চলতি মাসের শুরুর দিকে দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক বিশ্লেষক শ্রী রাধা দত্ত এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ভারতে অবস্থানরত শেখ হাসিনা তার দলের (আওয়ামী লীগ) নেতাকর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে পারবেন, তবে বাংলাদেশ বা সরকারের বিষয়ে উসকানিমূলক কোনো বক্তব্য দেওয়া থেকে তাকে বিরত থাকতে হবে। তার মতে, বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে ভারতের দৃষ্টিভঙ্গিতে কিছুটা পুনর্বিবেচনা দেখা গেলেও মৌলিক অবস্থান এখনো অপরিবর্তিত।
রাধা দত্ত স্পষ্টভাবে বলেন, “বাংলাদেশ সম্পর্কে দিল্লিতে বসে কোনো রাজনৈতিক মন্তব্য করা যাবে না। যদি তিনি (শেখ হাসিনা) এমনটি চালিয়ে যান, তাহলে দুই দেশের সম্পর্ক আর স্বাভাবিক থাকবে না, উন্নত তো দূরের কথা।”
১১ জুলাই বিবিসির ভারতীয় সাংবাদিক শুভজ্যোতি ঘোষের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, শেখ হাসিনা ইস্যুতে ভারতের অবস্থানে কোনো পরিবর্তন আসেনি। ছাত্র-জনতার আন্দোলনে গুলি চালানোর নির্দেশ, শেখ হাসিনার অডিও ফাঁস, মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ-এই সব ইস্যুতেই দিল্লি তার পূর্বের নীতিতে অটল রয়েছে। প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়, শেখ হাসিনাকে বাংলাদেশের অনুরোধে প্রত্যর্পণ করার কোনো সম্ভাবনা এখনো দেখা যাচ্ছে না।
এদিকে রয়টার্স, এএফপি ও দ্য ইন্ডিপেনডেন্টসহ একাধিক আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে দেওয়া সাম্প্রতিক সাক্ষাৎকারে শেখ হাসিনা বলেছেন, জুলাই গণহত্যার জন্য তিনি কোনোভাবেই ক্ষমা চাইবেন না। তার দাবি, আওয়ামী লীগকে ছাড়া যদি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, তাহলে দলের লাখ লাখ নেতা-কর্মী ভোট বর্জন করবে। এমন পরিস্থিতিতে তিনি দেশে ফিরবেন না, বরং ভারতে থেকেই রাজনৈতিক কার্যক্রম চালিয়ে যাবেন।
শেখ হাসিনা আরও বলেন, “পরবর্তী সরকারের অবশ্যই নির্বাচনি বৈধতা থাকতে হবে। কার্যকর রাজনৈতিক ব্যবস্থা চাইলে লাখ লাখ মানুষকে ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত করা সম্ভব নয়।”
তিনি আশা প্রকাশ করেন যে, রাজনৈতিক অস্থিরতা সত্ত্বেও আওয়ামী লীগ দেশের রাজনীতিতে আবারও ভূমিকা রাখবে-সরকারে হোক বা বিরোধী দলে। তবে নেতৃত্বের ক্ষেত্রে তার পরিবারের কারও প্রয়োজন নেই বলেও মন্তব্য করেন তিনি। (এর আগে তার ছেলে সজিব ওয়াজেদ জয় জানিয়েছিলেন, দল চাইলে তিনি নেতৃত্বের বিষয়টি বিবেচনা করতে পারেন।)
আন্তর্জাতিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, শেখ হাসিনার এসব সাক্ষাৎকার ভারতের একটি কৌশলগত পরিকল্পনার অংশ, যার উদ্দেশ্য বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে প্রভাব ফেলা। তাদের মতে, আসন্ন নির্বাচন এবং শেখ হাসিনার বিচার প্রক্রিয়ার রায় সামনে রেখে কিছু মহল বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করছে। অভিযোগ উঠেছে, রায় ঘোষণার আগেই এসব সাক্ষাৎকার প্রচার করা হয়েছে—যা এক ধরনের কূটনৈতিক চাপ সৃষ্টির প্রচেষ্টা হতে পারে।
রাজনৈতিক মহলের সূত্র জানায়, গত জুলাই বিপ্লবের পর ভারতে আশ্রয় নেওয়ার পর থেকেই শেখ হাসিনা বিভিন্ন মাধ্যমে-সোশ্যাল মিডিয়া, ভার্চুয়াল বৈঠক ও আন্তর্জাতিক সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে-দলের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন। এমনকি দিল্লিতে একটি রাজনৈতিক কার্যালয় স্থাপন করা হয়েছে বলেও কিছু প্রতিবেদনে উল্লেখ রয়েছে, যদিও এ বিষয়ে কোনো আনুষ্ঠানিক কূটনৈতিক নিশ্চিতকরণ মেলেনি।
বিশ্লেষকরা আরও বলেন, ভারতের নীতিনির্ধারকরা প্রাথমিকভাবে ধারণা করেছিলেন, অব্যাহত কূটনৈতিক চাপের ফলে ড. মুহাম্মদ ইউনূস নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের পররাষ্ট্রনীতি তাদের সঙ্গে সমন্বিত হবে। কিন্তু বাস্তবে তা ঘটেনি। ড. ইউনূস বরং একটি স্বাধীন ও ভারসাম্যপূর্ণ পররাষ্ট্রনীতি গ্রহণ করেছেন। দেশের অভ্যন্তরে ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ হয়েছে, এবং মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় শেখ হাসিনার বিচার এখন শেষ পর্যায়ে। আগামী মাসেই রায় ঘোষণা হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
অন্যদিকে, কিছু বিশ্লেষক মনে করেন, শেখ হাসিনাকে নিয়ে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে দেওয়া সাক্ষাৎকার এবং সেসব প্রচারণা ভারতের কৌশলগত পরিকল্পনার অংশ,যার মাধ্যমে তারা ঢাকার ওপর চাপ বজায় রাখতে চাইছে।
তাদের মতে, এসব ঘটনা শুধু রাজনৈতিক নয়, বরং আসন্ন নির্বাচন, মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার এবং দুই দেশের কূটনৈতিক ভারসাম্য—সবকিছুকে নতুন করে নাড়া দিচ্ছে।
শীর্ষনিউজ