Image description

১৫ দিনের বিদেশ সফর শেষে গত ৪ নভেম্বর ভোরে দেশে ফিরছেন বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমীর ডা. শফিকুর রহমান। গত ১৯ অক্টোবর সৌদি আরবে পবিত্র ওমরা পালন, তুরস্ক, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য সফরের উদ্দেশ্যে তিনি ঢাকা ত্যাগ করেছিলেন। সফরের মধ্যে তিনি বিভিন্ন নাগরিক সংবর্ধনা ও কর্মসূচিতে অংশ নেন এবং রাজনৈতিক বক্তব্যও দেন। সেই সঙ্গে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ও সংগঠনের সঙ্গেও মিটিং করেছেন জামায়াত আমীর। জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে জামায়াতে ইসলামীর আমীরের এ সফর রাজনৈতিক মহলে বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করছেন রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টরা। নির্বাচনের আগে নেতাকর্মীদের চাঙা রাখার পাশাপাশি প্রবাসী ভোটের সমর্থন যোগাতেও ভূমিকা রাখবে এই সফর বলে মনে করেন তারা।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ডা. শফিকুর রহমানের বিদেশ সফর আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রেক্ষাপটে বেশ গুরুত্বপূর্ণ। তাদের মতে, জামায়াতের আমীরের গুরুত্বর্পূর্ণ তিনটি দেশ সফর তার দলের আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক অবস্থান শক্তিশালী করার একটি প্রচেষ্টাও হতে পারে। তুরস্ক, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যে রাজনৈতিক বক্তব্য প্রদান এবং নাগরিক সংবর্ধনায় অংশগ্রহণের মাধ্যমে জামায়াত তার রাজনৈতিক ভাবমূর্তি পুনর্গঠন করার চেষ্টা করেছে। বিশেষত, দেশের রাজনীতিতে নিজেদের অবস্থান এবং রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনার মাধ্যমে তারা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নিজেদের অবস্থান জোরালো করতে চায়। 

জামায়াতের আমীরের এ সফরের মাধ্যমে প্রবাসী ভোটারদের কাছে নিজেদের অবস্থান স্পষ্ট করতে এবং তাদের সমর্থন সংগ্রহ করতে চাইছেন। বিশেষ করে, প্রবাসী বাংলাদেশিরা একটি গুরুত্বপূর্ণ ভোটব্যাংক, যাদের সমর্থন যে কোনো রাজনৈতিক দলই নির্বাচনে প্রভাব ফেলতে পারে। -রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক ড. মো. সাহাবুল হক

 

এছাড়া জামায়াতের আমীরের এই সফর দলের ভবিষ্যৎ কৌশল এবং নির্বাচনকালীন রাজনৈতিক গেমপ্ল্যানের অংশ হতে পারে। জাতীয় নির্বাচনের আগে জামায়াত আন্তর্জাতিক সমর্থন এবং কূটনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা পেতে চাইছে, যা তাদের রাজনৈতিক শক্তি বাড়ানোর ক্ষেত্রে সহায়ক হতে পারে। বিশেষ করে গত বছরের জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর থেকে অন্তর্বর্তী সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের একধরনের ইতিবাচক মনোভাব রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন সংস্থার প্রতিনিধিরা বেশ কয়েকবার জামায়াতের আমির ও দলটির নেতা-নেত্রীদের সঙ্গে দেখাও করেছেন। সেই সঙ্গে প্রবাসী ভোটারদের যে, বৃহৎ একটি ভোট ব্যাংক রয়েছে। সেটির সমর্থনও পেতেও কিন্তু এ সফর ভূমিকা রাখবে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পলিটিক্যাল স্টাডিজ বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ড. মো. সাহাবুল হক বলেন, নির্বাচনের আগে জামায়াতের আমীরের তিনটি দেশ ভ্রমণ করা সংগঠনটির জন্য তাৎপর্যপূর্ণ। এটি একটি রাজনৈতিক সফরও বটে। প্রথমত, জামায়াতের আমীরের এ সফরের মাধ্যমে প্রবাসী ভোটারদের কাছে নিজেদের অবস্থান স্পষ্ট করতে এবং তাদের সমর্থন সংগ্রহ করতে চাইছেন। বিশেষ করে, প্রবাসী বাংলাদেশিরা একটি গুরুত্বপূর্ণ ভোটব্যাংক, যাদের সমর্থন যে কোনো রাজনৈতিক দলই নির্বাচনে প্রভাব ফেলতে পারে। দ্বিতীয়ত, দেশের বাইরে গিয়ে জামায়াত নেতাকর্মীদের মনোবল চাঙা রাখা এবং দলীয় নেতৃত্বকে শক্তিশালী করে তোলাও হতে পারে। এর মাধ্যমে দলটি তাদের সমর্থকদের মাঝে একতা এবং অনুপ্রেরণা সৃষ্টি করতে পারবে।

 

তিনি বলেন, ‘আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো, এই সফরের মাধ্যমে জামায়াত আন্তর্জাতিক পরিপ্রেক্ষিতে নিজেদের অবস্থান আরও দৃঢ় করতে চাচ্ছে। বিভিন্ন দেশের সরকারী কর্মকর্তা এবং প্রভাবশালী ব্যক্তিদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করার মাধ্যমে দলটি তাদের কূটনৈতিক সম্পর্ক এবং বৈদেশিক সম্পর্ক উন্নত করার চেষ্টা করছে। এসব বৈঠক কেবল নির্বাচনী কৌশল নয়, বরং দল বা দেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক স্বার্থও রক্ষাও হতে পারে। জামায়াত আমীরের এই সফরকে নির্বাচনী প্রস্তুতির অংশ হিসেবে দেখতে পারেন, যেখানে তারা শুধু প্রবাসী ভোটারদের সমর্থন সংগ্রহই করছে না, বরং আন্তর্জাতিক মহলেও নিজেদের শক্তি প্রমাণ করার চেষ্টা করছে।’

বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, জামায়াতে ইসলামীর আমীরের যুক্তরাষ্ট্র সফর শুধু সাংগঠনিক দৃষ্টিকোণ থেকে নয়, বরং রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকেও গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে, বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে এই সফরের কূটনৈতিক প্রভাব ব্যাপক হতে পারে। যুক্তরাষ্ট্র এবং যুক্তরাজ্যের শীর্ষ নীতিনির্ধারকদের কাছে জামায়াত তাদের রাজনৈতিক অবস্থান এবং ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা পৌঁছানোর চেষ্টা করছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এমনকি এই সফরের মাধ্যমে জামায়াত আন্তর্জাতিক মঞ্চে তাদের কৌশলগত বার্তা প্রদানের চেষ্টা চালাচ্ছে, যা বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে কিছুটা প্রভাব ফেলতে পারে।

এই সফরগুলো একদিকে যেমন সামাজিক সম্পর্ক উন্নয়নে সহায়তা করে, তেমনি রাজনৈতিক হিসাব-নিকাশও থাকতে পারে। এসব সফরের মাধ্যমে দলের সঙ্গে সম্পর্ক বৃদ্ধি এবং রাজনৈতিক বোঝাপোড়ার প্রচেষ্টা থাকতে পারে।
-আইনুল ইসলাম, রাজনৈতিক বিশ্লেষক

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ড. মো. আইনুল ইসলাম মনে করেন, বাংলাদেশের প্রতি বিশ্বব্যাপী আগ্রহ ক্রমেই বাড়ছে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিবেশে পরিবর্তন ঘটছে এবং এ পরিবর্তন বিশ্বে বাংলাদেশের বন্ধু রাষ্ট্রগুলো এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রেও মেরুকরণের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এই মেরুকরণ প্রক্রিয়া মূলত রাজনৈতিক দলগুলোর দিকে মনোযোগ কেন্দ্রীভূত হচ্ছে। বিভিন্ন দেশের সংস্থা বা কূটনৈতিক মহল রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে তাদের অফিসে বা অন্যান্য জায়গায় সাক্ষাৎ করছেন, যা প্রমাণ করে যে, এসব দেশ এবং সংগঠনগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে একটি আগ্রহ রয়েছে।

অধ্যাপক আইনুল ইসলাম আরও বলেন, এই সফরগুলো একদিকে যেমন সামাজিক সম্পর্ক উন্নয়নে সহায়তা করে, তেমনি রাজনৈতিক হিসাব-নিকাশও থাকতে পারে। এসব সফরের মাধ্যমে দলের সঙ্গে সম্পর্ক বৃদ্ধি এবং রাজনৈতিক বোঝাপোড়ার প্রচেষ্টা থাকতে পারে।

যদিও দলটির পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে, জামায়াত আমীরের এই সফরটি পুরোপুরি রাজনৈতিক নয়, বরং এটি একটি সাংগঠনিক সফর। দলটির আমীর বিদেশে অবস্থানরত জামায়াতের নেতাকর্মীদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ বজায় রাখতে এবং সাংগঠনিক কার্যক্রম সমন্বিত করার উদ্দেশ্যে এই সফরটি করেছেন। সফরের মাধ্যমে তিনি সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর মধ্যে জামায়াতের কার্যক্রমকে আরও শক্তিশালী ও ভবিষ্যৎ কর্মসূচি নিয়ে মতবিনিময় করেছেন।

জামায়াতের আমিরের সফরের কারণ সম্পর্কে জানতে চাইলে দলের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল ও প্রচার ও মিডিয়া বিভাগের প্রধান এহসানুল মাহবুব জোবায়ের দ্য ডেইলি ক্যাম্পাস-কে বলেন, ১৯ অক্টোবর ওমরাহ পালনের উদ্দেশে জামায়াতের আমির সৌদি আরব যান। এরপর তিনি তুরস্ক, যুক্তরাষ্ট্র এবং যুক্তরাজ্য সফর করেন। এই সফরের সময় তিনি বিভিন্ন নাগরিক সংবর্ধনায় অংশ নেন। সাংগঠনিক একটি সফর ছিল। পাশাপাশি দেশগুলোর গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গ ও সংগঠনগুলোর সঙ্গেও বৈঠক করেন জাময়াত আমীর।