নয়া সংকটে দেশ। জুলাই সনদ বাস্তবায়ন আদেশের সুপারিশ ঘিরে এই সংকট তৈরি হয়েছে। জাতীয় ঐকমত্য কমিশন যে সুপারিশ দিয়েছে তাতে বিএনপিসহ অনেক দল ক্ষুব্ধ। কমিশনের বিরুদ্ধে বিশ্বাস ভঙ্গ, প্রতারণা ও এখতিয়ারবহির্ভূত পদক্ষেপ নেয়ার অভিযোগ করেছে এসব দল। কমিশনের সুপারিশ প্রকাশের পর রাজনীতির পুরনো বিভক্তি নতুন করে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। খোদ জুলাই সনদ নিয়েই এখন ‘হ্যাঁ’ এবং ‘না’-এর বন্যা বইছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। বিএনপি সুপারিশের সংশোধনী দাবি জানিয়েছে। অন্যদিকে জামায়াত দ্রুত সনদ বাস্তবায়নের দাবি তুলেছে। জাতীয় নাগরিক পার্টি এখনো সনদে সই না করলেও তারা সরকারের পদক্ষেপে খুশি। এমন অবস্থায় জাতীয় ঐক্যের পরিবর্তে নতুন বিভক্তি তৈরি হয়েছে। যা সম্ভাব্য নির্বাচন আয়োজনকে জটিল অবস্থায় ফেলে দিতে পারে। ঐকমত্য কমিশনের সুপারিশ নির্বাচন নিয়ে তৈরি অনিশ্চয়তাকে আরও গভীর করে তুলেছে।
ফ্যাসিবাদী আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নিয়েছিল নানা চ্যালেঞ্জ সামনে রেখে। এই সরকারের প্রতি মানুষের আকাশচুম্বী প্রত্যাশা তৈরি হয়েছিল। যা দিনে দিনে চুপসে যায়। ব্যবসা, বিনিয়োগ, আইনশৃঙ্খলা, কর্মসংস্থান, উন্নয়ন সব সূচক এখন নিম্নমুখী। প্রশাসনে চরম বিশৃঙ্খলা। অনিয়ম আর দুর্নীতির লাগাম টানা যায়নি। সেবাখাত বিপর্যস্ত। এ অবস্থায় সাধারণ মানুষ হতাশ ও ক্ষুব্ধ। মানুষ এখন একটি নির্বাচনের জন্য মুখিয়ে আছে। নির্বাচিত সরকার দায়িত্ব নিলে পরিস্থিতি বদলাবে এমনটা আশা করছেন অনেকে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারও আসছে মধ্য ফেব্রুয়ারির মধ্যে নির্বাচন আয়োজনের লক্ষ্য স্থির করার ঘোষণা দিয়ে রেখেছে। সেই অনুযায়ী নির্বাচন কমিশনও প্রস্তুতি নিচ্ছে। কিন্তু সরকার এবং ঐকমত্য কমিশনের সাম্প্রতিক অবস্থান নির্বাচন নিয়ে ফের অনিশ্চয়তার আবহ তৈরি করেছে। রাজনৈতিক এই জটিল পরিস্থিতিতে সামনে কি হবে কেউ তা বলতে পারছেন না।
অনেকে বলছেন, অভ্যুত্থান পরবর্তী পরিস্থিতিতে জামায়াতের উচ্চাকাক্সক্ষা পরিস্থিতিকে ক্রমে ঘোলাটে করছে। পিআর দাবি নিয়ে শুরুতে সরব জামায়াত এখন নির্বাচনের আগে গণভোট দাবিতে অনড়। দলটির এই দাবির সঙ্গে সমমনা কয়েকটি দলও আছে। ঐকমত্য কমিশনের সুপারিশ জমা দেয়ার পর এই গণভোট ইস্যুতে নতুন বিতর্ক তৈরি হয়েছে। এখন বলা হচ্ছে যদিও ভোটের আগে গণভোট হয় এবং বিএনপি এতে অংশ না নেয় তাহলে পরিস্থিতি কি দাঁড়াবে। আর নির্বাচনে যদি ‘না’ ভোট জয়যুক্ত হয় তখন সরকার ও কমিশন কি করবে। প্রধান উপদেষ্টা বার বারই বলে আসছেন তিনি জাতিকে একটি উৎসবমুখর নির্বাচন উপহার দিতে চান। কিন্তু সরকার এবং কমিশন যে পরিস্থিতি তৈরি করছে এতে প্রধান উপদেষ্টার এই প্রতিশ্রুতি পূরণও চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে।
ওদিকে জুলাই সনদ এর আইনি ভিত্তি ও এর বাস্তবায়নে সরকার এবং কমিশনের কৌশল নিয়েও নানা প্রশ্ন উঠেছে। এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ড. শাহদীন মালিক মানবজমিনকে বলেন, ৪৮ দফা প্রস্তাবকে সংবিধানে তফসিল হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করার সুপারিশ করা হয়েছে, সেটা করা হলে আইনি জটিলতা হতে পারে এবং এগুলো সবই সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এভাবে গণভোট হয় না, গণভোটের প্রক্রিয়া হচ্ছে আগে সংসদে পাস হয়ে জনগণের কাছে যেতে পারে গণভোটের জন্য। কিন্তু এখন উল্টো হয়েছে আগে গণভোট তারপর সংসদে যাবে। তিনি আরও বলেন, কমিশনের দেয়া সুপারিশে বলা হয়েছে নির্বাচিত সংসদ ২৭০ দিবস বা নয় মাসের মধ্যে সংস্কারের প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়ন করতে না পারলে তা স্বয়ংক্রিয়ভাবে সংবিধানে সেগুলো যুক্ত হবে তাহলে আলোচনার যৌক্তিকতা কি? কোনো সংসদকে কোনো কিছু করতে বাধ্য করা যায় না এগুলো আইনের মূল কথা। গণভোট দেয়ার ক্ষমতা তাদেরকে কে দিয়েছে? তারা তো নির্বাচিত নন। এছাড়া সংসদের উচ্চকক্ষ গঠন এবং প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ সুনির্দিষ্ট করাসহ সংবিধান সংস্কারের যে বিষয়গুলো আনা হয়েছে, সেগুলো বর্তমান সংবিধানে নেই। ফলে সেগুলো তফসিল হিসেবে যুক্ত করা হলে বর্তমান সংবিধান বাদ দিতে হবে।
তিনি বলেন, রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী বা মন্ত্রিসভার সদস্যদের শপথবাক্য হুবহু তফসিল হিসেবে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত থাকে। কিন্তু এর বাইরে সংস্কারের কোনো বিষয় তফসিল হিসেবে যুক্ত করা হলে সে সম্পর্কে সংবিধানের পুরনো বিধানও বহাল থেকে যায়। সেখানেই সংঘর্ষিক হওয়ার প্রশ্ন উঠবে।
প্রশ্ন থাকলেও জুলাই সনদ কার্যকর করতে আজ-কালের মধ্যেই আদেশ জারির দাবি জানিয়েছে জামায়াত। এনসিপি আদেশ জারির উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছে। যদিও দলটির এক নেতা দেশে গৃহযুদ্ধের আলামত দেখছেন। এনসিপি’র মুখ্য সমন্বয়ক নাসীরুদ্দিন পাটোয়ারী গতকাল এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, ফেব্রুয়ারির মধ্যে দেশে নির্বাচন না হলে যদি গৃহযুদ্ধের পরিস্থিতি হয় এর দায় প্রধান উপদেষ্টাকে নিতে হবে।
গতকাল আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলনে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, জাতীয় নির্বাচনের আগে গণভোট অযৌক্তিক ও অগ্রহণযোগ্য। নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, সরকার এখন প্রতারকের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়েছে। এবি পার্টির চেয়ারম্যান মুজিবুর রহমান মঞ্জু বলেছেন, ঐকমত্য প্রতিষ্ঠায় ব্যর্থ হলে অন্তবর্তীকালীন সরকারকে পদত্যাগ করতে হবে। গণসংহতি আন্দোলন এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, ঐকমত্য কমিশনের সুপারিশ জুলাই সনদ বাস্তবায়নকে অনিশ্চয়তায় ফেলে দিয়েছে।
দ্রুতই গণভোটের সিদ্ধান্ত দেবেন প্রধান উপদেষ্টা: ড. আসিফ নজরুল
গণভোট কবে হবে, সে বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টা দ্রুতই সিদ্ধান্ত দেবেন বলে জানিয়েছেন আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল। তিনি বলেন, রাজনৈতিক দলগুলো যদি এককভাবে তাদের অবস্থান নেয়ার জন্য সরকারকে জোর করে, তার মানে হচ্ছে তাদের মধ্যে ঐকমত্য নাই। তারা চাচ্ছে, সরকার যেন তাদের দলীয় অবস্থান নেয়। গতকাল উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠক শেষে বিকালে রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে এক সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলেন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল। এ সময় প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম উপস্থিত ছিলেন।
গণভোট কবে হবে, তা নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিরোধ তীব্রতম পর্যায়ে পৌঁছে গেছে বলে মন্তব্য করেন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল। বলেন, সিদ্ধান্ত নেবেন প্রধান উপদেষ্টা। প্রধান উপদেষ্টার নেতৃত্বে আমরা থাকবো। আমরা সহায়তা করার জন্য থাকবো। সিদ্ধান্ত এটা কোনো পার্টিকুলার কেউ নেবেন না, এটা আপনারা নিশ্চিত থাকেন। এই সিদ্ধান্ত প্রধান উপদেষ্টা নেবেন। দ্রুতই সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। জুলাই সনদের বাস্তবায়নের সুপারিশ নিয়ে দলগুলোর এই পাল্টাপাল্টি অবস্থান নিয়ে কথা বলেছেন আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল। তিনি বলেন, ২৭০ দিন আলাপ-আলোচনা করার পর রাজনৈতিক দলগুলোর বক্তব্যের মধ্যে যে অনৈক্যের সুর দেখা যাচ্ছে, তা হতাশাব্যঞ্জক। এই তীব্র বিরোধের মধ্যে সমঝোতা দলিল পাস করা সরকারের সামনে একটা চ্যালেঞ্জ এনে দিয়েছে। আসিফ নজরুল বলেন, দলগুলোকে এত আলোচনার সময় দেয়া হয়েছে। এরপরও তারা যেই অনৈক্য দেখাচ্ছে তাতে জুলাইয়ের স্পিরিটকে তারা কোথায় নিয়ে গেছে, এটা তাদের বিবেচনা করা উচিত। তিনি বলেন, রাজনৈতিক দলগুলো যদি এককভাবে তাদের অবস্থান নেয়ার জন্য সরকারকে জোর করে, তার মানে হচ্ছে তাদের মধ্যে ঐকমত্য নাই। তারা চাচ্ছে, সরকার যেন তাদের দলীয় অবস্থান নেয়।
জুলাই সনদ নিয়ে অনৈক্যের প্রভাব জাতীয় নির্বাচনে পড়বে কিনা- এমন প্রশ্নের জবাবে আইন উপদেষ্টা বলেন, ‘ যে যেটা বলুক, আমরা ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধ্বে জাতীয় নির্বাচন করবো। ফেব্রুয়ারির প্রথম দিকে জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজন করতে আমরা বদ্ধপরিকর।
এ প্রসঙ্গে অধ্যাপক আসিফ নজরুল আরও বলেন, নির্বাচিত সংসদের সংস্কার করার কোনো দায়দায়িত্ব থাকবে না, সব অন্তর্বর্তী সরকারকে করে যেতে হবে- এত কোনো বেদবাক্য নয়। সরকার যতটুকু পারে করবে। সম্ভব হলে সবই করবে। তবে তাতে রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্য লাগবে।
মানবাধিকার কমিশনকে আরও শক্তিশালী করতে নতুন অধ্যাদেশ অনুমোদন: এদিকে, জাতীয় মানবাধিকার কমিশনকে আরও শক্তিশালী ও কার্যকর করার লক্ষ্যে নতুন জাতীয় মানবাধিকার কমিশন অধ্যাদেশ অনুমোদন করেছে উপদেষ্টা পরিষদ। গতকাল প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত উপদেষ্টা পরিষদের সভায় অধ্যাদেশটির অনুমোদন দেয়া হয়। সভায় সভাপতিত্ব করেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
সংবাদ সম্মেলনে আইন উপদেষ্টা বলেন, আমাদের আগে একটা মানবাধিকার কমিশন ছিল, কিন্তু সেটি কার্যত দন্তহীন একটি প্রতিষ্ঠান ছিল। নিয়োগ পদ্ধতিতে ত্রুটি, এখতিয়ারে ঘাটতি এবং নেতৃত্বের দুর্বলতায় প্রতিষ্ঠানটি কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারেনি। এবার সেটিকে সত্যিকারের এখতিয়ারসম্পন্ন, ক্ষমতাসম্পন্ন একটি প্রতিষ্ঠানে রূপ দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। তিনি জানান, নতুন অধ্যাদেশে মানবাধিকার কমিশনের কাঠামো, এখতিয়ার ও নিয়োগ প্রক্রিয়ায় মৌলিক পরিবর্তন আনা হয়েছে। কমিশন একজন চেয়ারম্যান ও চারজন সার্বক্ষণিক সদস্য নিয়ে গঠিত হবে। নিয়োগের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা ও যোগ্যতা নিশ্চিত করতে আপিল বিভাগের একজন বিচারকের নেতৃত্বে সাত সদস্যের একটি বাছাই কমিটি গঠনের বিধান রাখা হয়েছে। গণবিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে আবেদন আহ্বান করা হবে এবং প্রার্থীদের সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে বাছাই কমিটি সুপারিশ করবে। আইন উপদেষ্টা বলেন, আমরা নিয়োগ পদ্ধতিটা এমনভাবে করেছি যাতে অভিজ্ঞ, যোগ্য ও মানবাধিকার রক্ষায় সক্রিয় মানুষরা কমিশনে জায়গা পান। তিনি বলেন, আমাদের সংবিধানের মৌলিক অধিকারের পাশাপাশি বাংলাদেশ কর্তৃক অনুসমর্থিত আন্তর্জাতিক মানবাধিকার চুক্তি এবং প্রথাগত আন্তর্জাতিক আইনে স্বীকৃত মানবাধিকারগুলোকেও এই কমিশনের এখতিয়ারে আনা হয়েছে। এর ফলে কমিশন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার মানদণ্ড অনুযায়ী কাজ করতে পারবে। অধ্যাদেশে কমিশনের এখতিয়ার বহুলাংশে বাড়ানো হয়েছে। এখন থেকে শৃঙ্খলা বাহিনীসহ রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতায় সংঘটিত মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাতেও কমিশন তদন্ত করতে পারবে। আইন উপদেষ্টা বলেন, আগের কমিশনের এখতিয়ারে গুরুতর সীমাবদ্ধতা ছিল, বিশেষ করে শৃঙ্খলা বাহিনী ও সরকারি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অভিযোগের ক্ষেত্রে। এবার সেই সীমাবদ্ধতা দূর করা হয়েছে।
এ ছাড়া, গুম প্রতিরোধ, প্রতিকার ও ভুক্তভোগীদের সুরক্ষা আইনসহ মানবাধিকার সংরক্ষণমূলক যেকোনো আইনের বাস্তবায়নের দায়িত্ব মানবাধিকার কমিশনের ওপর ন্যস্ত করা হয়েছে। আলাদা করে ‘গুম কমিশন’ গঠনের প্রয়োজন হবে না বলে জানান তিনি। অধ্যাদেশে কমিশনের আদেশ প্রতিপালনকে বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। আইন উপদেষ্টা বলেন, এখন থেকে কমিশনের সুপারিশ বা নির্দেশ উপেক্ষা করা যাবে না। এর বাধ্যবাধকতা আইনি কাঠামোয় যুক্ত করা হয়েছে। অনুষ্ঠানে আরও উপস্থিত ছিলেন উপ-প্রেস সচিব আবুল কালাম আজাদ মজুমদার।
সনদ বাস্তবায়নে কমিশনের সুপারিশ অগ্রহণযোগ্য: বিএনপি
জুলাই সনদ বাস্তবায়নে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন সরকারের কাছে যে সুপারিশ দিয়েছে তা ‘অযৌক্তিক’ ও অগ্রহণযোগ্য বলে মন্তব্য করেছে বিএনপি। জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে গণভোট অপ্রয়োজনীয় এবং অবিবেচনাপ্রসূত বলে মনে করছে দলটি। একই আয়োজনে এবং একই ব্যয়ে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিনই গণভোট অনুষ্ঠান করা বাঞ্ছনীয় বলেও মনে করছে তারা। গতকাল গুলশানে চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে জাতীয় স্থায়ী কমিটির পক্ষে বিএনপি’র মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর আনুষ্ঠানিকভাবে দলের এই অবস্থানের কথা তুলে ধরেন। বুধবার রাতে গুলশানে জাতীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠক হয়। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান লন্ডন থেকে ভার্চ্যুয়ালি যুক্ত হয়ে এই বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন। এই বৈঠকের পর স্থায়ী কমিটির সদস্যরা সংবাদ সম্মেলন করেন। বিএনপি মহাসচিব বলেন, জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নের আইনি ভিত্তি দেয়ার জন্য জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সুপারিশ সরকারের কাছে পেশ করেছে। সেখানে যে সকল বিষয়ে ভিন্নমত বা নোট অফ ডিসেন্টসহ ঐকমত্য হয়েছে তার উল্লেখ না রেখে দীর্ঘ আলোচনায় যেসব প্রসঙ্গ আলোচনায় আসেনি, তা অন্তর্ভুক্ত করে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের অন্য সকল সুপারিশ অগ্রহণযোগ্য বিধায় আমরা একমত হতে পারছি না। আমরা অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে লক্ষ্য করেছি যে, এই সকল সুপারিশ কেবল জাতিকে বিভক্ত করবে, ঐক্যের বদলে অনৈক্য সৃষ্টি করবে। মনগড়া যেকোনো সংস্কার প্রস্তাব গ্রহণ করলে জাতীয় জীবনে দীর্ঘমেয়াদে অকল্যাণ ডেকে নিয়ে আসতে পারে।
জুলাই জাতীয় সনদের বাস্তবায়ন কীভাবে হবে, সে বিষয়ে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সুপারিশমালা গত মঙ্গলবার প্রধান উপদেষ্টার কাছে হস্তান্তর করা হয়। সাংবিধানিক আদেশ জারি করে গণভোটের মাধ্যমে সনদ বাস্তবায়নের কথা বলা হয়েছে সেখানে। সুপারিশে বলা হয়েছে, ওই আদেশ জারির পর জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে যথোপযুক্ত সময়ে অথবা নির্বাচনের দিন গণভোট হবে। সেজন্য প্রয়োজনীয় আইন প্রণয়ন করতে হবে।
জাতীয় নির্বাচনের আগে গণভোটের সুপারিশকে ‘অযৌক্তিক’ অভিহিত করে সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথমার্থে নির্বাচন অনুষ্ঠানের ঘোষণা দিয়েছিলেন প্রধান উপদেষ্টা, সেক্ষেত্রে নির্বাচন অনুষ্ঠানের আগে প্রস্তাবিত গণভোট অনুষ্ঠান সম্ভব নয়। সময়স্বল্পতা, নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য বিপুল অঙ্কের ব্যয় এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ ব্যাপক লোকবল নিয়োগ এবং একটি জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের মতো বিশাল আয়োজনের বিবেচনায় নির্বাচনের পূর্বে গণভবন অনুষ্ঠান অপ্রয়োজনীয়, অযৌক্তিক এবং অবিবেচনাপ্রসূত। একই আয়োজনে ও একই ব্যয়ে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিনই গণভোট অনুষ্ঠান করা বাঞ্ছনীয়।
মির্জা ফখরুল বলেন, আমরা আশা করি, জাতির প্রত্যাশা পূরণ এবং দীর্ঘ ১৬ বছরের ফ্যাসিবাদবিরোধী গণতান্ত্রিক আন্দোলন ও ২০২৪ সালে ছাত্র গণ-অভ্যুত্থানে সকল শহীদের রক্তের অঙ্গীকার অনুযায়ী এবং যারা দীর্ঘ এই সংগ্রামে ফ্যাসিবাদী শাসনামলে গুম, খুন, অপহরণ, নির্যাতন, মামলা, হামলার শিকার হয়েছেন তাদের প্রত্যাশা অনুযায়ী জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে একটি শক্তিশালী গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র পুনর্গঠন করতে পারবো। প্রতিষ্ঠিত হবে সাম্য, মানবিক মর্যাদা, ও ন্যায়বিচারভিত্তিক সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থা। সেই লক্ষ্যে জাতীয় ঐক্য বজায় রাখা আমাদের সকলের কাম্য এবং জুলাই গণ-অভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে জাতির অভিপ্রায় অনুযায়ী সাংবিধানিক ধারাবাহিকতায় প্রতিষ্ঠিত বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধানতম লক্ষ্য হবে একটি সুষ্ঠু নিরপেক্ষ গ্রহণযোগ্য জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে একটি নির্বাচিত রাজনৈতিক সরকার প্রতিষ্ঠা করা এবং উক্ত জাতীয় সংসদে সংসদকে প্রকৃত অর্থে জাতীয় জীবনের সকল কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রে পরিণত করা।
এক প্রশ্নের জবাবে ফখরুল ইসলাম বলেন, এখানে নালিশের কিছু নেই। যে সুপারিশগুলো দেয়া হয়েছে সে বিষয়ে আমরা আমাদের মতামত জাতির সামনে তুলে ধরলাম। প্রয়োজনে আমরা প্রধান উপদেষ্টার কাছেও আবার যাবো।
জুলাই জাতীয় সনদ স্বাক্ষরের সময়ে যেসব বিষয়ে ঐকমত্য হয়েছে পরবর্তীতে মুদ্রিত পুস্তকে কয়েকটি দফা তুলে ধরে তিনি বলেন, গত ১৭ই অক্টোবর জাতীয় সংসদের দক্ষিণ প্লাজায় এক ঐতিহাসিক অনুষ্ঠানের মধ্যদিয়ে আমরা কেবলমাত্র আলোচনার মাধ্যমে প্রণীত সনদের অঙ্গীকারনামায় স্বাক্ষর করেছি। কিন্তু সেদিন সনদ চূড়ান্ত কপি আমাদের সামনে উপস্থাপন করা হয়নি। পরবর্তীতে প্রিন্টেড পুস্তক হিসেবে জুলাই জাতীয় সনদের কপি আমরা হাতে পাওয়ার পরে আমাদের দৃষ্টিগোচর হয়েছে যে, ঐকমত্যের ভিত্তিতে সম্মত কয়েকটি দফা আমাদের অগোচরে পুনরায় সংশোধন করা হয়েছে। যেমন শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি সরকারি- বেসরকারি অফিসে টাঙ্গানো সংক্রান্ত বিধান অনুচ্ছেদ ৪ (ক) বিলপ্ত করার বিষয়টি সনদে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। যদিও প্রায় সকল রাজনৈতিক দল সম্মতিপত্র দিয়েছে। সংবিধানের ১৫০ (২) অনুচ্ছেদ (পঞ্চম, ষষ্ঠ, সপ্তম তফসিল) পুরোপুরি বিলুপ্ত করার বিষয়ে ঐকমত্য কমিশনের প্রস্তাব বিষয়ে প্রায় সকল রাজনৈতিক দল সম্মতি প্রকাশ করলেও অগোচরে সেটা চূড়ান্ত সনদে সংশোধনী আনা হয়েছে।
বিএনপি মহাসচিব বলেন, ঐকমত্য কমিশন প্রধান উপদেষ্টার কাছে তার চিঠিতে বলেছে, জুলাই সনদে সংবিধান সংস্কারের বিষয়গুলোকে দুইটি বিকল্প পদ্ধতিতে বাস্তবায়নের এবং আইনগত ভিত্তি প্রদানের জন্য সরকারের কাছে পেশ করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, জুলাই জাতীয় সনদে সন্নিবেশিত সংবিধান সংশোধন সংক্রান্ত বিষয়গুলো কার্যকর করার উদ্দেশ্যে সরকার জুলাই সনদ সংবিধান সংস্কার বাস্তবায়ন আদেশ-২০২৫ শিরোনামে একটি আদেশ জারি করবে। সরকারের এরকম আদেশ জারি করার এখতিয়ার নাই। সংবিধানের ১৫২ অনুচ্ছেদের সংজ্ঞা অনুসারে আদেশ আইনের মর্যাদা প্রাপ্ত। সেটি জারি করা এখতিয়ার রাষ্ট্রপতির।
দ্বিতীয় বিকল্প প্রস্তাবের বিষয়টি তুলে ধরে তিনি বলেন, বিকল্প প্রস্তাব-এক এ সরকার জুলাই সনদ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে একটি পূর্ণাঙ্গ খসড়া বিল গণভোটে উপস্থাপন করা হবে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। বিলে উল্লেখ করা হয়েছে যে, সংবিধান সংশ্লিষ্ট তফসিল-১ বর্ণিত ৪৮টি দফার (জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের প্রস্তাবিত দফাগুলো) উপরে গণভোট হবে। উক্ত দফাসমূহের বিপরীতে স্বাক্ষরিত জুলাই জাতীয় সনদে অন্তর্ভুক্ত রাজনৈতিক দলসমূহের মতামত, ভিন্নমত, নোট অফ ডিসেন্ট উল্লেখ করা হয়নি। অর্থাৎ ঐকমত্য কমিশনের প্রস্তাব এবং সুপারিশ একপেশে ও জবরদস্তিমূলক জাতির উপর চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। তাহলে এটাই প্রতীয়মান হয়, দীর্ঘ এক বছরব্যাপী সংস্কার কমিশন ও জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে রাজনৈতিক দলসমূহের দীর্ঘ ধারাবাহিক আলোচনা ছিল অর্থহীন, অর্থ ও সময়ের অপচয়, প্রহসনমূলক এবং জাতির সঙ্গে প্রতারণা। গণতন্ত্রে রাজনৈতিক দলগুলোর ভিন্ন মত থাকবে এটাই স্বাভাবিক। সে কারণে সংলাপের প্রয়োজন দেখা দিয়েছিল, কিন্তু ঐকমত্য কমিশন ভিন্নমত পোষণে রাজনৈতিক দলগুলোর গণতান্ত্রিক অধিকারকে আমলেই নেয়নি।
মির্জা ফখরুল ইসলাম বলেন, সুপারিশে বলা হয়েছে, জাতীয় সংসদের সাধারণ নির্বাচনে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে জাতীয় সংসদ গঠিত হওয়ার পাশাপাশি একই সঙ্গে একটি সংবিধান সংস্কার পরিষদ গঠিত হবে এবং তারা আলাদাভাবে সংসদ সদস্য এবং সংবিধান সংস্কার পরিষদ সদস্য হিসেবে শপথ নিবেন। অর্থাৎ নির্বাচিত জাতীয় সংসদটি একই সঙ্গে ‘সংবিধান সংস্কার পরিষদ’ হিসেবে অভিহিত হবে। এখানে প্রশ্ন হলো নির্বাচন কমিশন সাংবিধানিকভাবে জাতীয় সংসদ এবং রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের জন্য ক্ষমতাপ্রাপ্ত। সংবিধান সংস্কার পরিষদ গঠনের লক্ষ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের দায়িত্বপ্রাপ্ত নয়। ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর আলোচনা সংবিধান সংস্কার পরিষদ গঠনের বিষয়টি এজেন্ডাভুক্ত ছিল না, আলোচনার জন্য উপস্থাপিত হয়নি। সংবিধান সংস্কার পরিষদ গঠনের বিষয়ে কোনো ঐকমত্য হওয়ার অবকাশও ছিল না।
আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বিচারের ব্যাপারে আমরা খুব সুস্পষ্টভাবে বলেছি যে, গণহত্যাকারীদের অর্থাৎ আওয়ামী লীগের যারা গণহত্যার সঙ্গে জড়িত এবং অন্যান্য বিভাগের যারা সরকারি কর্মকর্তা যারা এর সঙ্গে জড়িত তাদের অবশ্যই বিচার হতে হবে এবং দ্রুত বিচার হতে হবে। নির্বাচনের ব্যাপারে আমাদের অবস্থান অত্যন্ত পরিষ্কার। ২০২৬ সালের মধ্য ফেব্রুয়ারিতে প্রধান উপদেষ্টা যে কমিটমেন্ট করেছেন জাতির সামনে, আমরা সেটায় আস্থা রেখেছি এবং সেই হিসেবে আমরা আমাদের নির্বাচনের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছি।
মির্জা ফখরুল বলেন, নির্বাচনের দিন গণভোটটা অনুষ্ঠানে আমরা একমত হয়েছি জাতির স্বার্থে, ঐক্যের স্বার্থে। এর বাইরে আমরা কোনোদিনই একমত হবো না, প্রশ্নই উঠে না।
তিনি বলেন, নির্বাচন বিঘ্নিত হওয়ার কারণ নেই। নির্বাচনের ব্যাপারে আমাদের কোনো অনাস্থা নেই কারও প্রতি। এ নিয়ে আমরা শঙ্কা দেখছি না। আমরা চাচ্ছি যে, দ্রুত নির্বাচন হয়ে যাক। আশা করছি, নির্বাচন হবে।
সংবাদ সম্মেলনে বিএনপি’র স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আব্দুল মঈন খান, নজরুল ইসলাম খান, সালাহউদ্দিন আহমেদ, বেগম সেলিমা রহমান ও হাফিজ উদ্দিন আহমেদ উপস্থিত ছিলেন।
শুক্রবারের মধ্যেই জুলাই সনদ বাস্তবায়ন
আদেশ জারির দাবি জামায়াতের
শুক্রবারের মধ্যেই জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়ন আদেশ জারির দাবি জানিয়েছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। বৃহস্পতিবার বিকালে মগবাজারে আল-ফালাহ্ মিলনায়তনে এক জরুরি সংবাদ সম্মেলনে এ দাবি জানায়। সংবাদ সম্মেলনে জামায়াতের নায়েবে আমীর ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেন, জামায়াত রাষ্ট্র সংস্কারে দেয়া ঐকমত্য কমিশনের প্রস্তাবগুলোর পূর্ণ বাস্তবায়ন চায়। সেজন্য সময়ক্ষেপণ না করে সনদ বাস্তবায়ন আদেশ জারি করতে হবে। সরকার চাইলে আজ রাতের (বৃহস্পতিবার) মধ্যেও সেটি করতে পারে। দেরি হলে সরকার জনগণের আস্থা হারাবে।
তিনি বলেন, জুলাই সনদ বাস্তবায়ন আদেশ জারির পর গণভোটের আয়োজন করতে হবে। জাতীয় নির্বাচনের দিন কিংবা নির্বাচনের আগে গণভোট আয়োজনের সুপারিশ ঐকমত্য কমিশন সরকারের কাছে জমা দিয়েছে। জামায়াত জাতীয় নির্বাচনের আগেই গণভোট আয়োজন করার দাবি জানিয়েছে। কারণ, একই দিনে নির্বাচন ও গণভোট হলে রাজনৈতিক দলের নেতারা নিজ দলের প্রার্থীকে জেতাতে ব্যস্ত থাকবেন। ফলে গণভোটের গুরুত্ব কমে যাবে।
গণভোটের পর ফেব্রুয়ারিতেই জাতীয় সংসদ নির্বাচন হতে হবে উল্লেখ করে সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেন, এমন কোনো বিষয় যাতে সামনে আনা না হয়, যে কারণে নির্বাচন সংশয় বা অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ে। জাতীয় নির্বাচনের জন্য ফেব্রুয়ারিই উপযুক্ত সময়।
সংবাদ সম্মেলন সঞ্চালনা করেন জামায়াতের প্রচার ও মিডিয়া বিভাগের সেক্রেটারি মতিউর রহমান আকন্দ। এ সময় উপস্থিত ছিলেন- দলটির নায়েবে আমীর অধ্যাপক মুজিবুর রহমান, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা এটিএম মা’ছুম ও ড. এএইচএম হামিদুর রহমান আযাদ।
অনেকগুলো সেটেল ইস্যু নিয়ে নানা মহল ও কোনো কোনো রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে বিভ্রান্তি ও ভিন্ন অবস্থান গ্রহণ করে নির্বাচনের পরিবেশ ও রাজনীতিতে একটা উত্তাপ ছড়ানোর পাঁয়তারা করছে বলে মন্তব্য করে আবদুল্লাহ মো. তাহের বলেন, নির্বাচনে অংশগ্রহণ নিয়ে নানাভাবে ফেসবুকে আংশিক বক্তব্য তুলে ধরে, নিজেদের মনগড়া বক্তব্য রেখে জামায়াতে ইসলামী ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন চায় কি না- এমন সংশয় তৈরির চেষ্টা করা হচ্ছে।
জামায়াতের পক্ষ থেকে স্পষ্ট ও পরিষ্কার বার্তা, আমরা জুলাই সনদের পূর্ণ বাস্তবায়ন চাই আইনগত ভিত্তির মাধ্যমে। কমিশনের সুপারিশের আলোকে অবিলম্বে একটা আদেশ জারি চাই। আমরা জাতীয় নির্বাচনের আগেই গণভোট চাই। গণভোটের রায়ের ভিত্তিতে আমরা ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন চাই। আমাদের বক্তব্য ও বার্তা স্পষ্ট ও পরিষ্কার।
ড. ইউনূসের প্রতি আহ্বান জানিয়ে তাহের বলেন, আজকের ভেতরেই আদেশ জারি হলে খুবই উত্তম। রাত ১২টা, ১টার মধ্যেও আদেশ জারির নজির আছে। যদি কোনো কারণে আজকে না হয় তাহলে অবশ্যই আগামীকাল শুক্রবার আদেশ জারি করতে হবে। আর দেরি করার কোনো সুযোগ নেই। যদি দেরি হয় তাহলে জাতীয় নির্বাচনকে প্রভাবিত করবে। এজন্য সরকার ও যারা প্রভাবিত করার চেষ্টা করছেন তারা অবশ্যই জাতির কাছে দায়ী থাকবেন।
সৈয়দ আবদুল্লাহ মো. তাহের বলেন, এই সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর সুস্পষ্ট তিনটি অঙ্গীকার ছিল। এর একটি হচ্ছে- সংস্কার করা হবে। এটা ছিল এই অন্তর্বর্তী সরকারের একমাত্র অর্জন। বাকিগুলো তো অন্যান্য স্বাভাবিক সরকারের মতোই করছে। এটাকেই যদি প্রতিষ্ঠিত ও বাস্তবায়ন করা যায় তাহলে এটা খুব কার্যকর হবে, যা পুরো জাতির প্রত্যাশিত। এটি সম্ভব হলে বাংলাদেশ নতুন দিগন্তে পদার্পণ করবে। এই সংস্কারের প্রস্তাবনায় যেগুলো আছে, তার মাধ্যমে এদেশে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক পরিবর্তন সাধিত হবে, যাকে আমরা নতুন বাংলাদেশ বলছি।
আবদুল্লাহ তাহের বলেন, তিন-চতুর্থাংশ মতের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয়েছে। সেখানে কোনো কোনো দল নোট অব ডিসেন্ট দিয়েছে। এর মানে কী? একটা সিদ্ধান্ত হয়ে গেছে, কিন্তু আমি একমত নই। হাইকোর্টের রায়ে কিন্তু এমন হয়- তিনজন বিচারপতির মধ্যে দু’জন রায়ে একমত হলেও একজন ভিন্নমত দিতে পারেন। তাতে করে রায় তো ভিন্ন হয় না। যেমন, আমাদের রেজিস্ট্রেশন ছিল না- হাইকোর্টের এমন রায়েই। এটা খুব সাধারণ বিষয়। এরপরও একটা দল বলছে, তাদের নোট অব ডিসেন্ট নাকি গণভোটে পাঠাতে হবে।
গৃহযুদ্ধের পরিস্থিতি হলে তার দায় প্রধান উপদেষ্টার: নাসীরুদ্দীন
জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) মুখ্য সমন্বয়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী বলেছেন, ফেব্রুয়ারির মধ্যে জাতীয় নির্বাচন দিন। আপনারা যদি ফেব্রুয়ারির মধ্যে নির্বাচন দিতে না পারেন, তাহলে পরবর্তী সময় গৃহযুদ্ধের পরিস্থিতি হলে তার দায় প্রধান উপদেষ্টার। গতকাল ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে রাজনীতির বর্তমান এবং ভবিষ্যতের পথরেখা শীর্ষক অনুষ্ঠানে এসব কথা বলেন তিনি। নাসীরুদ্দীন পাওয়ারী বলেন, জুলাই সনদ বাস্তবায়নের জন্য সংস্কার কমিশন সুপারিশমালা দিয়েছে। ড. ইউনূসের কোর্টে এখন বল, যেহেতু তিনি আন্তর্জাতিক মানের খেলোয়াড়। বলা হয় যে, বিদেশি খেলোয়াড়রা বাংলাদেশে খেলতে এলে পিছলে যায়, কারণ মাঠ পিছলা। কিন্তু এই পিছলা মাঠে আমাদের আইন উপদেষ্টা আরও বেশি তেলমর্দন করেন। তিনি রাজনীতিবিদদের শুধু পিছলা খাওয়াতে চান। আপনারা সুপারিশমালার ড্রাফট জনসম্মুখে আনুন, তখনই এনসিপি এতে স্বাক্ষর করবে। তিনি বলেন, দেশ অন্য পরিস্থিতির দিকে যাচ্ছে। ফেব্রুয়ারির মধ্যে নির্বাচন দিন। যদি ফেব্রুয়ারির মধ্যে নির্বাচন না দিতে পারেন তাহলে পরে যদি কোনো গৃহযুদ্ধের পরিস্থিতি হয় সেই দায়িত্ব আপনার (প্রধান উপদেষ্টা) কাঁধে বর্তাবে। গণভোট প্রশ্নে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিএনপি’র ‘না’ সূচক প্রচারণার পরিপ্রেক্ষিতে নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী বলেন, বিএনপি অনলাইনে ‘না’ শব্দ জারি করেছে। বিএনপির ‘না’ বলার কোনো ওয়ে নেই। তারা অলরেডি ‘হ্যাঁ’ বলে দিয়েছেন। তারা বিবাহে রাজিও হয়েছেন, কাবিননামায় সইও করেছেন। এখন তাদের না বলার কোনো অপশন নেই। বিএনপি’র ভেবেচিন্তে জুলাই সনদে সই করা উচিত ছিল। নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী বলেন, অস্পষ্টতার মধ্যদিয়ে ভবিষ্যৎ বাংলাদেশকে ঠেলে দিতে পারবো না। গণভোট আগে হবে, না হবে এটা জামায়াত ও বিএনপি’র কু-তর্ক। এটা থেকে বেরিয়ে তাদের নির্বাচন কমিশনকে সহযোগিতা করতে হবে। জামায়াতের প্রতি আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, আপার হাউসের পিআর, লোয়ার হাউসে এনে বিষয়টি নিয়ে ধোঁয়াশা তৈরি করেছেন। কিন্তু গণভোট প্রশ্নে জামায়াত একসময় বিএনপি’র সঙ্গে একত্র হয়ে যাবে। তারা দুই দল মিলে আসলে কু-তর্ক করছে।