Image description
 

ঘূর্ণিঝড় মোন্থার প্রভাবে নভেম্বরের শুরুতেই দেশের নানা প্রান্তে ভারী বৃষ্টিতে আমন ধানসহ নানা ফসলের ক্ষতি হয়েছে। কৃষকরা সেই ক্ষতি না সামলাতেই চলতি মাসে আরও দুই থেকে তিনটি নিম্নচাপের আশঙ্কা রয়েছে, যার একটি ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত হতে পারে। ফলে নতুন করে ভারী বৃষ্টিপাতের আশঙ্কায় কৃষকদের মধ্যে ফের উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। 

কৃষকরা বলছেন, এক বৃষ্টির ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে না উঠতে যদি আবার নতুন নিম্নচাপ হয়, তাহলে জমিতে টানা পানিতে ফসলের রোগবালাই ছড়িয়ে পড়বে। শীতকালীন ফসলের চারা নষ্ট হবে। আমনের উৎপাদন কমে যেতে পারে। সময়মতো সরকারি সহায়তা, বীজ ও আবহাওয়ার সঠিক তথ্য না পেলে এই ক্ষতি পুষিয়ে ওঠা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়বে।

 
 

অসময়ের বৃষ্টিতে ডুবে গেছে পাকা ধান
আবহাওয়া অধিদপ্তর জানিয়েছে, নভেম্বর মাসে আরও দুই-তিনটি নিম্নচাপ তৈরি হতে পারে, যার মধ্যে একটি ঘূর্ণিঝড়ে রূপ নিতে পারে। আবহাওয়াবিদ মো. মমিনুল ইসলাম বলেন, নভেম্বর থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত দেশে স্বাভাবিকের তুলনায় কিছুটা বেশি বৃষ্টিপাত হতে পারে। এই সময়ে সাগরে দুই থেকে চারটি লঘুচাপ সৃষ্টি হতে পারে, যার দুটি রূপ নিতে পারে ঘূর্ণিঝড়ে।

কৃষি মন্ত্রণালয়ের হিসাব বলছে, রাজশাহী ও রংপুর বিভাগের ১৬টি জেলায় ঝড় ও বৃষ্টিতে গত বৃহস্পতিবার থেকে রোববার পর্যন্ত প্রায় ২৬ হাজার হেক্টর ফসলি জমি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর মধ্যে ২১ হাজার হেক্টর জমির আমন ধান বেশি ক্ষতির মুখে। সবজি ১ হাজার ৬০০ হেক্টর, পেঁয়াজ ৫৫২ হেক্টর এবং ১ হাজার ৩৪৮ হেক্টর জমিতে সরিষার ক্ষতি হয়েছে।

 

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর জানিয়েছে, এ বছর ৫৭ লাখ হেক্টর জমিতে আমন ধানের আবাদ হয়েছে, যার মধ্যে মাত্র ১.৭৬ লাখ হেক্টরের ধান কাটা শেষ। বাকি জমির ধান এখন পরিপক্ব অবস্থায়। কিন্তু পানিতে ডুবে যাওয়ায় ধান হেলে পড়ছে ও চিটা বেড়ে যাচ্ছে।

বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের (ব্রি) পরিচালক ড. মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, এ সময়ের বৃষ্টিতে ধান গাছ হেলে পড়লে উৎপাদনে বড় ধরনের প্রভাব পড়ে। পরিপক্ব না হলে চিটা বেড়ে যাবে। আর পরিপক্ব ধান পড়লে ইঁদুরে খেয়ে ফেলবে। এর মানও কমে যাবে।

কৃষি অধিদপ্তরের মাঠ পর্যায়ের পরিচালক ওবায়দুর রহমান মণ্ডল জানান, প্রাথমিক হিসেবে ১১ হাজার হেক্টর জমির ধান আক্রান্ত। ক্ষতির পরিমাণ পুরোপুরি জানা যায়নি। তবে যেসব জমিতে ধান পড়েছে, সেখানে ৫ থেকে ২৫ শতাংশ পর্যন্ত উৎপাদন কমবে।

আলুচাষিদের দুঃসময় কাটছেই না, রবি মৌসুম পিছিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা
এবার আলুর উৎপাদন বেশি হলেও দাম না থাকায় কৃষকরা বড় লোকসানে পড়েছেন। কেউ কেউ কেজিতে ১৫-২০ টাকা পর্যন্ত ক্ষতি গুনেছেন। সেই ধাক্কা না সামলাতেই এ বৃষ্টিতে আবারও বিপাকে তারা। যেসব কৃষক আগাম আলু রোপণ করেছিলেন, অনেকেই জমি থেকে বীজ তুলে ফেলছেন, পচে যাওয়ার আগেই বাঁচানোর চেষ্টায়। কারও কারও বীজ আলু ইতোমধ্যে নষ্ট হয়ে গেছে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, এখন পর্যন্ত প্রায় ২৩ হাজার হেক্টর জমিতে আগাম আলু রোপণ করা হয়েছে। কিন্তু চলমান ক্ষতির কারণে অনেকে এবার চাষ থেকে সরে আসার চিন্তায় আছেন।

শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদ রোগতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক আবু নোমান ফারুক আহম্মেদ বলেন, আবহাওয়ার পূর্বাভাস কৃষকের হাতে সময়মতো পৌঁছানো অত্যন্ত জরুরি। 

কৃষি অর্থনীতিবিদ ড. জাহাঙ্গীর আলম মনে করেন, সবজি যেহেতু স্বল্পমেয়াদি ফসল, তাই ক্ষতি হলেও দ্রুত পুনরায় চাষ করা সম্ভব। তবে এই বৃষ্টির কারণে আলুর আবাদ কিছুটা দেরি হবে।

রাজশাহীর তানোর উপজেলার কৃষক আব্দুর রহমান বলেন, বছরের পর বছর বৃষ্টি-ঝড়ের এই অস্বাভাবিকতা এখন নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমরা বুঝে উঠতে পারি না, কখন ফসল বাঁচাতে হবে, কখন লাগাতে হবে।

কানাডার ইউনিভার্সিটি অব সাসকাচোয়ানের জলবায়ুবিদ মোস্তফা কামাল পলাশ বলেন, পৃথিবীর তাপমাত্রা প্রতি ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়লে বাতাসে জলীয় বাষ্পের পরিমাণ প্রায় ৭ শতাংশ বাড়ে। এই অতিরিক্ত আর্দ্রতাই এখনকার অস্বাভাবিক ভারী বৃষ্টির মূল কারণ। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে এখন ঘূর্ণিঝড় ও নিম্নচাপ ধীরে অগ্রসর হয় এবং স্থলভাগে এসে দীর্ঘ সময় স্থায়ী থাকে। ফলে ক্ষয়ক্ষতি বেড়ে যায়।