ফেব্রুয়ারি ২০০৯-এর পিলখানা হত্যাকাণ্ডকে শুধু বিডিআর সদস্যদের বেতন-বৈষম্য বা সীমিত অসন্তোষের ফলাফল হিসেবে ব্যাখ্যা করা যায় না- এ কথা আজ প্রায় সর্বসম্মত। যেকোনো বাহিনীতে কিছু দাবি-দাওয়া ও অভ্যন্তরীণ ক্ষোভ থাকা স্বাভাবিক, বিডিআরও তার ব্যতিক্রম ছিল না। কিন্তু এই ধরনের অসন্তোষকে কেন্দ্র করে ইতিহাসের অন্যতম নির্মম হত্যাযজ্ঞ- একযোগে ৫৭ জন সেনাকর্মকর্তাকে হত্যা সম্পূর্ণ অস্বাভাবিক, অপ্রত্যাশিত ও পরিকল্পনাহীন বিদ্রোহের পক্ষে প্রায় অসম্ভব।
২৫-২৬ ফেব্রুয়ারি ২০০৯ সালে ঘটে যাওয়া বিডিআর হত্যাকাণ্ড নিয়ে গঠিত জাতীয় স্বাধীন তদন্ত কমিশনের প্রতিবেদনে এসব কথা বলা হয়। এই প্রতিবেদনে বলা হয়- তদন্ত নথি ও প্রত্যক্ষদর্শী বয়ানের যৌথ বিশ্লেষণে স্পষ্ট- সাধারণ সদস্যদের মধ্যে অসন্তোষ ছিল কেবল উপলক্ষ; এর আড়ালেই কাজ করেছে একটি সুসংগঠিত পরিকল্পনা। নেপথ্যের শক্তিগুলো দক্ষভাবে সেই অসন্তোষকে ব্যবহার করেছে বাহিনীটির নেতৃত্বকে নিশ্চিহ্ন করার জন্য। এই নির্মম ঘটনার নেপথ্যে যে উদ্দেশ্যগুলো কাজ করেছে বলে তদন্ত-অভিযান ইঙ্গিত দেয়, সেগুলো হলো-
সেনাবাহিনীকে পঙ্গু করা : বাংলাদেশ সেনাবাহিনী স্বাধীনতা যুদ্ধ থেকে শুরু করে প্রতিটি জাতীয় সঙ্কটে সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য শক্তি হিসেবে ভূমিকা রেখেছে। দুর্যোগ, বিদ্রোহ, জঙ্গিবাদ- সবক্ষেত্রেই সেনাবাহিনী দেশকে রক্ষা করেছে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে। এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের নেতৃত্বকে নির্মূল করা মানে রাষ্ট্রের নিরাপত্তাকে পঙ্গু করা। ষড়যন্ত্রকারীদের মূল লক্ষ্য ছিল সেনাবাহিনীর শীর্ষ নেতৃত্বে শূন্যতা সৃষ্টি করা এবং সৈনিকদের মনোবল ভেঙে দেয়া।
বিডিআরকে অকার্যকর ও মেরুদণ্ডহীন করা : পাদুয়া ও রৌমারির মতো সীমান্ত সংঘর্ষে বিডিআর যে দক্ষতা, বীরত্ব ও দেশপ্রেম দেখিয়েছিল, তা আঞ্চলিক কৌশলগত শক্তিগুলোর নজর এড়ায়নি। এমন একটি শক্তিশালী সীমান্তরক্ষী বাহিনীর নেতৃত্ব ভেঙে দেয়া ছিল ষড়যন্ত্রকারীদের অন্যতম উদ্দেশ্য। নেতৃত্বহীন বিডিআরকে সহজেই একটি বশংবদ, নিয়ন্ত্রিত এবং রাজনৈতিকভাবে ব্যবহারের উপযোগী বাহিনীতে পরিণত করা যেত।
সেনা অফিসারদের বিডিআরে যোগদানে নিরুৎসাহিত করা : বিডিআরের পেশাগত দক্ষতা ও মনোবলের প্রধান উৎস ছিল সেনাবাহিনী থেকে প্রেষণে আসা চৌকস অফিসারদের নেতৃত্ব ও প্রশিক্ষণ। পিলখানার হত্যাযজ্ঞের মাধ্যমে প্রেষণপ্রাপ্ত অফিসারদের ভয় দেখানো হয়, যাতে ভবিষ্যতে তারা বিডিআরে আসতে অনিচ্ছুক হন। এটি ছিল বাহিনীটির দক্ষতা পদ্ধতিগতভাবে ভেঙে দেয়ার এক কৌশল।
আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের সম্মানহানি ঘটানো : বাংলাদেশ সেনাবাহিনী জাতিসঙ্ঘ শান্তিরক্ষা মিশনে দীর্ঘদিন ধরেই অন্যতম সেরা বাহিনী হিসেবে প্রশংসা কুড়িয়েছে। এই সুনাম শুধু বাহিনীর নয়, দেশেরও আন্তর্জাতিক মর্যাদা বৃদ্ধি করেছে। পিলখানা হত্যাকাণ্ড আন্তর্জাতিক মহলে বাংলাদেশের প্রতি আস্থাকে নড়বড়ে করে, শান্তিরক্ষা মিশনে আমাদের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ করার চেষ্টা তৈরি করে। ষড়যন্ত্রকারীরা চেয়েছিল বাংলাদেশ যেন বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে একটি দুর্বল, অনিশ্চিত, অস্থিতিশীল রাষ্ট্র হিসেবে প্রতীয়মান হয়।
বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের ওপর আঘাত : নিরাপত্তাবাহিনীতে এমন ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ কোনো রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের ভিত্তিকে কাঁপিয়ে দেয়। পরিকল্পনাকারীরা বুঝেছিল সেনাবাহিনী কিংবা সীমান্ত বাহিনীর প্রতি জনগণের আস্থা ভেঙে গেলে রাষ্ট্রীয় সক্ষমতাই প্রশ্নবিদ্ধ হবে। এটি ছিল বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ আঘাত হানার একটি কৌশল।
বাংলাদেশকে একটি অস্থিতিশীল রাষ্ট্র হিসেবে উপস্থাপন করা : পিলখানা হত্যাকাণ্ডের অব্যবস্থাপনা, বিশৃঙ্খলা ও রাষ্ট্রীয় সাড়া দেয়ার মধ্যে বিভ্রান্তি—, এসব আন্তর্জাতিক মহলে বাংলাদেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। ষড়যন্ত্রকারীরা চেয়েছিল বাংলাদেশকে এমন একটি দেশ হিসেবে পরিচিত করানো, যেখানে নিরাপত্তা ও রাজনৈতিক কাঠামো যেকোনো সময় ভেঙে পড়তে পারে।
নিরাপত্তা খাতে বিদেশী প্রভাব বিস্তারের সুযোগ সৃষ্টি : হত্যাকাণ্ডের পর সীমান্তরক্ষী বাহিনীকে আর্থিক ও কারিগরি সহায়তার নামে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টায় এটিকে অনেক বিশেষজ্ঞই ‘ংড়ভঃ-ঢ়বহবঃৎধঃরড়হ ংঃৎধঃবমু’ বলে আখ্যা দেন। বাহিনীর দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে বিদেশী শক্তির প্রভাব বৃদ্ধি ছিল পিলখানার ঘটনার পরবর্তী সম্ভাব্য উদ্দেশ্যগুলোর একটি।
কমান্ড চ্যানেলের অনিয়ম, প্রশাসনিক ব্যর্থতা ও ক্রমবর্ধমান অসন্তোষ : ২০০৯ সালের ফেব্রুয়ারির ভয়াবহ পিলখানা হত্যাকাণ্ডের আগে বিডিআরের অভ্যন্তরে যে অস্থিরতা, ক্ষোভ ও শৃঙ্খলা-বহির্ভূত পরিবেশ সৃষ্টি হচ্ছিল, তার মূল উৎস ছিল কমান্ড চ্যানেলের ধস, সিদ্ধান্ত গ্রহণে অদূরদর্শিতা এবং কিছু কর্মকর্তার আচরণজনিত সঙ্কট। উদঘাটিত নথি, তদন্ত-প্রতিবেদন ও সাক্ষ্য-প্রমাণে দেখা যায়, বিদ্রোহের আগে বিডিআরে বহুমাত্রিক প্রশাসনিক বিচ্যুতি সৃষ্টি হয়ে দাঁড়ায়, যা পরবর্তীকালে বিস্ফোরণ ঘটায় ভয়াবহ পরিণতি।
স্টাফ অফিসারদের আচরণ ও কমান্ড চ্যানেলে বিশ্বাস সঙ্কট : উদঘাটিত তথ্য অনুযায়ী মেজর মাহবুব ও তৎকালীন ডিজি বিডিআর মেজর জেনারেল শাকিলের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক নিয়ে বাহিনীর ভেতরে তীব্র অসন্তোষ ছিল। ব্যক্তিগত স্টাফ অফিসার (জিএসও-২, কর্ড) হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে মেজর মাহবুব কার্যত বিডিআরের সব প্রশাসনিক বিষয়ে অপ্রকাশ্য নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। কিন্তু তার এই প্রভাবশালী অবস্থানকে কেন্দ্র করে অন্যান্য স্টাফ অফিসার, এমনকি সাধারণ সৈনিকরাও ক্ষুব্ধ ছিলেন। মেজর মাহবুবের ঔদ্ধত্যপূর্ণ ও স্বেচ্ছাচারী আচরণ সেনাসদর পর্যন্ত পৌঁছে যায়। সেনাসদর তার বিদেশ সফরে নিরাপত্তা ছাড়পত্র দিতে অস্বীকার করলে ডিজি স্বয়ং সিজিএসের সাথে কথা বলে অনুমতি আদায় করেন। এই ঘটনাই নি¤œপদস্থ সদস্যদের চোখে কমান্ডের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিয়ে গভীর সন্দেহ সৃষ্টি করে।
অভিজ্ঞতা ও সক্ষমতা ছাড়া “ডাল-ভাত কর্মসূচি” বাস্তবায়ন : ২০০৭ সালে তৎকালীন সরকার দরিদ্র মানুষের কাছে উচিৎ মূল্যে খাদ্যসামগ্রী পৌঁছে দেয়ার জন্য ‘ডাল-ভাত কর্মসূচি’ চালু করে এবং এর পূর্ণ দায়িত্ব দেয়া হয় বিডিআরকে। কিন্তু খাদ্য বিতরণ, আর্থিক লেনদেন, সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্ট, সিস্টেম লস হিসাব- এসব বিষয়ে বাহিনীর কোনো অভিজ্ঞতা ছিল না। ফলস্বরূপ সিস্টেম লসের দায় অনেক জায়গায় অযথা সৈনিকদের ওপর চাপানো হয়। আর্থিক লেনদেনের জটিলতায় বহু সদস্য নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়েন। অনেকে চাকরিচ্যুতি ও শাস্তির সম্মুখীন হন।
এর সাথে যুক্ত হয় ডেইলি অ্যালাউন্স (ডিএ) নিয়ে ধোঁয়াশা। সদস্যরা যে পরিমাণ ডিএ পাওয়ার হিসাব করেছিলেন, বাস্তবে তার চেয়ে কম পাওয়ায় তাদের মধ্যে গভীর ক্ষোভ জন্মে। ফলে ডাল-ভাত কর্মসূচি বিডিআরের ভেতরে বিশৃঙ্খলা, অবিশ্বাস ও প্রশাসনিক ব্যর্থতার প্রতীক হয়ে ওঠে।
কমান্ড দায়িত্বে অবহেলা ও কর্মকর্তাদের নি¤œ-মনোযোগ : পিলখানায় কর্মরত অনেক কর্মকর্তা ছিলেন সহানুভূতিমূলক বদলির পরিপ্রেক্ষিতে নিয়োগপ্রাপ্ত। ফলে তারা ব্যক্তিগত সমস্যা ও পারিবারিক দায়দায়িত্বে বেশি মনোযোগী ছিলেন, অধীনস্থ সদস্যদের প্রতি নয়। এর ফলে সৈনিকদের অভিযোগ জানানোর সুযোগ সঙ্কুচিত হয়, স্টাফদের মধ্যে নেতৃত্বের প্রতি আস্থা কমে যায় এবং মাঠপর্যায়ে কমান্ড ভ্যাকুয়াম সৃষ্টি হয়। তৎকালীন নেতৃত্ব এই অবস্থার ব্যাপারে যথাযথ পদক্ষেপ নেয়নি, যা পরে বড় ধরনের সঙ্কটে রূপ নেয়।
সতর্কবার্তা উপেক্ষা করে বিডিআর সপ্তাহ পালনে অনড় সিদ্ধান্ত : ২০০৯ সালের ফেব্রুয়ারি-মার্চে যেভাবেই হোক বিডিআর সপ্তাহ পালন করার পক্ষে ছিল উচ্চপর্যায়ের কমান্ড। অথচ বাহিনীর সদস্যদের মধ্যে তীব্র অসন্তোষ, অফিসার বনাম জওয়ান বিভাজন, সেনাকর্মকর্তাদের প্রতি হুমকি- এসব বিষয়ে তারা অবগত ছিলেন। তবুও ঝুঁকি বিবেচনা না করে অনুষ্ঠানটি বাতিল বা স্থগিত করার কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি। এই অদূরদর্শিতাকে অনেকে বিদ্রোহের পূর্ব-পর্যায়ে একটি কেন্দ্রীয় ত্রুটি হিসেবে অভিহিত করেন।
বিডিআর সদর দফতরে দুর্নীতি ও তদন্তের আগাম ফাঁস : বিদ্রোহের কিছু দিন আগে ডিজিএফআই তাদের প্যারামিলিটারি ডেস্কের অফিসার মেজর মুর্তাজাকে ডিজি ও তার স্ত্রীর বিরুদ্ধে ওঠা দুর্নীতির অভিযোগ খতিয়ে দেখার দায়িত্ব দেয়। কিন্তু তদন্তের উদ্দেশ্য ফাঁস হয়ে যাওয়ায় মেজর মুর্তাজা তদন্ত এগিয়ে নিতে পারেননি। এটি বাহিনীর ভেতরে ‘দুর্নীতি ঢাকা দেয়ার চেষ্টা’ হিসেবে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে। এ ছাড়া ডাল-ভাত কর্মসূচিতে দুর্নীতির অভিযোগ, বিডিআর দরবার হল ডিজির কোর্সমেট মেজর (অব:) আকরামকে লিজ দেয়ার ঘটনা, লিফলেটের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ওই সব অভিযোগ বাহিনীর ভেতরে অসন্তোষকে আরো উসকে দেয়।
সব মিলিয়ে দেখা যায়, বিদ্রোহের আগে বিডিআরের ভেতরে সৃষ্টি হয়েছিল এক বহুমাত্রিক সঙ্কট- অকার্যকর কমান্ড, কর্মকর্তাদের ঔদ্ধত্য, প্রশাসনিক ব্যর্থতা, অদূরদর্শী সিদ্ধান্ত, দুর্নীতির অভিযোগ ও সৈনিকদের দীর্ঘদিনের বঞ্চনা। যদিও পিলখানা হত্যাকাণ্ডকে শুধু বেতন-বৈষম্য বা ক্ষোভভিত্তিক বিদ্রোহ বলা ইতিহাসের প্রতি অবিচার। ঘটনাটি ছিল একটি বহুমাত্রিক ষড়যন্ত্র, যার প্রধান লক্ষ্য ছিল- সেনাবাহিনীর নেতৃত্ব ধ্বংস, সীমান্ত বাহিনীকে দুর্বল ও নিয়ন্ত্রণযোগ্য করা, বাংলাদেশের বৈশ্বিক মর্যাদা ক্ষুণœ করা এবং রাষ্ট্রের সার্বভৌম সক্ষমতাকে দুর্বল করে তোলা। এই দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে হত্যাযজ্ঞের পেছনের উদ্দেশ্যগুলো আরো স্পষ্ট হয়ে ওঠে এবং তদন্তের প্রয়োজনীয়তা আরো জোরালো হয়।