Image description

আল–জাজিরার বিশ্লেষণ 

বাংলাদেশের পলাতক সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের দেওয়া মৃত্যুদণ্ডের রায় দেশজুড়ে নতুন আলোচনার জন্ম দিয়েছে। এ রায়ের খবরে সবচেয়ে বেশি আলোড়িত হয়েছেন তরুণ প্রজন্ম—যাঁদের অনেকে গত বছরের সহিংস দমন–পীড়নের প্রত্যক্ষ সাক্ষী।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৪ বছর বয়সী শিক্ষার্থী সীমা আখতার ঠিক এমনই একজন। ফুটবল অনুশীলনের সময় এক বন্ধু তাঁকে এসে জানায়, শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে আদালত মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা করেছে। সীমার কাছে এই রায় ছিল ন্যায়বিচারের এক প্রতীকী মুহূর্ত—কারণ গত বছরের বিক্ষোভে নিরাপত্তা বাহিনীর কঠোর অভিযানে তাঁর কয়েকজন ঘনিষ্ঠ বন্ধু প্রাণ হারিয়েছিলেন।
সীমার ভাষায়, শেখ হাসিনা ভেবেছিলেন তিনি কখনো পরাজিত হবেন না এবং দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকতে পারবেন। তাঁর মতে, মৃত্যুদণ্ডের রায় শহীদদের প্রতি ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার একটি ধাপ মাত্র। সীমার প্রত্যাশা, বিচারের আনুষ্ঠানিকতা যেন ঢাকাতেই বাস্তব রূপ পায়।

২০২৪ সালের আগস্টে ঢাকায় ব্যাপক বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ার পর শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে ভারতে আশ্রয় নেন। কয়েক মাস ধরে বিচারপ্রক্রিয়া শেষে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গত বছর বিক্ষোভ দমনে প্রাণঘাতী অভিযানের নির্দেশনার দায়ে তাঁকে দোষী সাব্যস্ত করে মৃত্যুদণ্ড দেন।

বাংলাদেশের পক্ষ থেকে একাধিকবার দিল্লিকে প্রত্যর্পণের অনুরোধ জানানো হলেও ভারত এখন পর্যন্ত তাঁকে ফেরত দেয়নি। ফলে দুই দেশের মধ্যে গত ১৫ মাস ধরে কূটনৈতিক উত্তেজনা বাড়ছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, মৃত্যুদণ্ডের রায় এই উত্তেজনাকে আরও বাড়িয়ে দিতে পারে।

ভারতের সাবেক হাইকমিশনার পিনাক রঞ্জন চক্রব্রতী পরিষ্কারভাবে প্রশ্ন তুলেছেন—দিল্লি কীভাবে একজন সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে মৃত্যুদণ্ডের মুখোমুখি হতে পাঠাবে? তাঁর মতে, এটি ভারতের কাছে ‘অবন্ধুসুলভ’ পদক্ষেপ বলে মনে হবে।

হাসিনার দীর্ঘ শাসন ও বিতর্কের ইতিহাস

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দেওয়া শেখ মুজিবুর রহমানের বড় মেয়ে শেখ হাসিনা ১৯৯৬ সালে প্রথমবার প্রধানমন্ত্রী হন। ২০০৯ সালে দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় এসে টানা ১৫ বছর দেশ শাসন করেন। এই দীর্ঘ সময় বিরোধী দল প্রায়ই নির্বাচনে অংশ নিতে না পারার অভিযোগ তোলে, পাশাপাশি হয়রানি, গুম-হত্যা, বিচারবহির্ভূত পদক্ষেপ এবং গণগ্রেপ্তারের ঘটনাও ঘন ঘন শোনা যায়।

অর্থনৈতিক অগ্রগতিকে সামনে এনে তিনি শাসনকে বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা করলেও, ২০২৪ সালের কোটা সংস্কার আন্দোলন দেশজুড়ে বিক্ষোভের সূত্রপাত ঘটায়। নিরাপত্তা বাহিনীর কঠোর অভিযানের পর আন্দোলন রূপ নেয় তাঁর পদত্যাগের দাবিতে।

ভারত–বাংলাদেশ সম্পর্কের বদলে যাওয়া সমীকরণ

হাসিনার সঙ্গে ভারতের বহু দিনের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক থাকলেও বর্তমান পরিস্থিতিতে দুই দেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক শীতল হয়ে পড়েছে। বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় মনে করে, প্রত্যর্পণ চুক্তির অধীনে ভারতকে হাসিনাকে ফেরত দিতে হবে—এটাই দিল্লির ‘অবশ্যক দায়িত্ব’। ভারত যদি তাঁকে আশ্রয়ে রাখে, তা হবে ‘অবন্ধুসুলভতা ও ন্যায়বিচারের প্রতি অসম্মান’।

তবে ভারতীয় বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চুক্তিতে রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের ক্ষেত্রে ব্যতিক্রমের সুযোগ রয়েছে। নয়াদিল্লির দৃষ্টিতে মামলাটি রাজনৈতিক প্রতিশোধের অংশ, এবং বর্তমান বাংলাদেশ সরকারকে তারা ‘ভারতবিরোধী’ মনে করে। এই কারণে হস্তান্তর করলে রাজনৈতিকভাবে ভারতের আরও অস্বস্তিকর অবস্থায় পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।

নতুন নির্বাচনের আগে অনিশ্চয়তা

 

ভারত মনে করে, আগামী সালের ফেব্রুয়ারির নির্বাচনের পর দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে পরিবর্তন আসতে পারে। যদিও ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ অংশ নিতে পারছে না। বিএনপিসহ বড় দলগুলো ভারতের সমালোচনামুখর। তবু দিল্লির দৃষ্টিতে নির্বাচিত সরকারই ভবিষ্যৎ সম্পর্কের জন্য বেশি স্থিতিশীল হতে পারে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, ভারতের সামনে এখন দুটি পথ—অতীতের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আঁকড়ে ধরা, অথবা বাংলাদেশের নতুন রাজনৈতিক বলয়ের সঙ্গে সম্পর্ক পুনর্গঠন করা। হাসিনার রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হলেও দক্ষিণ এশিয়ার রাজনৈতিক ইতিহাস বলে, পরিবারকেন্দ্রিক দলগুলো সময়ের সঙ্গে আবার প্রভাব ফিরে পেতে পারে—যে কারণে দিল্লিও বিষয়টিকে পুরোপুরি উপেক্ষা করছে না।

ঐতিহাসিক বন্ধন ও বর্তমান বাস্তবতা

বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে ৪ হাজার কিলোমিটার সীমান্ত, গভীর সংস্কৃতি এবং গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক সম্পর্ক রয়েছে। দীর্ঘ উত্তেজনার মধ্যেও দুই দেশের বাণিজ্য বাড়ছে। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে ভারত বাংলাদেশের পাশে ছিল; হাসিনার ব্যক্তিগত ইতিহাসও ভারত-নির্ভর—৭৫ সালের পর তাঁরা দিল্লিতেই নিরাপত্তা ও আশ্রয় পেয়েছিলেন।

তাই রাজনৈতিক টানাপোড়েন সত্ত্বেও বিশেষজ্ঞদের মতে, দুই পক্ষেরই সম্পর্ক ভাঙার কোনো সুযোগ নেই। তাঁদের মত, হাসিনার প্রত্যর্পণের প্রশ্নকে প্রধান এজেন্ডা থেকে সরিয়ে নিয়ে দীর্ঘমেয়াদি কূটনৈতিক স্থিতি গড়ে তোলাই হবে যৌক্তিক পথ।