আগামী ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে ভোটের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ বাড়াচ্ছে গত জুলাই আন্দোলনের সময় লুণ্ঠিত বিপুল পরিমাণ অস্ত্র। ২০২৪ সালের আন্দোলনের সময় পাঁচ হাজার ৭৬৩টি অস্ত্র লুট হয়, এর মধ্যে এখনো উদ্ধার হয়নি এক হাজার ৩৪০টি। এসব অস্ত্র নিয়ে দুশ্চিন্তায় রয়েছে পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
নির্বাচন ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন স্থানে প্রার্থী ও সমর্থকদের ওপর হামলার ঘটনা বাড়ছে। বিশেষ করে চট্টগ্রামে বিএনপির এক প্রার্থীর ওপর গুলিবর্ষণ এবং মিরপুরে যুবদল নেতাকে প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যার ঘটনা পুলিশকে অবৈধ অস্ত্রের ব্যাপারে ভাবিয়ে তুলেছে। পুলিশের ক্রাইম কনফারেন্সে আইজিপি বারবার খোয়া যাওয়া এসব অস্ত্র উদ্ধার তৎপরতা জোরদারের নির্দেশ দিয়েছেন।
গত ৫ নভেম্বর সরকার লুণ্ঠিত অস্ত্র ও গোলাবারুদ উদ্ধারে পাঁচ লাখ টাকা পর্যন্ত পুরস্কার ঘোষণা করে। এর আগেও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে খোয়া যাওয়া অস্ত্র উদ্ধারের জন্য পুরস্কার ঘোষণা করা হয়েছিল। কিন্তু এখন পর্যন্ত অনেক অস্ত্র উদ্ধারের বাইরে রয়ে যায়।
পুলিশের কর্মকর্তাদের আশঙ্কা, খোয়া যাওয়া অস্ত্রের কারণে নির্বাচনে কালোটাকার প্রভাব বাড়তে পারে। আবার খোয়া যাওয়া এসব অস্ত্র আন্ডারওয়ার্ল্ডে প্রবেশ করে শুধু নির্বাচন নয়, সারা দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিকে অস্থিতিশীল করে তুলতে পারে। এজন্য ভোটের আগে ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে খোয়া যাওয়া অস্ত্র উদ্ধারের জন্য সাঁড়াশি অভিযানের পরিকল্পনা রয়েছে পুলিশের। এ ব্যাপারে র্যাবও মাঠপর্যায়ে কাজ করছে বলে জানা গেছে।
এ বিষয়ে আইজিপি বাহারুল আলম গত বৃহস্পতিবার রাতে আমার দেশকে জানান, এক হাজার ৩৪০টি অস্ত্র এখনো উদ্ধার হয়নি। পুলিশ এগুলো উদ্ধারের চেষ্টা করছে। এসপিদেরও প্রায়ই এ ব্যাপারে তাগিদ দেওয়া হয়। তিনি আরো জানান, কিছুদিন আগে একটি এলাকায় গোপন তথ্যের ভিত্তিতে জানতে পেরে একটি পুকুরের পানি সেচে অস্ত্রের খোঁজে তল্লাশি চালানো হয়। এছাড়া বিভিন্ন সোর্সের মাধ্যমে আমরা হারিয়ে যাওয়া অস্ত্রগুলো উদ্ধারের চেষ্টা করছি। আমাদের চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।
পুলিশ সদর দপ্তর সূত্রে জানা গেছে, বিভাগের ক্রাইম কনফারেন্সে ভোটের মাঠে নিরাপত্তার বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করা হয়। এতে গোয়েন্দা সংস্থার দেওয়া ঝুঁকির তথ্যগুলো পর্যালোচনা করা হয়। নির্বাচন সামনে রেখে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখা এবং সম্ভাব্য নাশকতা বা সহিংসতা এড়ানো এখন পুলিশের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। ভোটের মাঠে নিরাপত্তা বিধানের পাশাপাশি খোয়া যাওয়া আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার এবং যারা সহিংসতা তৈরি করছে, তাদের আইনের আওতায় আনার পরামর্শ দেওয়া হয়।
পুলিশ জানায়, কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগ আগামী সংসদ নির্বাচনের প্রার্থী ও নেতাদের ওপর অতর্কিত হামলা চালিয়ে নির্বাচন বানচাল করার ষড়যন্ত্র করতে পারে। অরাজকতা সৃষ্টির জন্য তারা চরমপন্থি গোষ্ঠীকে সক্রিয় করতে পারে। এক্ষেত্রে তারা এসব অস্ত্র ব্যবহার করতে পারে। এজন্য ভোটের মাঠে থাকা প্রার্থীদের নিরাপত্তায় অতিরিক্ত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কোথায় প্রচার ও জনসভা হবে জেনে পুলিশ ওই এলাকায় কঠোর তল্লাশি, পোশাকে ও সাদা পোশাকে নজরদারির ব্যবস্থা করবে। জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের রাজনৈতিক দলের কার্যালয়েও নিরাপত্তা বাড়ানো হবে।
এছাড়া সোশ্যাল মিডিয়ায় গুজব, উসকানি ও বিদেশি প্রোপাগান্ডা ঠেকাতে সাইবার বিভাগ, অ্যান্টি-টেরোরিজম ইউনিট ও ডিবির সাইবার ইউনিট নজরদারি জোরদার করেছে। নির্বাচনে কেউ যেন গুজব ছড়াতে না পারে, সেদিকে নজর রাখছে পুলিশ। এছাড়াও বিদেশ থেকে কারা প্রোপাগান্ডা ছড়াচ্ছে, সেদিকেও নজর রাখা হচ্ছে।
পুলিশ সদর দপ্তর সূত্রে জানা গেছে, পুলিশের কাছে কোনো প্রার্থী বাড়তি নিরাপত্তার আবেদন করলেও সেটি বিবেচনা করে বিশেষ নিরাপত্তা দেওয়া হবে। কারণ প্রার্থী যদি নিরাপত্তার অভাবে ভোট বর্জন করে বসেন, তাহলে পুরো নির্বাচনব্যবস্থার ওপর প্রভাব পড়বে। সে বিষয়টিও বিবেচনায় রেখেছে পুলিশ।
পুলিশ সদর দপ্তর সূত্রে জানা গেছে, এখনো এক হাজার ৩৪০টি অস্ত্র উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। খোয়া যাওয়া অস্ত্রের মধ্যে রয়েছে—চায়না রাইফেল ১১৩টি, এসএমজি ১৩টি, এলএমজি তিনটি, পিস্তল ২০৭টি, ৯ বোর পিস্তল ৪৫৫টি, শটগান ৩৯২টি, গ্যাসগান ১২৯টি, টিয়ার গ্যাস লঞ্চার সাতটি ও সিগন্যাল পিস্তল দুটি। অস্ত্র উদ্ধারে দেশব্যাপী পুরস্কার ঘোষণা অব্যাহত রয়েছে। কারো কাছে এসব অস্ত্র পাওয়া গেলে তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এছাড়া ভোটের মাঠে কোনো কোনো এলাকায় প্রার্থীদের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের মধ্যে হট্টগোল হতে পারে- এমন এলাকাগুলো তালিকা তৈরি করেছে পুলিশ। সংঘাত সম্ভাব্য এলাকা হিসেবে চট্টগ্রাম, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কুষ্টিয়া, ঢাকা (বাড্ডা ও মিরপুর), নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ, খুলনাসহ কয়েকটি জেলা চিহ্নিত করা হয়েছে। এসব এলাকায় বাড়তি নিরাপত্তাব্যবস্থা করবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।