আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে ২৭২ আসনে সম্ভাব্য দলীয় প্রার্থী ঘোষণা করেছে বিএনপি। প্রত্যাশা অনুযায়ী বিএনপির যুগপৎ আন্দোলনের অংশীজনদের আসন ছাড় না দেওয়ায় তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন তাঁরা। জোট থেকে বেরিয়ে যাওয়ার ঘোষণাও দিয়েছে একটি দল। এখনো ২৮টি আসন ফাঁকা রাখা হলেও তাতে যুগপৎ সঙ্গীরা সন্তুষ্ট নন।
এদিকে সবার আগে সম্ভাব্য প্রার্থী ঘোষণা করে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। এর মধ্যে দলটি আরো সাতটি দল নিয়ে আটদলীয় জোট গঠন করে নানা ইস্যুতে একসঙ্গে কর্মসূচি পালন করছে। নির্বাচনী প্রচারণাও শুরু করে দিয়েছে।
এমন পরিস্থিতির মধ্যে বিএনপির যুগপৎ সঙ্গীরা নাখোশ হওয়ায় রাজনীতিতে নতুন মেরুকরণ ও সমীকরণ দেখা দিয়েছে।
রাজনৈতিক মহলে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনার পর প্রথম দফায় গত ৩ নভেম্বর দলীয় প্রার্থী ঘোষণা শুরু করে বিএনপি। প্রথম দফায় ২৩৭ আসনের সম্ভাব্য প্রার্থী ঘোষণা করে বিএনপি। তখন ধারণা করা হয়েছিল, বাকি আসনগুলোর অধিকাংশ দেওয়া হবে যুগপৎ আন্দোলনের সঙ্গীদের। কিন্তু গত ৪ ডিসেম্বর ফাঁকা রাখা আসনগুলোর মধ্যে আরো ৩৬টি আসনে দলীয় প্রার্থী ঘোষণা করে বিএনপি।
এতেই ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছেন বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনের সঙ্গী ১২ দলীয় জোট ও গণতন্ত্র মঞ্চের নেতারা। তবে বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, যুগপৎ সঙ্গীদের সঙ্গে আলোচনা করা হবে।
যুগপৎ সঙ্গীরা বলছেন, জামায়াতে ইসলামী ভিন্ন মতাদর্শের ইসলামী দলগুলো নিয়ে একসঙ্গে জোট করে নির্বাচনী প্রচারণা শুরু করেছে। বিপরীতে বিএনপি একলা চলো নীতিতে হাঁটছে কিনা বর্তমানে সেই প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, যা বিএনপি ঘোষিত ‘রেইনবো নেশন’ ঘোষণার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।
বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক ও গণতন্ত্র মঞ্চের সমন্বয়ক সাইফুল হক কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘জামায়াত যেখানে অবিশ্বাস্যভাবে বিভিন্ন মতাদর্শের ইসলামী দলগুলো এক করে একটা বোঝাপড়ার মাধ্যমে এক সঙ্গে হাঁটছে, বন্ধু বা মিত্রের সংখ্যা বাড়াচ্ছে, সেখানে বিএনপি যুগপৎ আন্দোলনের সবচেয়ে সংকটময় সময়ের যাঁরা গুরুত্বপূর্ণ বন্ধু, রাজপথের যাঁরা সঙ্গী, তাঁদের মধ্যে অনাকাঙ্ক্ষিত দূরত্ব সৃষ্টি করছে।
এটা উদ্বেগের। বিএনপি আসলে বন্ধুহীন হওয়ার কৌশল গ্রহণ করল কি না, সে রকম একটা উৎকণ্ঠা দেখা দিয়েছে।’
গত ৩ নভেম্বর ২৩৭টি আসনের সম্ভাব্য প্রার্থী ঘোষণার পর একটি আসনের প্রার্থীর মনোনয়ন বাতিল করে বিএনপি। এরপর গত ৪ ডিসেম্বর ফাঁকা রাখা ৬৪ আসনের মধ্যে আরো ৩৬টি আসনে দলীয় প্রার্থী ঘোষণা করে বিএনপি। ফলে এখন আর ফাঁকা আছে ২৮টি আসন।
যুগপৎ আন্দোলনের দলগুলোর একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তাঁদের অনেক গুরুত্বপূর্ণ নেতার প্রত্যাশিত আসনে দলীয় প্রার্থী ঘোষণা করেছে বিএনপি। কিন্তু এ নিয়ে তাঁদের সঙ্গে কোনো ধরনের আলোচনা করা হয়নি।
যুগপৎ আন্দোলনের সঙ্গী ও ১২ দলীয় জোটের সমন্বয়ক, বাংলাদেশ জাতীয় দলের চেয়ারম্যান সৈয়দ এহসানুল হুদা কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘প্রার্থী ঘোষণার ক্ষেত্রে আমাদের কারো সঙ্গে কোনো ধরনের আলোচনা করা হয়নি। আমাদের সঙ্গে ন্যূনতম আলোচনাও করেনি। বাকি থাকা ২৮টি আসনের মধ্যে হয়তো ১২-১৩টি আসন যুগপৎ সঙ্গীদের জন্য রাখা হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘এনসিপির শীর্ষ নেতাদের আসনগুলোতেও প্রার্থী ঘোষণা করেছে বিএনপি। এতে ধোঁয়াশা সৃষ্টি হয়েছে। উনারা (বিএনপি) কিছুই স্পষ্ট করছে না। ন্যূনতম স্বচ্ছতার দরকার ছিল। আমাদের আসন দেবে না, ঠিক আছে। কিন্তু মিনিমাম একটা কার্টেসির দরকার ছিল।’
তিনি আরো বলেন, ‘১২ দলীয় জোটের ক্ষেত্রে দলীয় প্রতীকে ভোটের কোনো প্রভাবই নেই। কারণ এই জোটের সবাই অনিবন্ধিত। আমরা বাই ডিফল্ট ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে ভোট করতে পারি। আমাদের সঙ্গে যখন কথা হয়, তখন বিএনপি নেতারা বলেছেন, তোমরা তো ধানের শীষ প্রতীক নিয়েই নির্বাচন করবে। আমরা সংবাদ সম্মেলন করে সেখানে একটা চমক দেব।’
এদিকে গতকাল শুক্রবার ১২ দলীয় জোটের প্রধান ও জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান মোস্তফা জামাল হায়দারের খিলগাঁও কার্যালয়ে একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে আগামী নির্বাচন ও যুগপৎ আন্দোলনের সঙ্গী, বিএনপি ঘোষিত ২৭২টি আসনে সম্ভাব্য প্রার্থী মনোনয়ন দেওয়ার বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। ওই সভায়, শরিক দলগুলোর সঙ্গে কোনো আলোচনা না করে প্রার্থী ঘোষণায় বিস্মিত ও ক্ষুব্ধ হয়েছেন জোটের নেতারা। বৈঠকে নেতারা বলেন, ‘বিএনপি শরিকদের সঙ্গে বৈঠকে নির্বাচন ও সরকার গঠনের যে দৃঢ় প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, এই ২৭২টি আসনে মনোনয়ন ঘোষণার মাধ্যমে সেই প্রতিশ্রুতি রাখা হয়নি। জোটের পক্ষ থেকে জানানো হয়, এ বিষয়ে ভবিষ্যৎ রাজনীতি ও করণীয় সম্পর্কে আগামী ৮ ডিসেম্বর এক জরুরি সংবাদ সম্মেলন আয়োজন করা হবে। সেখানে জোটের পক্ষ থেকে সুনির্দিষ্ট ও সুস্পষ্ট বক্তব্য দেওয়া হবে।’
গতকালের ওই সভায় উপস্থিত ছিলেন জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান ও ১২ দলীয় জোট প্রধান মোস্তফা জামাল হায়দার, জোটের সমন্বয়ক বাংলাদেশ জাতীয় দলের চেয়ারম্যান সৈয়দ এহসানুল হুদা, ন্যাশনাল লেবার পার্টির চেয়ারম্যান লায়ন ফারুক রহমান, কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান শামসুদ্দিন পারভেজ, বাংলাদেশ এলডিপির মহাসচিব তমিজ উদ্দিন টিটু ও সিনিয়ার ভাইস চেয়ারম্যান এম এ বাসার, ইসলামিক পার্টির মহাসচিব আবুল কাশেম প্রমুখ।
এদিকে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়ে জোট থেকে বেরিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছে বাংলাদেশ লেবার পার্টি। দলটির পক্ষ থেকে জানানো হয়, গতকাল দুপুরে নয়াপল্টন দলীয় কার্যালয়ে দলটির নির্বাহী কমিটির সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভা শেষে সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে পার্টির চেয়ারম্যান ডা. মোস্তাফিজুর রহমান ইরান এ ঘোষণা দেন।
তবে যুগপৎ সঙ্গীদের সঙ্গে বিএনপি কথা বলবে বলে জানা গেছে। তাঁরা মনে করেন, আলোচনা করার এখনো সময় আছে। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আপনাকে কে কী (যুগপৎ সঙ্গীদের) বলছে সেটার জবাব তো দিতে পারব না। আমাকে জিজ্ঞেস করলে আমি তার জবাব দিতে পারব। আর এখানে এখনো সবকিছু শেষ হয়ে যায়নি। এখনো অনেক কিছু বাকি আছে। তাঁদের সঙ্গে আমরা কথা বলব।’