জুলাই সনদ ও গণভোট নিয়ে জাতির উদ্দেশে দেওয়া প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহ্ম্মদ ইউনূসের ভাষণকে অনেক দল স্বাগত জানিয়েছে। তবে বিএনপি ও জামায়াত এখানো বিপরীতমুখী অবস্থান করছে। এটার সুরাহা না হলে জাতীয় নির্বাচন সুষ্ঠু হওয়া নিয়ের সংশয় রয়েছে বলে মনে করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।
আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন এবং জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নে গণভোট হবে একই দিনে। চারটি বিষয়ের ওপর একটি প্রশ্নে হবে গণভোট। গণভোটে ‘হ্যাঁ’ জয়ী হলে আগামী সংসদ হবে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট। সংসদ নির্বাচনে দলগুলোর প্রাপ্ত ভোটের অনুপাতে (পিআর পদ্ধতি) ১০০ সদস্য নিয়ে উচ্চকক্ষ গঠিত হবে।
গতকাল বৃহস্পতিবার বেলা আড়াইটায় জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে জুলাই জাতীয় সনদ (সংবিধান সংস্কার) বাস্তবায়নসহ বিভিন্ন বিষয় তুলে ধরেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। জাতীয় নির্বাচন, গণভোটসহ অন্তর্বর্তী সরকারের বিভিন্ন বিষয় তুলে ধরেন তিনি। ভাষণের আগে উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে ‘জুলাই জাতীয় সনদ (সংবিধান সংস্কার) বাস্তবায়ন আদেশ, ২০২৫’
অনুমোদন করা হয়। পরে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন এ আদেশ জারি করেন। এর মধ্য দিয়ে জুলাই সনদ আইনি ভিত্তি পেল।
প্রধান উপদেষ্টা তাঁর ভাষণে বলেন, ‘আমাদের একটি গুরুদায়িত্ব হচ্ছে সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠান। আমি ঘোষণা করেছি, আগামী ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। এই নির্বাচন উৎসবমুখর, অংশগ্রহণমূলক ও সুষ্ঠুভাবে অনুষ্ঠানের জন্য আমরা সব প্রস্তুতি গ্রহণ করছি।’
জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘোষণার পুনর্ব্যক্ত ও জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিনই গণভোটের অনুষ্ঠানের ঘোষণা দেওয়ায় অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে ধন্যবাদ জানিয়েছে বিএনপি। বৃহস্পতিবার (১৩ নভেম্বর) রাজধানীর গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত স্থায়ী কমিটির বৈঠকে এ ধন্যবাদ জানানো হয়।
বৈঠক শেষে করা সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
বিএনপি মহাসচিব বলেন, দলের স্থায়ী কমিটির বৈঠকে গত ১৭ অক্টোবর ঐক্যমতের ভিত্তিতে স্বাক্ষরিত জুলাই জাতীয় সনদের ওপর জনগণের সম্মতি গ্রহণের জন্য গণভোট অনুষ্ঠানের ও যথা শিগগির জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আয়োজন করার জন্য সরকার ও নির্বাচন কমিশনের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে।
সংবাদ সম্মেলনে আরও উপস্থিত ছিলেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, ড. আব্দুল মঈন খান, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী ও সালাহউদ্দিন আহমদ, নজরুল ইসলাম খান, হাফিজ উদ্দিন আহমদ, সেলিমা রহমান, ডা. এ জেড এম জাহিদ হেোসেন।
জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেছেন, জনগণের দাবি ও অভিপ্রায় উপেক্ষা করে প্রধান উপদেষ্টা একই দিনে নির্বাচন ও গণভোটের নির্দেশ দিয়েছেন। এতে জনগণের আকাঙ্ক্ষা পূরণ হয়নি। একই দিন নির্বাচন ও গণভোট হলে সংকট তৈরি হবে। প্রত্যেকটি নির্বাচনে বিশৃঙ্খলা হয়, কেন্দ্রে ঝামেলা হলে গণভোটের কি হবে।
বৃহস্পতিবার (১৩ নভেম্বর) বিকেলে এক সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলেন জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল।
তিনি বলেন, ‘একই দিনে জাতীয় নির্বাচন ও গণভোট আয়োজনের ঘোষণায় সংকটমুক্ত স্বচ্ছ নির্বাচনের আশা করেছিলাম, কিন্তু সেখানে সেই সংকটটা রয়েই গেলো। আমরা এই সংকট নিরসনের জন্য দাবি ও আন্দোলন করে আসছি। কিন্তু সংকট রয়েই গেছে। আমাদের সমমনা দলগুলোও পর্যবেক্ষণ করে প্রতিক্রিয়া জানাবে।’
জামায়াত নেতা বলেন, জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়ন আদেশ জারি এবং আদেশের ওপর নভেম্বর মাসেই গণভোট আয়োজনসহ পাঁচ দফা গণদাবি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে চলমান ও ঘোষিত আট দলীয় কর্মসূচি অব্যাহত থাকবে।
গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুর বলেছেন, ‘জুলাই সনদের ওপর আলাদা গণভোট আয়োজন সম্ভব না। এটি তিন-চার মাস আগে হলে সম্ভব ছিল। এখনকার বাস্তবতায় জাতীয় নির্বাচন অনিবার্য। কোনো অজুহাতে এই নির্বাচন ভণ্ডুল হোক, জাতি তা চায় না। গণভোট আর নির্বাচন একই দিনে দেওয়ায় সরকারকে ধন্যবাদ। এটিই এই মুহূর্তে বাস্তবসম্মত।’
শুক্রবার (১৪ নভেম্বর) সকালে গণঅধিকার পরিষদের কার্যালয়ে প্রধান উপদেষ্টার ভাষণ নিয়ে দলের আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়ায় তিনি এসব কথা বলেন।
নুরুল হক নুর বলেন, ‘জুলাই সনদ বাস্তবায়ন ইস্যুতে অনেক ভিন্নমত ছিল। প্রধান উপদেষ্টার ভাষণে সব সংশয় অনেকটাই কেটে গেছে। তিনি সবার মতামতকেই গুরুত্ব দিয়েছেন।’
তিনি বলেন, ‘ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচন নিয়ে আর কোনো ধোঁয়াশা রইল না। এটি এখন বানচাল হতে পারে রাজনৈতিক দলগুলোর বিভাজনের কারণে।’
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসকে তিনজন উপদেষ্টা ‘বিপথে চালিত’ করছেন বলে দাবি করে তাদের অপসারণ চেয়েছেন জামায়াতের ইসলামীর নায়েবে আমির সৈয়দ আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের। শুক্রবার (১৪ নভেম্বর) সকালে রাজধানীর মগবাজারে জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে আট দলের যৌথ সংবাদ সম্মেলনে এ দাবি করেন তিনি।
জাতীয় নির্বাচনের আগে আলাদাভাবে গণভোটের তারিখ ঘোষণাসহ তিন দফা দাবি তুলে ধরে জামায়াতের নায়েবে আমির সৈয়দ আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেন, ‘আমরা পরিষ্কার করে এখন বলতে চাই, এক. প্রধান উপদেষ্টা জাতির উদ্দেশে যে ভাষণ দিয়েছেন…একই দিনে নির্বাচন গণভোট এবং জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠান, সেটা পরিবর্তন করে অনতিবিলম্বে আলাদাভাবে গণভোট করার তারিখ উনি ঘোষণা করবেন, এটা আমরা আশা করি।’
তিনি বলেন, ‘দুই. সরকারে কমপক্ষে তিনজন উপদেষ্টা আছেন যারা প্রধান উপদেষ্টাকে মিসগাইড করছেন, আমরা তাদের অপারেশন দাবি করছি। আপনারা হয়তো প্রশ্ন করবেন যে তাদের নাম বলেন। আমরা আজকেও নাম বলতে চাই না। তবে প্রধান উপদেষ্টার কাছে তাদের নাম আমরা প্রেরণ করব।’
জামায়াতের এ নেতা বলেন, ‘তিন. প্রশাসনের যে সমস্ত পরিবর্তন হচ্ছে সেখানে নিরপেক্ষ, বিশেষ করে সৎ এবং জবাবদিহির আওতায় থাকতে পারে এরকম মনোভাবের লোকদেরকেই নিয়োগ করতে হবে। নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করার জন্য সেখানে চেষ্টা করতে হবে। আমরা এই তিন দাবি জানাচ্ছি।’
ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের আমির মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ রেজাউল করীম বলেছেন, বারবার আওয়ামী লীগ, বিএনপি-জাতীয় পার্টির শাসন দেখেছি। নতুনভাবে পুরান বউ নতুন শাড়িতে আমাদের সামনে প্রদর্শন করার প্রয়োজন নেই। কারণ যখন মুখ থেকে কাপড় উঠাবে, দেখবে পুরান বউয়ের নতুন শাড়ি। বারবার আপনারা ধোকা খেলে দেশ আর সুন্দর হবে না, চাঁদাবাজি বন্ধ হবে না, খুন বন্ধ হবে না, টাকা পাচার করা বন্ধ হবে না। দেশ যদি সুন্দর চান, ইসলামকে যদি রাষ্ট্রের ক্ষমতায় নিতে চান। দুর্নীতিবাজ, টেন্ডারবাজ, চাঁদাবাজ, খুনীদের কাছ থেকে যদি দেশকে রক্ষা করতে হয়, তাহলে ইসলামকে ক্ষমতায় নিতে হবে। বাংলার জমিন থেকে চাঁদাবাজদের কবর রচনা করতে হবে।
শুক্রবার (১৪ নভেম্বর) সন্ধ্যায় লক্ষ্মীপুর জেলা শহরে এন আহম্মদিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে পিআর পদ্ধতিতে জাতীয় নির্বাচনসহ ৫ দফা দাবিতে আয়োজিত জনসভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন। ইসলামী আন্দোলন জেলা কমিটির ব্যানারে এ আয়োজন করা হয়।
রেজাউল করীম বলেন, ‘বিদেশিদের দালালি, পাশের রাষ্ট্রসহ তাদের প্রেসক্রিপশনে যেন আমাদেরকে আর না চলতে হয়। আমরা যেন গোলামের জিঞ্জিরা আর হাতে না লাগাই। এই জিঞ্জিরা থেকে মুক্তি পাওয়ার সুযোগ এসেছে ৫ আগস্টের পরে। জালেমদের থেকে, চাঁদাবাজ থেকে এবং বিদেশের তাবেদার থেকে যদি আমাদের সুন্দর দেশটাকে স্বর্ণের দেশে তৈরি করতে হয়, ইসলামকে গাছ হিসেবে দাঁড় করতে হয়, যারা দেশপ্রেমিক, ইসলাম প্রেমিক, মানবতা প্রেমীরা একত্রিত হয়ে ক্ষমতা প্রেমিকদেরকে বাংলার জমিন থেকে উৎখাত করে সমুদ্রে ফেলতে হবে।’
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনে গিয়ে বিএনপি গুন্ডামি করেছে বলে মন্তব্য করেছেন জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) মুখ্য সমন্বয়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী। শুক্রবার (১৪ নভেম্বর) রাতে দলের অস্থায়ী কার্যালয়ে জুলাই সনদ বাস্তবায়ন আদেশের ব্যাপারে আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া জানাতে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ মন্তব্য করেন।
নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী বলেন, ‘জুলাই সনদে রাজনৈতিক দলগুলো স্বাক্ষর করেছিল। সেখানে কিন্তু নোট অব ডিসেন্ট ছিল। জুলাই সনদটা কীভাবে বাস্তবায়নের মতো আইনি ভিত্তির প্রয়োজন আমরা কিন্তু এই দাবিটা তুলেছিলাম। পরে রাজনৈতিক অঙ্গনে সব জায়গায় আলোচনাটা শুরু হয়। সবাই এটা বুঝে যে, আসলে একটা বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া প্রয়োজন বা আইনি ভিত্তি প্রয়োজন।’
তিনি বলেন, ‘সরকার আইনি ভিত্তি দিয়েছে। সরকার এখানে দরদ দেখিয়েছে, কিন্তু সরকার কোনো দায় দেখায়নি। অর্থাৎ আপনার যখন কোথাও কম্পেশন থাকবে আপনার রেসপন্সিবিলিটি নিতে হবে। সরকার এখানে তরকারি বাটি থেকে রাজনৈতিক দলগুলোকে এক চামচ, এক চামচ করে ভাগ করে দিয়েছে। বিএনপিকে এক চামচ দিয়েছে, জামায়াতকে এক চামচ দিয়েছে কিন্তু জনগণের প্লেট, ওটা খালি হয়ে গেছে।’
জাতির উদ্দেশে দেওয়া প্রধান উপদেষ্টার ভাষণ স্বাগত জানিয়েছে আমার বাংলাদেশ পার্টি (এবি পার্টি)। তবে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত বা আদেশের কিছু বিষয়ে ভিন্নমত রয়েছে দলটির।
বৃহস্পতিবার (১৩ নভেম্বর) বিকেলে প্রধান উপদেষ্টার ভাষণের তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় দলটির চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান মঞ্জু ও সাধারণ সম্পাদক ব্যারিস্টার আসাদুজ্জামান ফুয়াদ এক বিবৃতিতে এ কথা জানান।
তারা বলেন, ‘আমাদের যার যা মত থাকুক না কেন, সরকার বা ড. মুহাম্মদ ইউনূস যেহেতু সব দিক বিবেচনা করে একই দিনে গণভোট ও জাতীয় নির্বাচন, উচ্চকক্ষে সংখ্যানুপাতিক ভোটের হিসেবে আসন নির্ধারণ এবং গণভোটে একমত ও ভিন্নমতকে অন্তর্ভুক্ত করে ব্যালট তৈরিসহ চূড়ান্ত কিছু নির্দেশনা দিয়েছেন।’
এবি পার্টির শীর্ষ দুই নেতা বলেন, ‘আমরা মনে করি, এটা এখন একটি অপেক্ষাকৃত গ্রহণযোগ্য সমাধান। সার্বিক বিচারে এই ঘোষণাকে আমরা ইতিবাচক হিসেবে দেখি। আমরা প্রথম থেকেই বলে আসছিলাম রাজনৈতিক দলগুলো যেহেতু পর্যাপ্ত যুক্তিতর্ক ও আলোচনা ইতোমধ্যে শেষ করেছে, তাই এখন সরকারের একটি সমাধানমূলক সিদ্ধান্ত দেওয়া এবং রাজনৈতিক দলগুলোর সেটা মেনে নেওয়া ছাড়া আর কোনো পথ নেই।’
তারা আশা প্রকাশ করেন বলেন, ‘বিএনপি, জামায়াতসহ সব রাজনৈতিক দল বিভেদ পরিহার করে একটি সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও আনন্দমুখর পরিবেশে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে এবং দেশকে একটি স্থিতিশীল গণতান্ত্রিক পথে পরিচালনা করবে।’