ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে ‘আসন সমঝোতা’ নিয়ে শরিকদের সঙ্গে এরই মধ্যে ‘আনুষ্ঠানিক’ আলোচনা শেষ করেছে বিএনপি। আজ-কালের মধ্যে অথবা বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান আগামী ২৫ ডিসেম্বর দেশে ফেরার পরই মিত্রদের কে কোন আসনে নির্বাচন করবেন, তা ঘোষণা করা হবে। তবে সংশোধিত আরপিও এবং প্রতিদ্বন্দ্বী দলের প্রার্থী বিবেচনায় নির্বাচনে শরিকদের ‘বিজয় নিশ্চিতে’ বিশেষ কৌশল গ্রহণ করেছে বিএনপি। এর অংশ হিসেবে ফ্যাসিবাদবিরোধী যুগপৎ আন্দোলনের ‘অনিবন্ধিত’ মিত্র দল ও জোটের শীর্ষ নেতা, যাদের বিএনপি মনোনয়ন দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তাদের দলে যোগদান করিয়ে ‘ধানের শীষ’ নিশ্চিত করা হচ্ছে।
সে অনুযায়ী এরই মধ্যে যুগপৎ আন্দোলনের শরিকদের মধ্যে অন্তত দুটি দল বিএনপিতে যোগদান করে নিজেদের মনোনয়ন নিশ্চিত করেছে। ‘অনিবন্ধিত’ দলগুলোর আরও দু-একজন শীর্ষ নেতার আসন নিশ্চিত করার ব্যাপারেও আলোচনা চলছে। অন্যদিকে, নিবন্ধিত দলগুলোর শীর্ষ নেতারা, যাদের ‘জাতীয় পর্যায়ে পরিচিতি’ রয়েছে, তাদের আসনও অনেকটাই নিশ্চিত। দলীয় সাংগঠনিক ভিত্তি মজবুত না হলেও জোটের ঐক্যের স্বার্থে তাদের এরই মধ্যে আশ্বস্ত করে ‘সবুজ সংকেত’ দেওয়া হয়েছে। আনুষ্ঠানিকভাবে এটি এখন ঘোষণার অপেক্ষা। বিএনপি সূত্রে এমন তথ্য জানা গেছে।
জানতে চাইলে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর কালবেলাকে বলেন, ‘আসন্ন নির্বাচনে আসন সমঝোতা নিয়ে শরিকদের সঙ্গে এরই মধ্যে আমাদের আলোচনা হয়েছে। আশা করছি, বিষয়টি দু-এক দিনের মধ্যেই সুরাহা হয়ে যাবে, এটি আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করা হবে।’ শরিকদের সঙ্গে কয়টি আসনে সমঝোতা হতে পারে—এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এজন্য আরেকটু অপেক্ষা করতে হবে। এখন কিছুই বলা যাবে না।’
নির্বাচন কমিশন ঘোষিত তপশিল অনুযায়ী, ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও গণভোট আগামী ১২ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত হবে। আর নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী প্রার্থীদের মনোনয়নপত্র দাখিলের শেষ দিন ২৯ ডিসেম্বর।
নির্বাচন সামনে রেখে এখন পর্যন্ত দুই দফায় মোট ২৭২ আসনে সম্ভাব্য প্রার্থিতা ঘোষণা করেছে বিএনপি। এর ফলে ফাঁকা রয়েছে আর ২৮ আসন। বিএনপি থেকে বলা হয়েছে, এই ফাঁকা আসনগুলোতে মূলত শরিকরাই নির্বাচন করবেন। অবশ্য জোট নেতাদের অভিযোগ, বিএনপির চাওয়া অনুযায়ী দল ও জোটের প্রার্থী তালিকা জমা দিলেও কোনো আলোচনা ছাড়াই একতরফাভাবে প্রার্থিতা ঘোষণা করা হয়েছে। এর মধ্যে অন্তত ছয়টি আসনে ‘অনিবন্ধিত’ দল ও জোটের গুরুত্বপূর্ণ নেতারা মনোনয়নপ্রত্যাশী ছিলেন। তারা হলেন নড়াইল-২ আসনে জাতীয়তাবাদী সমমনা জোটের আহ্বায়ক ও এনপিপির চেয়ারম্যান ড. ফরিদুজ্জামান ফরহাদ, লক্ষ্মীপুর-১ আসনে ১২ দলীয় জোটের মুখপাত্র ও বাংলাদেশ এলডিপির চেয়ারম্যান শাহাদাত হোসেন সেলিম, কিশোরগঞ্জ-৫ আসনে ১২ দলীয় জোটের সমন্বয়ক ও বাংলাদেশ জাতীয় দলের চেয়ারম্যান সৈয়দ এহসানুল হুদা, কুষ্টিয়া-২ আসনে ১২ দলীয় জোট শরিক জাতীয় পার্টির (জাফর) মহাসচিব আহসান হাবিব লিংকন, যশোর-৫ আসনে জোট শরিক জমিয়তের যুগ্ম মহাসচিব রশিদ বিন ওয়াক্কাস এবং ঝালকাঠি-১ আসনে বাংলাদেশ লেবার পার্টির চেয়ারম্যান মোস্তাফিজুর রহমান ইরান।
এর মধ্যে গত ৮ ডিসেম্বর নিজ দল বাংলাদেশ এলডিপি বিলুপ্ত করে বিএনপিতে যোগদান করেন শাহাদাত হোসেন সেলিম। তাকে লক্ষ্মীপুর-১ আসনে ধানের শীষের মনোনয়ন নিশ্চিত করেছে বিএনপি। এ ছাড়া গতকাল নিজের দল বিলুপ্ত করে নেতাকর্মীদের নিয়ে বিএনপিতে যোগ দিয়েছেন বাংলাদেশ জাতীয় দলের চেয়ারম্যান সৈয়দ এহসানুল হুদা। আসন্ন নির্বাচনে কিশোরগঞ্জ-৫ আসনে ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে নির্বাচনে অংশ নেবেন তিনি। অবশ্য এ আসনে এরই মধ্যে শেখ মুজিবুর রহমান ইকবালকে প্রার্থী করেছে বিএনপি। এখন এখানে প্রার্থিতায় পরিবর্তন এনে এহসানুল হুদাকে মনোনয়ন দিতে যাচ্ছে দলটি। এদিকে ঝালকাঠি-১ আসনে ছাড় না পেয়ে বিএনপির সঙ্গে এরই মধ্যে সম্পর্ক ছিন্নের ঘোষণা দিয়েছেন লেবার পার্টির চেয়ারম্যান মোস্তাফিজুর রহমান ইরান। যদিও একাদশ সংসদ নির্বাচনে ইরান তৎকালীন ২০ দলীয় জোটের প্রার্থী হিসেবে পিরোজপুর-২ আসন থেকে ধানের শীষ প্রতীকে ভোট করেছিলেন।
বিএনপি একাদশ সংসদ নির্বাচনে নড়াইল-২ আসনে তৎকালীন ২০ দলীয় জোট শরিক এনপিপির ফরিদুজ্জামান ফরহাদকে ধানের শীষ দিয়েছিল। এবার এখানে এরই মধ্যে জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক মনিরুল ইসলামকে প্রার্থী করেছে দলটি। তবে গত বুধবার বিএনপির সঙ্গে অনুষ্ঠিত বৈঠকে নড়াইল-২ আসনটি জোট প্রধান ফরিদুজ্জামান ফরহাদের জন্য পুনর্বিবেচনা করতে ঐক্যবদ্ধভাবে জোরালো অনুরোধ জানান সমমনা জোট নেতারা। তখন আসনটি (নড়াইল-২) পুনর্বিবেচনা করার ব্যাপারে জোট নেতাদের আশ্বস্ত করে বিএনপি।
জানতে চাইলে জাতীয়তাবাদী সমমনা জোটের আহ্বায়ক ও এনপিপির চেয়ারম্যান ড. ফরিদুজ্জামান ফরহাদ কালবেলাকে বলেন, ‘বিএনপির পক্ষ থেকে এরই মধ্যে সমমনা জোটকে আশ্বস্ত করে বলা হয়েছে—এনপিপির জন্য তারা একটি আসন বরাদ্দ করবে, আর যাদের মনোনয়ন দেওয়া সম্ভব হবে না, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় গেলে তাদের যথাযথ মূল্যায়ন করা হবে।’
জানা গেছে, ফাঁকা থাকা পিরোজপুর-১ আসনে ১২ দলীয় জোট প্রধান মোস্তফা জামাল হায়দারকে এরই মধ্যে আশ্বস্ত করে ‘সবুজ সংকেত’ দিয়েছে বিএনপি। এ ছাড়া গত বুধবার বিএনপির সঙ্গে বৈঠকে কুষ্টিয়া-২ আসনটি জাতীয় পার্টির (জাফর) মহাসচিব আহসান হাবিব লিংকনের জন্য পুনর্বিবেচনা করতেও জোরালো দাবি জানায় ১২ দলীয় জোট। ২০১৮ সালে এই আসনে তৎকালীন ২০ দলীয় জোটের প্রার্থী হিসেবে ধানের শীষ প্রতীকে ভোট করেন লিংকন। বিএনপি এবার এই আসনে রাগীব রউফ চৌধুরীকে প্রার্থী করেছে।
জানতে চাইলে মোস্তফা জামাল হায়দার কালবেলাকে বলেন, ‘আমরা আমাদের দাবি-দাওয়া অনেক আগেই বিএনপির কাছে তুলে ধরেছি। এ নিয়ে অনেক আলোচনাও হয়েছে। আসন্ন নির্বাচনে তারা ১২ দলকে কয়টি আসন ছাড়বে, সে সিদ্ধান্ত এখন বিএনপিই দেবে।’
এদিকে গত ১ ডিসেম্বর আওয়ামী লীগ নেতা ও সাবেক অর্থমন্ত্রী প্রয়াত শাহ এএমএস কিবরিয়ার ছেলে রেজা কিবরিয়া আনুষ্ঠানিকভাবে বিএনপিতে যোগ দেন। পরে তিনি হবিগঞ্জ-১ আসন থেকে ধানের শীষের মনোনয়ন পান।
‘আসন সমঝোতা’ নিয়ে গত বৃহস্পতিবার গণতন্ত্র মঞ্চভুক্ত পাঁচটি দলের সঙ্গে আলাদাভাবে বৈঠক করে বিএনপি। বৈঠক সূত্রে জানা গেছে, মঞ্চের শীর্ষ তিন নেতা সমর্থন পেতে পারেন বিএনপির। বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হককে ঢাকা-১২, নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না বগুড়া-২ এবং গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকিকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৬ আসন ছাড় দেওয়া হতে পারে। এখন পর্যন্ত বগুড়া-২ এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৬ আসন ফাঁকা থাকলেও ঢাকা-১২ আসনে প্রার্থী দিয়েছে বিএনপি। এখানে ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির সাবেক আহ্বায়ক সাইফুল আলম নীরবকে প্রার্থী করেছে দলটি। সাইফুল হক প্রাথমিকভাবে ঢাকা-৮ আসন চাইলেও বিএনপি এখানে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাসকে প্রার্থী করেছে। এখন ‘সমঝোতার অংশ হিসেবে’ সাইফুল হককে ঢাকা-১২ আসনে সমর্থন দিতে পারে বিএনপি। বৈঠকে তাকে এ ব্যাপারে আশ্বস্তও করা হয়েছে, এখন আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেওয়ার অপেক্ষা। আরপিও অনুযায়ী, মঞ্চের তিন শীর্ষ নেতা তাদের নিজ নিজ দলের প্রতীকে নির্বাচন করবেন।
এ দিকে গত রোববার অনুষ্ঠিত বৈঠকে গণঅধিকার পরিষদকে ‘দুটি আসন’ ছাড়ার ব্যাপারে আশ্বস্ত করেছে বিএনপি। সে অনুযায়ী পটুয়াখালী-৩ আসনে নুরুল হক নুর এবং ঝিনাইদহ-২ আসনে রাশেদ খানকে সমর্থন দিতে পারে দলটি। যদিও রাশেদকে ঝিনাইদহ-২ এর পরিবর্তে ঝিনাইদহ-৪ আসনে দেওয়ার জন্য বিএনপির একটি পক্ষ জোর চেষ্টা-তদবির চালাচ্ছে। তবে রাশেদ খান ঝিনাইদহ-৪-এ যেতে নারাজ। এরই মধ্যে বিএনপিকে তিনি তার এ মনোভাবের কথা জানিয়েও দিয়েছেন। এ তিনটি আসনই ফাঁকা রয়েছে।
এ ছাড়া ‘নিবন্ধিত’ লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি-এলডিপিকে চট্টগ্রাম-১৪ ও কুমিল্লা-৭; বিজেপির চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার আন্দালিব রহমান পার্থকে ঢাকা-১৭ এবং এনডিএমের চেয়ারম্যান ববি হাজ্জাজকে ঢাকা-১৩ আসনে সমর্থন জানাতে পারে বিএনপি।
বিএনপির দায়িত্বশীল সূত্রে জানা গেছে, যুগপৎ আন্দোলনের শরিকদের বাইরে আসন সমঝোতা নিয়ে একটি ইসলামী দলের সঙ্গে এরই মধ্যে বোঝাপড়া হয়েছে বিএনপির। সেই দলটি হচ্ছে জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ, যাদের চারটি আসন ছাড়তে পারে বিএনপি। এ চারটি আসন এখন পর্যন্ত ফাঁকা রয়েছে।
নিজ দল বিলুপ্ত করে বিএনপিতে এহসানুল হুদা: নিজের দল বিলুপ্ত করে নেতাকর্মীদের নিয়ে বিএনপিতে যোগ দিয়েছেন বাংলাদেশ জাতীয় দলের চেয়ারম্যান সৈয়দ এহসানুল হুদা। গতকাল বিকেলে গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে এই যোগদান অনুষ্ঠান হয়। ‘সমঝোতার অংশ হিসেবে’ বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের হাতে ফুল দিয়ে দলটিতে যোগ দেন হুদা।