Image description
 

টাঙ্গাইলে যমুনার চরে এক সময় আবাদ হতো ধানসহ অন্যান্য ফসল। নব্বইয়ের দশকে নদীভাঙনে বিলীন হয়ে যায় চরের অধিকাংশ ফসলি জমি। বাঁধ নির্মাণের ফলে যমুনার ভাঙন অনেকটাই কমেছে।টাঙ্গাইলে যমুনার চরে এক সময় আবাদ হতো ধানসহ অন্যান্য ফসল। নব্বইয়ের দশকে নদীভাঙনে বিলীন হয়ে যায় চরের অধিকাংশ ফসলি জমি। বাঁধ নির্মাণের ফলে যমুনার ভাঙন অনেকটাই কমেছে। দুই বছর আগে আবারো জেগে উঠেছে চর। তবে আবাদি জমি ফিরে পেলেও ধান চাষে ফিরে যাননি চরাঞ্চলের কৃষক। বহুজাতিক টোব্যাকো কোম্পানি থেকে সুদমুক্ত ঋণ নিয়ে তামাক আবাদ শুরু করেছেন এক সময়ের ধানচাষীরা।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তামাক প্রক্রিয়াজাত ও ব্যবহারের কারণে মুখে ক্যান্সার, উচ্চ রক্তচাপে ব্রেন স্ট্রোক ও হার্ট অ্যাটাক হওয়ার ঝুঁকি বাড়ে। তামাক চাষে অতিরিক্ত সার ও কীটনাশক ব্যবহারে নষ্ট হচ্ছে জমির উর্বরশক্তি। এটি জীববৈচিত্র্য ও পরিবেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর।

এ প্রসঙ্গে মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স অ্যান্ড রিসোর্স ম্যানেজমেন্ট (ইসআরএম) বিভাগের অধ্যাপক ড. এএসএম সাইফুল্লাহ বণিক বার্তাকে বলেন, ‘তামাক সেবন যেমন স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর তেমনি বিষবৃক্ষটি উৎপাদনে কৃষিজমি ও বনভূমি উজাড় করা হচ্ছে, যা পরিবেশে ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। যে জমিতে তামাক চাষ করা হয়, সেখানকার উপকারী পোকামাকড় ও অণুজীব ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এতে জমির উৎপাদনক্ষমতা কমে য্য়। তামাক থেকে উৎপাদিত পণ্য বিড়ি, সিগারেটের অব্যবহৃত অংশ মাটি, পানি, বায়ুকে দূষিত করছে। এর বিষ খাদ্যচক্রে ছড়িয়ে পড়ছে। তামাক থেকে নিঃসরিত নিকোটিন ফুসফুস ক্যান্সারসহ মানবদেহে বিভিন্ন ধরনের রোগ সৃষ্টি করে।’

টাঙ্গাইল কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, জেলার পাঁচটি উপজেলায় এবার ২৩৩ হেক্টর জমিতে তামাক চাষ হয়েছে। এর মধ্যে ভূঞাপুরে ১১৫ হেক্টর, কালিহাতীতে ৯০, নাগরপুরে সাত, দেলদুয়ারে তিন ও সদর উপজেলায় ১৮ হেক্টর জমিতে তামাক চাষ হয়েছে।টাঙ্গাইল সদর উপজেলার মৈশানন্দলাল গ্রামের রহিম, মিজান, খোকন ও ছবুর চারজন মিলে ১১০ বিঘা জমিতে এবার তামাক চাষ করেছেন। ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো কোম্পানি তাদের জমি প্রস্তুত, সার ও বীজের জন্য ঋণ দিয়েছে প্রায় ৩ লাখ টাকা। দস্তা, ছত্রাকনাশক, ডিএপি, ফসফেট সার দেয়ার জন্য আলাদা করেও ঋণ দেয়া হয়েছে।

কৃষকরা বলছেন, প্রতি বিঘা জমিতে তামাক উৎপাদনে খরচ হয় ৩০-৩৫ হাজার টাকা। বিক্রি হয় ৪৫-৫০ হাজার টাকা। প্রতি বিঘায় তাদের লাভ হয় প্রায় ১৫ হাজার টাকা। জমিতে অন্য কোনো ফসল ফলিয়ে এত টাকা লাভ করা সম্ভব নয়।

স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, চাষ-পূর্ববতী ও পরবর্তী বিশেষ সহায়তা দেয় বহুজাতিক টোব্যাকো কোম্পানি। বিশেষ করে ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো কোম্পানি লিমিটেড, জাপান টোব্যাকো কোম্পানি লিমিটেড, আবুল খায়ের টোব্যাকো কোম্পানি, বেঙ্গল টোব্যাকো কোম্পানি ও গ্লোবাল টোব্যাকো কোম্পানি তাদের নিজস্ব প্রতিনিধির মাধ্যমে কৃষকদের তামাক চাষে উদ্বুদ্ধ করছে। বীজ ও সার কেনার জন্য নগদ অর্থসহ উপকরণ সরবরাহ ও নিয়মিত তদারকও করেন কোম্পানির প্রতিনিধিরা। এসব সুযোগ-সুবিধার পাশাপাশি দাম ভালো পাওয়ায় স্বাস্থ্য ঝুঁকি জেনেও তামাক চাষে ঝুঁকছেন চাষীরা। একই সঙ্গে বিকল্প ফসল উৎপাদনে খরচ বেশি ও ন্যায্যমূল্যের নিশ্চয়তা না থাকায় তামাক চাষে আগ্রহ বাড়ছে তাদের।

সরজমিনে দেখা গেছে, ভূঞাপুর উপজেলার গোবিন্দাসী, নলশা, জগৎপুরা, বামনহাটা, চরনিকলা, নিকরাইল, পালিমা, আমুলা; কালিহাতী উপজেলার সল্লা, দেউপুর, চর হামজানী, কদিম হামজানী, পটল, বেরী পটল, জোকারচর, গোহালিয়াবাড়ী, কুর্শাবেনু, সলিল গোবিন্দপুর, আফজালপুর ধলাটেঙ্গর; সদর উপজেলার কাকুয়া, হুগড়া, কাতুলী, মামুদনগর, চরপৌলী; দেলদুয়ার উপজেলার লাউহাটি, নাগরপুরের পাকুটিয়া, ভাদ্রা, বেকরা, আটাপাড়া, সলিমাবাদ, ধুবুরিয়া, মোকনা, বনগ্রাম ও শাহজানী গ্রামে তামাক চাষ হচ্ছে। তবে সবচেয়ে বেশি চাষ হচ্ছে কালিহাতী ও ভূঞাপুরে।

কৃষিসংশ্লিষ্টরা বলছেন, টোব্যাকো কোম্পানিগুলোর তৎপরতা, বিক্রির নিশ্চয়তা, চাষের জন্য সুদমুক্ত ঋণ, কোম্পানির প্রতিনিধিদের নিয়মিত মাঠ পরিদর্শন ও পরামর্শ তামাক চাষে কৃষকদের আকৃষ্ট করছে। কোম্পানিগুলোর তৎপরতা বন্ধ না হলে লোভে পড়ে কৃষক তামাক চাষে আরো বেশি আকৃষ্ট হবেন।

এ ব্যাপারে টাঙ্গাইল কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক আশেক পারভেজ বণিক বার্তাকে বলেন, ‘অতিরিক্ত লাভের আশায় কৃষক তামাক চাষ করছেন। জমির উর্বরাশক্তি নষ্ট ও স্বাস্থ্য ঝুঁকির বিষয়টি জানিয়ে কৃষকদের মাঝে সচেতনতাবিষয়ক সভা ও তামাক চাষে নিরুৎসাহিত করতে উঠান বৈঠক করা হচ্ছে। কৃষি খাতে যেসব প্রণোদনা রয়েছে, সেগুলো কৃষকদের নিয়মিত দেয়ার ব্যবস্থাও করা হচ্ছে।’

ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইন ২০০৫, (২০১৩ সালের সংশোধনী) প্রণীত হয়েছে। এ আইনের ধারা ১২-তে তামাকজাতীয় ফসল উৎপাদন ও চাষ নিরুৎসাহিত করার লক্ষ্যে সরকার প্রয়োজনীয় নীতিমালা গ্রহণ করতে পারবে বলেও উল্লেখ রয়েছে। তবে মাঠ পর্যায়ে তেমন কোনো তৎপরতা দেখা যায়নি।

টাঙ্গাইল সদর উপজেলার হুগড়া ইউনিয়নের আজহার আলী এ বছর চার বিঘা জমিতে তামাক চাষ করেছেন। কোম্পানি থেকে ১৪ হাজার টাকা ঋণ নিয়েছেন। এছাড়া কালিহাতী উপজেলার সলিল গোবিন্দপুর গ্রামে চাষ হয়েছে ৩০০ বিঘা জমিতে। ওই গ্রামের হাসানুল হক একাই ১০ বিঘা জমিতে তামাক চাষ করেছেন।

তিনি জানান, কোম্পানি গাড়ি দিয়ে তামাক নিয়ে যায়। আর সরাসরি ব্যাংকে টাকা পাঠিয়ে দেয়। সবকিছুই করে দেন কোম্পানির লোকেরা।

তবে এ প্রসঙ্গে ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকোর সলিল গোবিন্দপুর ও কুর্শাবেনু এলাকার দায়িত্বপ্রাপ্ত মাঠকর্মী জিয়া বণিক বার্তাকে বলেন, ‘কী পরিমাণ জমিতে তামাক চাষ হচ্ছে, সেটা বলতে পারব না। তবে এখানে ছয়টি টোব্যাকো কোম্পানি কাজ করে। টাঙ্গাইলের দায়িত্বে যিনি ছিলেন, তিনি অবসরে গেছেন। এখন মাঝেমধ্যে মানিকগঞ্জ থেকে কর্মকর্তারা আসেন।’