Image description

জালিয়াতির মাধ্যমে সঞ্চয়পত্রের অর্থ আত্মসাতের ঘটনায় ছাত্রদলের সাবেক কেন্দ্রীয় সহসভাপতি মোহাম্মদ মারুফ এলাহী রনিসহ চারজনের বিরুদ্ধে মামলা করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। মারুফ এলাহীর ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলার ফরমে পরিচয় শনাক্তকারী মহিউদ্দিন আহমেদকেও আসামি করা হয়েছে। অপর দুই আসামি হলেন– এনআরবিসি ব্যাংকের দিনাজপুর উপশাখার গ্রাহক মো. আরিফুর রহমান মিম এবং তাঁর পরিচয় শনাক্তকারী আল আমিন। 

আজ বৃহস্পতিবার রাজধানীর মতিঝিল থানায় বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষে অতিরিক্ত পরিচালক আবুল খায়ের মো. খালিদ বাদী হয়ে এ মামলা করেন। আসামি আরিফুর রহমান মিমকে মতিঝিল এলাকা থেকে আজ গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।

এজাহারে বলা হয়েছে, আসামিরা একে অপরের সহায়তায় বেআইনিভাবে জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তর থেকে বাংলাদেশ ব্যাংককে দেওয়া ইউজার আইডিতে গোপনে প্রবেশ করে। জালিয়াতির মাধ্যমে গ্রাহকের মোবাইল ফোন নম্বর এবং হিসাব নম্বর পরিবর্তন করে তারা অর্থ আত্মসাৎ করেন। 

এতে উল্লেখ করা হয়, জালিয়াতির মাধ্যমে মোহাম্মদ মারুফ এলাহী রনির ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের কারওয়ান বাজার শাখার ব্যাংক হিসাবে দুটি সঞ্চয়পত্রের ৫০ লাখ টাকা নেওয়া হয়। অবশ্য এই অর্থ উত্তোলনের আগেই তা আটকে দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। আর মহাহিসাব নিরীক্ষণ কার্যালয়ের কর্মকর্তা এস এম রেজভীর ২৫ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র ভাঙিয়ে এনআরবিসি ব্যাংকের দিনাজপুরের রানীগঞ্জ উপশাখার মো. আরিফুর রহমান মিমের অ্যাকাউন্টে নেওয়া হয়। টাকা জমা হওয়ার পরই ঢাকার দুটি শাখা থেকে তা নগদে তুলে নেওয়া হয়। 

মতিঝিল থানার অফিসার ইনচার্জ মেজবাহ উদ্দিন সমকালকে জানান, চার আসামির মধ্যে আরিফুর রহমানকে মতিঝিল এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। পেশায় তিনি ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী বলে প্রাথমিকভাবে জানা গেছে। 

গত ২৯ অক্টোবর সমকালের প্রথম পৃষ্ঠায় ‘সঞ্চয়পত্রের সার্ভার ব্যবহার করে জালিয়াতি’ শিরোনামে সংবাদ প্রকাশিত হয়। 

মারুফ এলাহীর পরিচয় 

জানা গেছে, মোহাম্মদ মারুফ এলাহী রনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের খাদ্য ও পুষ্টিবিজ্ঞান বিভাগের ২০০৭-০৮ সেশনের শিক্ষার্থী ছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অমর একুশে হল শাখা ছাত্রদলের সভাপতি থেকে তিনি কেন্দ্রীয় কমিটির সহসভাপতি হন। তাঁর বাসা ঢাকার তেজগাঁওয়ের পূর্ব তেজতুরী বাজার এলাকায়। গ্রামের বাড়ি লক্ষ্মীপুরের রামগঞ্জ থানার কাঞ্চনপুরে।

যোগাযোগ করা হলে মোহাম্মদ মারুফ এলাহী রনি গতকাল টেলিফোনে সমকালকে বলেন, এই জালিয়াতির সঙ্গে তাঁর কোনো সম্পৃক্ততা নেই। তিনি জানান, ডাচ্-বাংলা ব্যাংকে তাঁর  হিসাবটি ২০০৮ সালে খোলা, যখন তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। এই হিসাবে লেনদেন সীমা পাঁচ লাখ টাকা। বর্তমান স্থিতি আছে ৩৫ হাজার টাকার মতো। কে, কেন এবং কীভাবে তাঁর হিসাবে ৫০ লাখ টাকা দেওয়ার চেষ্টা করেছে, তিনি তা জানেন না।

মারুফ এলাহী রনি বলেন, তিনি ছাত্রদলের আগের কমিটিতে কেন্দ্রীয় সহসভাপতি ছিলেন। রাজনৈতিকভাবে তাঁকে ফাঁসানোর জন্য কেউ এ রকম অপচেষ্টা করতে পারে বলে তাঁর সন্দেহ। 

যেভাবে জালিয়াতি

মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, গত ২৭ অক্টোবর বিকেল ৪টার দিকে মহাহিসাব নিরীক্ষণ কার্যালয়ের হিসাব নিরীক্ষণ কর্মকর্তা মঞ্জুর আলম জানান, তাঁর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা এসএম রেজভী আয়কর রিটার্ন পূরণ করতে গিয়ে দেখেন, গত ১৩ অক্টোবর কেনা ২৫ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র নগদায়ন দেখাচ্ছে। অথচ তিনি নগদায়নের কোনো আবেদনই করেননি। বিষয়টি জানতে পেরে যাচাই করে দেখা যায়, গত ২৩ অক্টোবর তা নগদায়ন করা হয়েছে। তবে শাখায় নগদায়নের কোনো আবেদন পাওয়া যায়নি। 

এ বিষয়ে অধিকতর যাচাই করার জন্য সঞ্চয়পত্রের অনলাইন ম্যানেজমেন্ট সিস্টেমের কর্তৃপক্ষ বেচাকেনার ‘এসপিএফএমএস’-এর সঙ্গে যোগাযোগ করলে জানানো হয়, গত ২২ অক্টোবর এই গ্রাহকের মোবাইল নম্বর পরিবর্তন করা হয়। এরপর ব্যাংক হিসাবের তথ্য পরিবর্তন করে এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংকের দিনাজপুরের রানীগঞ্জ উপশাখার আরিফুর রহমানের ব্যাংক হিসাব নম্বর দেওয়া হয়। আরিফুর রহমানের ব্যাংক হিসাবে গত ২৬ অক্টোবর এই সঞ্চয়পত্র নগদায়ন করা হয়। আরিফুর রহমানের লেনদেন প্রোফাইলের তথ্য যাচাই করে দেখা গেছে, তাঁর জমা ও উত্তোলনের সীমা দুই লাখ টাকা। পরে টেম্পারিং করে যা ১০ লাখ টাকা করা হয়েছে।

মারুফ এলাহীর বিষয়ে এজাহারে উল্লেখ করা হয়েছে, তাঁর ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের কারওয়ান বাজার শাখার হিসাবে গত ২৭ অক্টোবর দুটি সঞ্চয়পত্রের বিপরীতে ৫০ লাখ টাকা নগদায়ন হয়। দুটি সঞ্চয়পত্রই ছিল পাঁচ বছর মেয়াদি বাংলাদেশ সঞ্চয়পত্র। প্রকৃত বিনিয়োগকারী মো. সাইদুর রহমান (৩০ লাখ) এবং মো. আবুল হাসান মজুমদারের  (২০ লাখ) সঞ্চয়পত্রের অর্থ শেষ পর্যন্ত উত্তোলন আটকে দেওয়া হয়। 
বাংলাদেশ ব্যাংকের মতিঝিল অফিসের সঞ্চয়পত্র শাখা ও কম্পিউটার সেলের দ্রুত পদক্ষেপের কারণে গত ২৮ অক্টোবর দুটি ইএফটি বাবদ ৫০ লাখ টাকা ডাচ্-বাংলা ব্যাংক থেকে পুনরুদ্ধার করে সরকারি খাতে জমা করা হয়।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সঞ্চয়পত্র কার্যক্রম বন্ধ

বাংলাদেশ ব্যাংক, সরকারি-বেসরকারি সব বাণিজ্যিক ব্যাংক, সঞ্চয় অধিদপ্তর ও পোস্ট অফিস মিলে প্রায় ১২ হাজার শাখা থেকে সঞ্চয়পত্র কেনা ও ভাঙানো হয়। গত আগস্ট পর্যন্ত ব্যাংকসহ গ্রাহকদের তিন লাখ ৪০ হাজার ৭১ কোটি টাকার সঞ্চয়পত্র আছে। এর মধ্যে প্রায় ৩০ শতাংশের মতো কেনা হয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের মতিঝিল অফিস থেকে। এই অফিসের সঞ্চয়পত্রে জালিয়াতি ধরা পড়ার পর গত মঙ্গলবার থেকে সব ধরনের সঞ্চয়পত্রের কার্যক্রম বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এতে ভোগান্তিতে পড়েছেন গ্রাহক। সুদ কিংবা আসল নগদায়ন করা যাচ্ছে না। নতুন করে সঞ্চয়পত্র বিক্রিও বন্ধ রয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের এক কর্মকর্তা সমকালকে বলেন,  মতিঝিল অফিসের যে তিনজনকে ইউজার আইডি ও পাসওয়ার্ড দেওয়া ছিল, তাদের প্রত্যাহার করা হয়েছে। আলামত হিসেবে এসব কম্পিউটার জব্দ করা হয়েছে। গত বুধবার আবার সঞ্চয় অধিদপ্তর থেকে নতুন ইউজার আইডি ও পাসওয়ার্ড নেওয়া হয়েছে। যে কারণে কিছুটা সমস্যা হয়েছে। আশা করা যায়, আগামী রোববার থেকে  কাজ শুরু করা যাবে।

গত বুধবার বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট সন্দেহভাজন  হিসাবগুলো জব্দ করে। এ ঘটনার পর থেকে সঞ্চয় অধিদপ্তরের এনএসসি সিস্টেমের নিরাপত্তা আরও জোরদার করা হয়েছে। পুরো ঘটনা তদন্তের জন্য অর্থ মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ ব্যাংক, বিএফআইইউ ও এনআরবিসি ব্যাংক থেকে পৃথক তদন্ত কমিটি কাজ করছে।