দুই ছাত্রনেতাকে গুলি করে হত্যার প্রতিবাদে শেখ মুজিবুর রহমানকে দেওয়া ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি ১৯৭৩ সালেই প্রত্যাহার করেছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু)। ওই বছরের ২ জানুয়ারি মুজিবের ওই উপাধি প্রত্যাহারের ঘোষণা দেন ডাকসুর তৎকালীন ভিপি সিপিবির সাবেক সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম। একই সঙ্গে আওয়ামী লীগ প্রধানকে দেওয়া ‘জাতির পিতা’ তকমাও প্রত্যাহার করে নেয় দেশের দ্বিতীয় সংসদখ্যাত ডাকসু। পাশাপাশি সংগঠনের পক্ষ থেকে দেওয়া সম্মানসূচক আজীবন সদস্যপদও বাতিল করা হয়। এছাড়া ডাকসুর পক্ষ থেকে মুজিবের নামের আগে ‘বঙ্গবন্ধু’ বিশেষণ ব্যবহার না করার জন্য দেশের জনগণ ও গণমাধ্যমের প্রতিও আহ্বান জানানো হয়।
সেই সময়ের দৈনিক বাংলা, ইত্তেফাক, সংবাদসহ পত্রপত্রিকার খবর ও পরবর্তীতে বিভিন্ন রাজনীতিবিদদের বক্তব্যে এই তথ্য উঠে আসে। সম্প্রতি একটি বেসরকারি টেলিভিশনের টকশোর আলোচনাকে কেন্দ্র করে বিষয়টি আবার সামনে আসে। ওই অনুষ্ঠানে শেখ মুজিবের অতীত ইতিহাস উল্লেখ করে মুজিবকে ‘বিশ্বাসঘাতক’ অ্যাখ্যা দেন অনুষ্ঠানটির অতিথি সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার এএসএম শাহরিয়ার কবির। পরে মুজিবকে ‘বঙ্গবন্ধু’ আখ্যায়িত করে অতিথির বক্তব্যের প্রতিবাদ জানান উপস্থাপিকা রোকসানা আঞ্জুমান নিকোল। এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম রীতিমতো আলোচনা ও সমালোচনায় সরগরম হয়।
আগামী ৭ জানুয়ারির মধ্যে ক্ষমা ভিক্ষা না করে তবে বাংলাদেশে এই দুই প্রতিষ্ঠানের কোনো সভা করতে দেওয়া হবে না।”
হত্যার প্রতিবাদে ছাত্রজনতার আন্দোলন চলাকালে মুজিবের ছবি ছেঁড়ার চেষ্টার অভিযোগ এনে এস ইসলাম নামের এক ব্যক্তির কান কেটে নেয় আওয়ামী লীগ। এ নিয়ে ৩ জানুয়ারি প্রকাশিত দৈনিক বাংলার শিরোনাম ছিল ‘বঙ্গবন্ধুর ছবির অসম্মান করায় জনতা তার কান কেটে নিয়েছে’।
মর্গে থাকা ছিনতাইকারীর লাশ এনে ছাত্রলীগকর্মী দাবি
২০১০ সালের ১ জানুয়ারি ‘সাম্রাজ্যবাদবিরোধী সংহতি দিবস’ স্মরণে সাপ্তাহিক একতায় প্রকাশিত সেলিমের লেখা থেকে জানা যায়, আন্দোলন ঠেকাতে ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে অনেক কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়। শুরু হয় সরকারি দলের হুমকি-হামলা। ডাকসু কার্যালয় তছনছ ও ন্যাপ অফিসেও হামলা করে তারা। ৫ জানুয়ারি ছাত্র ইউনিয়নের মশাল মিছিলে হামলা চালায় ‘আওয়ামী গুণ্ডারা’ (সেলিমের ভাষায়)। সন্ধ্যার আগে আগে ছাত্র ইউনিয়ন অফিস ও ন্যাপ অফিসে আগুন ধরিয়ে দেয়। এর আগে ৪ জানুয়ারি মেডিকেলের মর্গ থেকে মিরজাহান আলী নামের একজনের লাশ উঠিয়ে এনে সংবাদ সম্মেলন করে বলা হয়, ‘ছাত্র ইউনিয়নের কর্মীরা ১ জানুয়ারির পরে ছাত্রলীগ কর্মীকে হত্যা করেছে’। পরদিন প্রমাণ হয়, লাশটি পুলিশের গুলিতে নিহত একজন হাইজ্যাকারের। ঘটনার ৭ দিন আগে, ২৭ ডিসেম্বরে এটি মর্গে রাখা হয়।
পরে তীব্র বিক্ষোভের মুখে হত্যার ঘটনায় দুঃখ প্রকাশ করেন শেখ মুজিব। সেই সঙ্গে সাত দফা দাবির কয়েকটি মেনেও নেন। তবে এর আগেই দেশব্যাপী একটা ঝড় বয়ে যায়। দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেওয়া ও সরকারের পক্ষ থেকে ছাত্রদের ওপর দায় চাপানোর কারণে মুজিবের উপাধি বাতিল করা হয়।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ডাকসুর তৎকালীন ভিপি সেলিম শনিবার আমার দেশকে বলেন, ‘স্বাধীন দেশে আমরা ভিয়েতনামের সংগ্রামে সংহতি জানিয়ে মিছিল বের করেছিলাম। যেই মিছিলের ওপর পুলিশ গুলি বর্ষণ করে। সেই গুলি বর্ষণের ব্যাপারে দুঃখ প্রকাশ করা; দায়ী ব্যক্তিদের শাস্তি দেওয়া এবং তাদের অপসারণ করা; আহত ব্যক্তিদের চিকিৎসার দায়িত্ব নেওয়ার দাবি জানাই। কিন্তু আমাদের দাবিগুলো না মানায় আমি এই ঘোষণা দিই। এটি ছিল স্বাধীন বাংলাদেশে পুলিশের গুলিতে প্রথম হত্যাকাণ্ড। পয়লা জানুয়ারি ’৭৩ সালে এটি সংঘটিত হয়।’
ওইদিন ছাত্রনেতারা কোনো পিকেটিং করেছিলেন কি না জানতে চাইলে সেলিম বলেন, ‘পিকেটিং-টিকেটিং এ রকম কিছু করেনি। একটা শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি ছিল। আমরা শুধু স্মারকলিপি দেওয়ার জন্য যাই। বটতলায় প্রতিবাদ সমাবেশ ও বক্তৃতা শেষে মিছিল নিয়ে রওনা হই মতিঝিলের আদমজী কোর্টের আমেরিকান দূতাবাস অভিমুখে। দোয়েল চত্বর, শিক্ষা ভবন, হাইকোর্ট মোড়, এখনকার কদম ফোয়ারা পার হয়ে মিছিল ডানদিকে মোড় নেয়। সে সময় ইউএসআইএসের বিল্ডিংয়ের সামনে যেটা বর্তমান প্রেস ক্লাবের উল্টো দিকে ছিল। আমরা কদম ফোয়ারা ঘুরে প্রেস ক্লাবের কাছাকাছি আসতেই কোনো ধরনের পূর্ব সতর্কতা ছাড়াই পুলিশ গুলি করে। সে সময় দুজন মারা যান, অনেকে আহত হন। কিছু সাংবাদিকও গুরুতর আহত হয়েছিলেন।’