধরে এলাকায় তিনি গণসংযোগ চালিয়ে যাচ্ছেন। তবে এখানেও জমিয়তকে ছাড় দিতে রাজি নয় তৃণমূল বিএনপি। বুধবার (২৪ ডিসেম্বর) স্থানীয় নেতা-কর্মীরা মনোনয়নের সিদ্ধান্ত বাতিলের দাবিতে বিক্ষোভ করেছেন।

এই আসনে ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন শাহরিন ইসলাম চৌধুরী তুহিন। সম্পর্কে তিনি বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার ভাগনে। মাত্র ১১ দিন স্থায়ী ওই সংসদ বাতিল হওয়ার পরে ১২ জুন এবং ২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপির মনোনয়ন পেলেও তিনি বিজয়ী হতে পারেননি।

মনোনয়নের সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের দাবিতে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার ভাগনের পক্ষে বিক্ষোভ। স্ট্রিম ছবি
মনোনয়নের সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের দাবিতে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার ভাগনের পক্ষে বিক্ষোভ।ছবি সংগৃহীত

এই সময়ে জয়ী হয়েছে জাতীয় পার্টি ও আওয়ামী লীগের প্রার্থী। তবে জুলাই অভ্যুত্থানের পরিবর্তিত রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বদলে গেছে সমীকরণ। বর্তমানে বিএনপি ও জামায়াতের ভোটশক্তি কার্যত সমানে সমান। বিএনপির প্রার্থী হিসেবে সাক্ষাৎকারও দিয়েছিলেন শাহরিন ইসলাম চৌধুরী। তিনি দীর্ঘদিন যুক্তরাষ্ট্রে থাকলেও গত মে মাসে নিজ জেলায় ফিরেছেন।

একাধিকবার যোগাযোগ করেও শাহরিন ইসলাম চৌধুরী তুহিনের বক্তব্য পায়নি স্ট্রিম। তবে তাঁর অনুসারীরা জানিয়েছেন, তারা যে কোনো উপায়ে বিএনপির প্রার্থী হিসেবে শাহরিন ইসলামকে চান।

ডিমলা উপজেলা শাখা ছাত্রদলের সদস্যসচিব হালিমুল রাসেল স্ট্রিমকে বলেছেন, আমাদের ভাগ্যের উন্নয়ন ও তুহিন ভাই একই সূত্রে গাঁথা। জমিয়তকে বেছে নেওয়া বিএনপির আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান দেশে আসার পরে আমরা সিদ্ধান্ত বদলের দাবি নিয়ে তাঁর কাছে যাব।

মনির কাসেমীর বিপক্ষে একাট্টা সবাই

শিল্প অধ্যুষিত ফতুল্লা থানা এলাকা নিয়ে গঠিত নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনে চারবার সংসদ সদস্য ছিলেন আওয়ামী লীগের বিতর্কিত নেতা শামীম ওসমান। এখানে বিএনপি ছাড় দেওয়ায় জমিয়ত দলের যুগ্ম মহাসচিব মনির হোসাইন কাসেমীকে প্রার্থী করেছে।

মনির নারায়ণগঞ্জ জেলা হেফাজতে ইসলামের আমির। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তাঁকে এ আসন ছেড়ে দিয়েছিল বিএনপি। এখানে সক্রিয় রয়েছেন বিএনপির সাবেক সংসদ সদস্য বীর মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ আলী, দলের নির্বাহী কমিটির সদস্য ও জেলা বিএনপির সাবেক সহসভাপতি মোহাম্মদ শাহ আলম, জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক মাশুকুল ইসলাম রাজীব, ফতুল্লা থানা বিএনপির সভাপতি শহীদুল ইসলাম টিটু, জেলা যুবদলের আহ্বায়ক সাদেকুর রহমান ও সদস্যসচিব মশিউর রহমান রনি।

২০০৮ সালে ধানের শীষের প্রার্থী হয়ে আওয়ামী লীগের চিত্রনায়িকা সারাহ বেগম কবরীর কাছে পরাজিত হন শাহ আলম। ২০১৮ সালে তিনি মনোনয়ন পেলেও পরে আসনটি শরিকদের ছেড়ে দেওয়া হয়।

জমিয়তের প্রার্থী মনির হোসাইন কাসেমীকে চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছেন জেলা বিএনপির সাবেক সহসভাপতি মোহাম্মদ শাহ আলম। ছবি সংগৃহীত
জমিয়তের প্রার্থী মনির হোসাইন কাসেমীকে চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছেন জেলা বিএনপির সাবেক সহসভাপতি মোহাম্মদ শাহ আলম। ছবি সংগৃহীত

শাহ আলম মনোনয়ন ফরম তুলেছেন তিনি এবং নেতাকর্মী চাইলে স্বতন্ত্র নির্বাচন করবেন জানিয়ে স্ট্রিমকে বলেন, 'আমি ধানের শীষের বিপক্ষে নির্বাচন করব না, খেজুর গাছের বিপক্ষে অবশ্যই লড়ব।'

মনোনয়নপত্র তুলেছেন ১৯৯৬ সালে বিএনপি থেকে নির্বাচিত মোহাম্মদ আলীও। দলের সিদ্ধান্তকে সমর্থন দিয়ে শেষ পর্যন্ত সরে যাবেন কিনা প্রশ্নে মন্তব্য করতে রাজি হননি তিনি।