Image description

আগামী ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও রিটার্নিং অফিসার হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন জেলা প্রশাসকরা (ডিসি)। এই নির্বাচনে রিটার্নিং অফিসারের দায়িত্বে ইসির নিজস্ব কর্মকর্তা নিয়োগের দাবি তুলেছিলেন বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তা ও বিশেষজ্ঞরা। তবে এ দাবি আমলে না নিয়ে রিটার্নিং অফিসারের দায়িত্বে ডিসিদেরই নিয়োগের সিদ্ধান্ত নিয়েছে নির্বাচন কমিশন। নির্বাচন কমিশন সূত্রে এ তথ্যের বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া গেছে।

সূত্র বলছে, আগামী ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ১১ ডিসেম্বর তফসিল ঘোষণা করতে পারে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। নির্বাচন কমিশনের তফসিল অনুযায়ী ৮ থেকে ১২ ফেব্রুয়রি মধ্যে যেকোনো এক দিন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এসব সিদ্ধান্ত আগামীকাল রবিবার কমিশন সভায় গ্রহণ করবে নির্বাচন কমিশন। সেদিনই রিটার্নিং অফিসার নিয়োগের সিদ্ধান্তও আনুষ্ঠানিকভাবে চূড়ান্ত হবে।

নিরাপত্তা, প্রশাসনিক দক্ষতা ও মাঠ পর্যায়ের সমন্বয় সক্ষমতার কারণে রিটার্নিং অফিসারের দায়িত্বে জেলা প্রশাসকদেরই নিয়োগের সিদ্ধান্ত নিয়েছে ইসি।

সূত্র বলছে, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে হওয়া তিনটি নির্বাচনের দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগ সামনে রেখে আগামী নির্বাচনে রিটার্নিং অফিসার হিসেবে নির্বাচন কমিশনের নিজস্ব কর্মকর্তাদের নিয়োগ দেওয়ার দাবি তোলেন ইসির কর্মকর্তারা। এমনকি বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে আয়োজিত সংলাপে এ দাবি উপস্থাপন করেন। এ ছাড়া অন্তর্বর্তী সরকারের আদেশে গঠিত নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিটিও ইসির নিজস্ব কর্মকর্তাদের রিটার্নিং অফিসার করার সুপারিশ করে।

তাদের দাবির কারণে দু-একটি জেলার দায়িত্ব ইসির নিজস্ব কর্মকর্তাদের দেওয়া হবে। তবে এ বিষয়ে এখনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি।

ইসির কর্মকর্তারা বলছেন, ঢাকা ও চট্টগ্রাম মহানগর এলাকার দুই বিভাগীয় কমিশনার এবং দেশের ৬৪ জেলার ডিসিসহ মোট ৬৬ জনকে রিটার্নিং অফিসার হিসেবে নিয়োগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। সহকারী রিটার্নিং অফিসার থাকবেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তারা (ইউএনও)।

এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশনার আব্দুর রহমানেল মাছউদ কালের কণ্ঠকে বলেন, নির্বাচনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদ রিটার্নিং অফিসার এবং প্রিজাইডিং অফিসার।

 
নির্বাচন সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য হতে অনেক কিছু এই দুই পদধারীদের ওপর নির্ভর করে। তাই আমরা এ ব্যাপারে সর্বোচ্চ সতর্ক থাকার চেষ্টা করছি। তবে সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় ধরে নিতে পারেন, এবারও ডিসিদেরই জেলার রিটার্নিং অফিসার হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে।

রিটার্নিং অফিসার হওয়ার দাবি ছিল ইসির কর্মকর্তাদের : নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তাদের বড় একটি অংশ জাতীয় নির্বাচনে রিটার্নিং অফিসার হিসেবে ইসির নিজস্ব কর্মকর্তাদের নিয়োগের দাবি জানিয়ে আসছে। এ দাবিতে দীর্ঘদিন ধরে ইসির কর্মকর্তারা ধারাবাহিকভাবে আন্দোলন করে আসছেন।

ইসি কর্মকর্তাদের ভাষ্য মতে, নির্বাচন কমিশনের কাছে রিটার্নিং অফিসারের ভূমিকা পালনের জন্য যথেষ্ট অভিজ্ঞ কর্মকর্তা রয়েছে। এ ছাড়া ইসির কর্মকর্তারা সফলভাবে স্থানীয় সরকার নির্বাচন এবং উপনির্বাচনগুলো পরিচালনা করেছেন। জাতীয় নির্বাচনের চেয়ে স্থানীয় নির্বাচন আয়োজন করা বেশি চ্যালেঞ্জিং। কারণ এতে বিপুলসংখ্যক ভোটকেন্দ্র ও প্রার্থী জড়িত থাকে। যদি ইসি কর্মকর্তারা স্থানীয় নির্বাচন পরিচালনা করতে পারেন, তবে জাতীয় নির্বাচন কোনো সমস্যা হওয়ার কথা নয়।

কর্মকর্তারা অভিযোগ করেন, ডিসিদের নিয়োগ করা হলেও জাতীয় নির্বাচনের সামগ্রিক অপারেশনাল কাজ ইসি কর্মকর্তারাই সামলান। এর পরও রিটার্নিং অফিসার হিসেবে ডিসিদের অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে।

এ দাবিতে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের আহ্বায়ক মনির হোসেন বলেন, ৩০০ আসনে রিটার্নিং অফিসার হিসেবে দায়িত্ব পালনের জন্য ইসির পর্যাপ্ত কর্মকর্তা রয়েছে। তাই আমরা দাবি করছি, সব রিটার্নিং অফিসার যেন ইসির নিজস্ব কর্মকর্তাদের মধ্য থেকে নিয়োগ করা হয়।

রাজনৈতিক দল ও বিশেষজ্ঞদেরও একই দাবি : ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে নির্বাচন কমিশনের আয়োজিত সংলাপে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও বিশেষজ্ঞরাও ইসির কর্মকর্তাদের রিটার্নিং অফিসারের দায়িত্বে আনার দাবি তোলেন।

এ বিষয়ে গত ১৯ নভেম্বর ইসির সঙ্গে সংলাপে অংশ নিয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আব্দুল মঈন খান বলেন, নির্বাচনে অনেক নির্বাচন কর্মকর্তা প্রয়োজন। ইসির হয়তো পুরো জনবল নেই, কিন্তু যতটুকু আছে, তার সর্বোচ্চ ব্যবহার করতে হবে। ৩০০ আসনে সরকারের কাছ থেকে রিটার্নিং ও সহকারী রিটার্নিং অফিসার ধার না করে ইসির নিজস্ব কর্মকর্তাদের সাহস করে দায়িত্ব দিন। এতে রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তন আসবে।

এ সময় প্রশাসনের প্রভাব ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে চারটি বোতাম থাকে। ডিসি, এসপি, ইউএনও এবং ওসি। সেখান থেকেও এই বোতাম টিপেই ৩০০ আসনের ফলাফল বের করা হয়। এই সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে হলে ইসিকে শক্ত হতে হবে।

এর আগে একই দাবি রেখে বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি (কাঁঠাল প্রতীক) ইসিকে লিখিত প্রস্তাবে জানায়, নির্বাচনকালীন প্রশাসনকে প্রভাবমুক্ত রাখতে ডিসি ও ইউএনওদের পরিবর্তে জেলা ও উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তাদের যথাক্রমে রিটার্নিং ও সহকারী রিটার্নিং অফিসার নিয়োগ করা হোক।

শুধু রাজনৈতিক দল নয়, বিশেষজ্ঞ ও সাবেক কর্মকর্তারাও একই দাবি জানিয়েছিলেন। নির্বাচন বিশেষজ্ঞদের নিয়ে আয়োজিত এক সংলাপে ইসি সচিবালয়ের সাবেক অতিরিক্ত সচিব জেসমিন টুলি বলেন, সময় এসেছে নির্বাচন কর্মকর্তাদের রিটার্নিং অফিসার হিসেবে নিয়োগ দেওয়ার। সবাইকে না দিলেও মিক্স (মিশ্র) করে দেওয়া যেতে পারে। কিছু জেলায় ডিসি এবং কিছু জেলায় ইসি কর্মকর্তারা দায়িত্ব পালন করবেন। ইসি কর্মকর্তারা আইন ভালো জানেন এবং প্রয়োগ করতে পারেন। কেউ সঠিকভাবে কাজ না করলে কমিশন তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারে, যা ডিসিদের ক্ষেত্রে সব সময় সম্ভব হয় না। সরকার বদল হলে ডিসিরা চলে যান।

একই পরামর্শ দিয়ে ইসির সাবেক ভারপ্রাপ্ত সচিব মো. জাকারিয়া বলেন, ইসির নিজস্ব কর্মকর্তাদের স্বল্প সময়ের জন্য ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দিলে তা ফলপ্রসূ হতে পারে।

আরেক সাবেক কর্মকর্তা মো. নুরুজ্জামান তালুকদার বলেন, ইসির দক্ষ কর্মকর্তাদের দায়িত্ব দিলে সরাসরি নিয়ন্ত্রণসহ সব কাজ সুচারুভাবে করা সম্ভব।

দু-একটি জেলার দায়িত্বে আসতে পারেন নির্বাচন কর্মকর্তারা : ডিসিদের রিটার্নিং অফিসারের দায়িত্ব দেওয়া হলেও দু-একটি জেলার দায়িত্বে নিজেদের কর্মকর্তাদের নিয়োগ দেওয়ার বিষয়টি বিবেচনা করছে ইসি।

ইসির সূত্র বলছে, প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং অন্য একজন কমিশনার ইসি কর্মকর্তাদের এই পদে নিয়োগের পক্ষে রয়েছেন। তবে দুজন কমিশনার মনে করেন, মাঠ পর্যায়ে সমন্বয়ের দক্ষতা এবং প্রভাবের কারণে ডিসিরা এই দায়িত্বের জন্য বেশি উপযুক্ত।

সূত্রের দেওয়া তথ্য মতে, নির্বাচন কমিশনের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী দু-একটি জেলায় আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তা এবং কিছু জ্যেষ্ঠ জেলা নির্বাচন কর্মকর্তাকে এই দায়িত্বে নিয়োগ দেওয়া হতে পারে।

নির্বাচন কমিশনের আইন অনুযায়ী, সংসদ নির্বাচনে রিটার্নিং অফিসার নিয়োগে কোনো ধরাবাঁধা নিয়ম নেই। কমিশন চাইলে সরকারি কর্মকর্তা বা সমাজের যেকোনো ব্যক্তিকে এই পদে নিয়োগ দিতে পারে। বর্তমানে স্থানীয় সরকার ও উপনির্বাচনগুলো নিজস্ব কর্মকর্তাদের দিয়ে পরিচালনা করলেও জাতীয় নির্বাচনের ক্ষেত্রে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানটি দীর্ঘদিন ধরে জেলা প্রশাসকদের ওপরই নির্ভর করে আসছে।