ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে করা গণহত্যা মামলার রায় কবে হবে, তা জানা যাবে ১৩ নভেম্বর। ওইদিনকে কেন্দ্র করে বড় ধরনের নাশকতা ও বিশৃঙ্খলার নীলনকশা এঁকেছে তার দল কার্যক্রমনিষিদ্ধ আওয়ামী লীগ। তাদের লক্ষ্য, সহিংস পরিস্থিতি তৈরি করে বিচারপ্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত করা। এ পরিকল্পনার সমন্বয় করা হচ্ছে প্রতিবেশী দেশ ভারত থেকে।
নিরাপত্তা-সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ঢাকায় নাশকতা পরিকল্পনার মূল সমন্বয়ক হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে ভারতে পলাতক সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালকে। তাকে কৌশলগত সব সহযোগিতা দেওয়ার জন্য দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে এসবির সাবেক প্রধান, ভারতে পলাতক পুলিশের অতিরিক্ত আইজি মনিরুল ইসলাম এবং ডিএমপির পলাতক কমিশনার হাবিবুর রহমানকে। এসএসএফের সাবেক ডিজি ও সাবেক কিউএমজি লে. জেনারেল (অব.) মুজিবুর রহমানসহ একাধিক সেনা কর্মকর্তা এই প্রক্রিয়ায় যুক্ত আছেন।
সূত্র আরো জানায়, তাদের সঙ্গে সমন্বয় করে ঢাকায় অস্থিরতা তৈরির মিশন বাস্তবায়নের প্রস্তুতি নিচ্ছে পলাতক সাবেক ছাত্রলীগ সভাপতি লিয়াকত শিকদার, গাজীপুরের সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর আলম এবং যুবলীগ নেতা ইসমাইল চৌধুরী সম্রাট ওরফে ক্যাসিনো সম্রাট। এ লক্ষ্যে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে বাছাইকৃত নেতাকর্মীদের ঢাকায় আনা হচ্ছে।
জানা গেছে, বাংলাদেশবিরোধী তৎপরতা চালাতে দিল্লিতে একটি অফিস নেওয়া হয়েছে। কলকাতায় অফিস নেওয়ার খবরও এর আগে গণমাধ্যমে এসেছিল। পরিকল্পনাকারীরা সেখানে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’-এর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রেখে সব পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করার কাজ চালাচ্ছে বলে বিশ্বস্ত সূত্রে তথ্য মিলেছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, হাসিনার প্রতি নেতাকর্মীদের আবেগকে কাজে লাগাতে চায় পরিকল্পনাকারীরা। এই আবেগকে পুঁজি করে তাদের ১৩ নভেম্বর মাঠে নামানোর কৌশল নেওয়া হয়েছে। এ লক্ষ্যে সারা দেশে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে পারদর্শী এবং আওয়ামী লীগের কট্টর নেতাকর্মীদের ইতোমধ্যেই বাছাই করা হয়েছে। তাদের দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রশিক্ষণও দেওয়া হয়।
নিরাপত্তা সূত্রে জানা যায়, রাজধানীর অন্তত পাঁচটি স্থানে নাশকতার ডিজিটাল প্রশিক্ষণ ও যোগাযোগ কৌশলের ট্রেনিং দেওয়া হয় বাছাই করা এসব ক্যাডারকে। এই প্রশিক্ষণ দেওয়ার ঘটনায় ইতোমধ্যে মেজর সাদিকুল হক সাদেককে গ্রেপ্তার করে বিচারের মুখোমুখি করেছে সেনাবাহিনী। গোপালগঞ্জে অনুকূল পরিবেশে প্রশিক্ষণের কিছু তথ্য পেয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এর পরিপ্রেক্ষিতে দেশে অবস্থান করা কয়েকজন সাবেক ও বর্তমান পুলিশ কর্মকর্তার ওপর নজরদারি বাড়াতে বলা হয়েছে। এর মধ্যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীতে লুকিয়ে থাকা ফ্যাসিবাদের দোসরদের ওপরও নজরদারি বাড়ানো হয়েছে।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, নাশকতায় আওয়ামী লীগ অবৈধ অস্ত্র ব্যবহারের ভয়ঙ্কর পরিকল্পনা করেছে। গত মাসে ঢাকা বিমানবন্দর রেলস্টেশন এলাকায় অস্ত্রের একটি চালান আটক করে সেনাবাহিনীর স্বতন্ত্র ৪৬ ব্রিগেড। আশঙ্কা করা হচ্ছে, এমন আরো চারটি অস্ত্রের চালান দেশে ঢুকতে পারে। পাশাপাশি ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট দেশের বিভিন্ন থানা, পুলিশ ফাঁড়ি ও পুলিশ লাইনসগুলো থেকে খোয়া যাওয়া অস্ত্রগুলো ব্যবহার হতে পারে বলেও আশঙ্কা করা হচ্ছে। এমনকি আওয়ামী আমলে দলীয় বিবেচনায় মুজিববাদীদের যেসব অস্ত্রের লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে, যেগুলো এখনো জমা দেওয়া হয়নি; সেগুলোর ব্যবহার নিয়েও শঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। অন্তর্বর্তী সরকার লাইসেন্স করা অস্ত্রগুলো জমা দেওয়ার নির্দেশনা জারি করে। কিন্তু সর্বশেষ খবরে জানা গেছে, সব অস্ত্র জমা পড়েনি।
মহাসড়ক অচল করার পরিকল্পনা
নিরাপত্তা সূত্র জানায়, ১৩ নভেম্বর ঘিরে মহাসড়ক অচল করে দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে আওয়ামী লীগের। এ ক্ষেত্রে গাজীপুর চৌরাস্তা থেকে উত্তরা পর্যন্ত মহাসড়কের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর আলমকে। কাঁচপুর থেকে যাত্রাবাড়ী পর্যন্ত অবরোধ করার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে লিয়াকত শিকদারকে। ঢাকার ভেতরে অগ্নিসংযোগ ও সংঘর্ষ-পরিকল্পনায় নিয়োজিত থাকছে সম্রাট। এদিন লক্ষাধিক লোকের সমাগম করার পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে দলটি। ১২ নভেম্বর সন্ধ্যার পর জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টির লক্ষ্যে ঝটিকা মিছিল ও পরিবহনে অগ্নিসংযোগের পরিকল্পনা রয়েছে। আদালতপাড়াসহ সরকারি গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর স্থাপনাগুলোকে টার্গেট করে এবং সেগুলোর আশপাশের এলাকায় বোমাবাজি ও ককটেল বিস্ফোরণ ঘটানোর ছকও আঁকছে দলটি।
সূত্র আরো জানায়, বিশৃঙ্খলার কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে গোপালগঞ্জ, মাদারীপুর ও শরীয়তপুর বিশেষভাবে বিবেচিত হচ্ছে। চলতি নভেম্বরের মধ্যেই হাসিনার গণহত্যা মামলার রায় ঘোষণা হতে পারে। রায় ঘোষণা হলে এ অঞ্চলে বিশাল শোডাউন ও আন্দোলন হবে, যাতে আন্তর্জাতিক ও দেশি মিডিয়ায় দ্রুত প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। টার্গেট করা হয়েছে বিদেশি মিডিয়া ও সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে ভিডিও এবং সংবাদ প্রচার করার। এসব সংবাদ ও ভিডিওকে পুঁজি করে ভারতীয় এজেন্সি ইউরোপ-আমেরিকার এস্টাবলিশমেন্টের দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করা হবে।
নিরাপত্তা সংস্থার সুপারিশ ও প্রস্তুতি
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে ব্যর্থ হিসেবে প্রমাণ করার জন্য বহু চেষ্টা করা হয়েছে গত এক বছরে। যার প্রায় সবগুলোই বিফলে গেছে বলে মত সংশ্লিষ্টদের। এখন হাসিনার রায় ঘোষণাকে কেন্দ্র করে বিশৃঙ্খলা করতে চাইছে আওয়ামী লীগ।
এ অবস্থায় আপাতত সেনাবাহিনীর সদস্যদের মাঠ থেকে তুলে না নিতে নিরাপত্তা-সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো থেকে সরকারের উচ্চপর্যায়ে সুপারিশ করা হয়েছে। সম্প্রতি আইনশৃঙ্খলা-সংক্রান্ত কোর কমিটির সভায় মাঠ পর্যায়ে দায়িত্বরত সেনাসদস্যদের ৫০ শতাংশ উঠিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্তের কথা জানানো হয়েছিল। নিরাপত্তা সংস্থাগুলোর পরামর্শ হচ্ছে, অন্তত চলতি নভেম্বর অথবা যতদিন হাসিনার মামলার রায় না হবে, ততদিন যেন মাঠ পর্যায়ে সেনা মোতায়েন থাকে।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সূত্রে জানা যায়, দেশব্যাপী আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, র্যাব ও গোয়েন্দা ইউনিটগুলোকে সতর্ক অবস্থায় থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। রায় ঘোষণার আগের এবং পরবর্তী তিনদিন ‘উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ সময়’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। গোপালগঞ্জ, মাদারীপুর, শরীয়তপুর, নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুরে সেনা এবং বিজিবি যৌথ টহল দেবে। গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানো হয়েছে ঝুঁকিপূর্ণ স্থানগুলোতে।
নিরাপত্তা সূত্র আরো জানায়, হাসিনার রায়কে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক উত্তেজনা স্বাভাবিকভাবেই বাড়বে। এ সুযোগে যদি কোনো সংগঠিত গোষ্ঠী অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করতে পারে, তাহলে তা দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ও আন্তর্জাতিক ভাবমর্যাদা দুদিকেই ঝুঁকি বাড়বে। সরকারের ভেতরে কিছু অসন্তুষ্ট অংশ বা বাহিনী যদি সক্রিয় হয়, তাহলে পরিস্থিতি আরো জটিল হয়ে উঠতে পারে। গত কয়েকটি প্রচেষ্টা সফল না হওয়ায় এবার এই রায়ের সময়কে নির্বাচন করা হয়েছে বলেই মনে করছেন তারা।
নিরাপত্তা বিশ্লেষক লে. কর্নেল (অব.) দিদারুল আলম আমার দেশকে বলেন, দেশের ভেতর থেকে হোক বা বাইরে থেকে-নাশকতা ও বিশৃঙ্খলার অপচেষ্টা হতে পারে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সব ধরনের নাশকতার চেষ্টা জনগণকে সঙ্গে নিয়ে মোকাবিলা করতে হবে। এ ধরনের কর্মকাণ্ড আগামী নির্বাচন বানচালের অপচেষ্টাও হতে পারে।
এ বিষয়ে পুলিশ সদর দপ্তরের সহকারী মহাপরিদর্শক (এআইজি-মিডিয়া) এএইচএম শাহাদাত হোসেন আমার দেশকে বলেন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ঠিক রাখতে প্রয়োজনীয় নজরদারি ও আগাম তথ্যের ভিত্তিতে গোয়েন্দা তৎপরতা আছে। অবৈধ কর্মকাণ্ড, নাশকতা বা সংঘর্ষের চেষ্টা হলে তাৎক্ষণিক আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।