Image description
 

বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার কর্তৃক গঠিত জাতীয় ঐকমত্য কমিশন 'জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫' বাস্তবায়নে অবিলম্বে সরকারি আদেশ জারি করে একটি গণভোট আয়োজনের সুপারিশ করেছে।

 

গণভোটের ব্যালটে দেয়ার জন্য কমিশনের যে প্রশ্ন সুপারিশে করেছে সেটি হলো: 'আপনি কি জুলাই জাতীয় সনদ (সংবিধান সংস্কার) বাস্তবায়ন আদেশ, ২০২৫ এবং ইহার তফসিল-১ এ সন্নিবেশিত সংবিধান সংস্কার প্রস্তাবসমূহের প্রতি আপনার সম্মতি জ্ঞাপন করিতেছেন?'

 

সেই গণভোট কবে হবে সে বিষয়ে কমিশনর সহ-সভাপতিকে উদ্ধৃত করে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং জানিয়েছে, "নির্বাচনের দিনসহ তার আগে যেকোনো দিন সরকার জুলাই জাতীয় সনদ–এর ওপর গণভোটের আয়োজন করতে পারে"।

কমিশন তাদের সুপারিশে বলেছে: "ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ একই সঙ্গে সংবিধান সংস্কার পরিষদ ও জাতীয় সংসদ হিসেবে কার্যকর থাকবে। তবে সংবিধান সংস্কার পরিষদ কার্যকর থাকবে ২৭০ দিন"।

এ বিষয়ে বিকল্প প্রস্তাবে কমিশন বলেছে, যদি সংবিধান সংস্কার পরিষদ ২৭০ দিনের মধ্যে তাদের দায়িত্ব সম্পাদন করতে না পারে, তাহলে গণভোটে পাশ হওয়া বিল স্বয়ংক্রিয়ভাবে সংবিধানে প্রতিস্থাপিত হবে।

কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী, জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নের অঙ্গীকারনামা অনুসারে সংবিধানে জুলাই জাতীয় সনদ অন্তর্ভুক্ত হবে।

ঢাকায় এক সংবাদ সম্মেলনে ঐকমত্য কমিশনের সহ-সভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ এসব সুপারিশ প্রকাশ করেছেন।

সংবাদ সম্মেলনের আগে কমিশন তাদের সুপারিশগুলো অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে হস্তান্তর করে। ইউনূস নিজেই এ কমিশনের সভাপতি।

সুপারিশ কিভাবে বাস্তবায়ন হবে

সরকারের কাছে হস্তান্তরের পর সংবাদ সম্মেলনে ঐকমত্য কমিশনের সহ-সভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, এই সুপারিশগুলো কিভাবে বাস্তবায়িত হতে পারে সেই সুপারিশও তারা সরকারকে দিয়েছেন।

"যেসব বিষয় সাংবিধানিক বিষয় সংশ্লিষ্ট নয়, সরকার যেগুলো অধ্যাদেশের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করতে পারেন, সেটা যেন অবিলম্বে বাস্তবায়িত করা হয়। এর মধ্যে কিছু আছে অফিস অর্ডার দিয়েও বাস্তবায়ন সম্ভব, সেগুলো যেন দ্রুততার সঙ্গে বাস্তবায়ন করে," বলছিলেন তিনি।

তিনি বলেন, যেসব সুপারিশ সরকারের কাছে দেওয়া হয়েছে সেখানে এগুলো চিহ্নিত করতে দেয়া হয়েছে যে কোনগুলো অধ্যাদেশ বা অফিস অর্ডার দিয়ে বাস্তবায়ন সম্ভব।

সুপারিশে বলা হয়েছে, সরকারের এই আদেশের নাম হবে জুলাই জাতীয় সনদ (সংবিধান সংস্কার) বাস্তবায়ন আদেশ, ২০২৫।

তবে তিনি জানান যে, সাংবিধানিক কিছু বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ভিন্নমত আছে।

সে কারণে সংবিধান সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো বাস্তবায়নে আইনি ভিত্তি প্রদান ও জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নের পথে কীভাবে অগ্রসর হওয়া যাবে সে বিষয়েও তারা সুপারিশ করেছেন।

সংবিধান সংশ্লিষ্ট মোট ৪৮টি বিষয়ে সরকারকে পরামর্শ দিয়ে কমিশন এগুলো বাস্তবায়নে দুটি বিকল্প সরকারের কাছে তুলে ধরেছে।

"সরকারকে অনুরোধ করেছি যে সরকার যেন অবিলম্বে একটি আদেশ জারি করে। এ আদেশের বিষয় হবে জুলাই জাতীয় সনদে সংবিধান সংস্কার বিষয়ক। এই আদেশের অধীনে সরকার একটি গণভোটের আয়োজন করবেন," সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন রীয়াজ।

তাদের সুপারিশ হলো: এই গণভোটে জনগণের কাছে সরকার একটি প্রশ্ন উত্থাপন করবেন, তাহলো- "এ আদেশ ও আদেশের তফসিলে ৪৮টি সংবিধান সংশ্লিষ্ট বিষয়ে বাস্তবায়নের ব্যাপারে জনগণের সম্মতি আছে কি-না"।

"এই আদেশ জারির অব্যবহিত পর অনুষ্ঠিতব্য জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পূর্বে যথোপযুক্ত সময়ে অথবা উক্ত নির্বাচনের দিন এই আদেশ অনুসারে গণভোট অনুষ্ঠান করা হইবে"।

অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেছেন সুপারিশে বলা হয়েছে, ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ একই সঙ্গে সংবিধান সংস্কার পরিষদ ও জাতীয় সংসদ হিসেবে কার্যকর থাকবে, তবে সংবিধান সংস্কার পরিষদ কার্যকর থাকবে ২৭০ দিন।

"এ সময়ের মধ্যে সংবিধান সংস্কার পরিষদের সদস্যরা জুলাই সনদে বর্ণিত ও গণভোটে জনগণের সম্মতি এলে সংবিধানে সন্নিবেশিত করতে প্রয়োজন বিধি বিধান সংযোজন, পরিমার্জন, পরিবর্তন ও বিয়োজন করবেন"।

প্রসঙ্গ সংসদের উচ্চকক্ষ

ঐকমত্য কমিশন তাদের সুপারিশে সংসদ নির্বাচনের ভোটের সংখ্যানুপাতে ১০০ সদস্যের একটি উচ্চকক্ষের সুপারিশ করেছে।

এতে বলা হয়েছে, গণভোটে জনগণের সম্মতি এলে জাতীয় সংসদ প্রতিষ্ঠার ৪৫ দিনের মধ্যে উচ্চকক্ষ গঠনের বিষয়টি প্রয়োজনীয় সংশোধনীর মাধ্যমে বাস্তবায়িত হবে।

তবে উচ্চকক্ষ বিষয়ক সুপারিশে উচ্চকক্ষ গঠনের আগেই অর্থাৎ নির্বাচনের সময়েই সম্ভাব্য সদস্যদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রকাশের কথা বলা হয়েছে।

আলী রীয়াজ বলছেন, এবার যেহেতু সংসদ নির্বাচনের আগে এটা প্রকাশ করা সম্ভব হবে না সেহেতু প্রথমবারের মতো যে উচ্চকক্ষ গঠিত হবে সে উচ্চকক্ষ আগের থেকে তালিকা প্রকাশের বিধান কার্যকর হবে না।

এছাড়া ঐকমত্য কমিশন 'জুলাই জাতীয় সনদ' বাস্তবায়নের বিকল্প আরেকটি প্রস্তাবও তাদের সুপারিশে উল্লেখ করেছেন।

সেখানে বলা হয়েছে, "সরকার একটি আদেশ জারি করবেন, সেই আদেশের অধীনে গণভোট হবে, গণভোটে একটি মাত্র প্রশ্ন থাকবে। তবে ওই আদেশের তফসিলে যে ৪৮ বিষয় আছে সেগুলো অন্তর্বর্তী সরকার সেগুলো বিল আকারে প্রস্তুত করেও জনগণের সামনে উপস্থাপন করতে পারবেন"।

আলী রীয়াজ সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, "গণভোটে জনগণের সম্মতি পেলে ওই বিলটি সংবিধান সংস্কার পরিষদের কাজে সহযোগিতা করবে। এই পরিষদ জুলাই সনদের স্পিরিট ধারণ করে সংবিধানে প্রয়োজনীয় সংযোজন, পরিমার্জন, পরিবর্তন করতে পারবেন। এ বিল তাদের সহযোগিতা করবে"।

কিন্তু যদি সংবিধান সংস্কার পরিষদ ২৭০ দিনের মধ্যে তাদের দায়িত্ব সম্পাদন করতে না পারে তাহলে গণভোটে পাশ হওয়া বিল স্বয়ংস্ক্রিয়ভাবে সংবিধানে প্রতিস্থাপিত হবে, বলছিলেন রীয়াজ।

সংবিধান সংস্কার পরিষদ কিভাবে হবে

কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী, নির্বাচনের পর যে সংসদ কার্যকর হবে তারাই সংবিধান সংস্কার পরিষদের সদস্য হবেন।

"এক্ষেত্রে নির্বাচিত সংসদ সদস্যরা একাদিক্রমে সংসদ ও সংস্কার পরিষদের জন্য আলাদা শপথ নিবেন এবং অনুরূপ শপথপত্রে বা ঘোষণাপত্রে স্বাক্ষর দান করিবেন," বলা হয়েছে সুপারিশে।

সুপারিশে বলা হয়েছে, এই সংস্কার পরিষদ নিজেই নিজস্ব বিধি বিধান ঠিক করবে এবং এই পরিষদের বৈঠকে সংসদের নির্বাচিত স্পিকারই সভাপতিত্ব করবেন। স্পিকারের অনুপস্থিতিতে ডেপুটি স্পিকার এবং তাদের উভয়ের অনুপস্থিতিতে প্যানেল সদস্যরা এই দায়িত্ব পালন করবেন।

"এই আদেশের উদ্দেশ্য পূরণকল্পে, পরিষদ ইহার অধিবেশন আহ্বান ও মুলতবি, সংবিধান সংস্কার বিষয়ক প্রস্তাব উত্থাপনের পদ্ধতি, উক্ত প্রস্তাব বিবেচনা ও গ্রহণ এবং অন্য সকল বিষয়ে কার্যপ্রণালী নির্ধারণ করিবে। জাতীয় সংসদ সচিবালয় পরিষদকে সাচিবিক সহায়তা প্রদান করিবে," কমিশনের সুপারিশে বলা হয়েছে।

"আমরা আশা করি সংবিধান সংস্কার পরিষদ দায়িত্ব পালনে সক্ষম হবেন। রাজনৈতিক দলগুলো ও নির্বাচিত প্রতিনিধি হিসেবে যারা গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের সূচনায় ভূমিকা রাখবেন তারা এ দায়িত্ব পালনে অকুণ্ঠিত হবেন। এখন সরকার যেন যত দ্রুত সম্ভব বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ার সূচনা করেন," সংবাদ সম্মেলনে বলছিলেন রীয়াজ।

প্রসঙ্গত, ২০২৪ সালের অক্টোবরে অন্তর্বর্তী সরকার সংবিধান সংস্কারসহ বিভিন্ন বিষয়ে ৬টি কমিশন গঠন করেছিলো।

এ সব কমিশনের সুপারিশ চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে সরকারের কাছে দেয়ার প্রেক্ষাপটে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গঠন করা হয়।

কমিশন সরকার কর্তৃক গঠিত বিভিন্ন কমিশনের সুপারিশমালার আলোকে ১৬৬টি সুপারিশ দিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মতামত চেয়েছিলো এবং দলগুলো এ বিষয়ে তাদের লিখিত মতামত প্রেরণ করেছিল। এরপর গত মার্চ মাস থেকে দলগুলোর সাথে আলোচনা শুরু করে কমিশন।

বিশেষ করে কুড়িটি মৌলিক সংস্কারের বিষয়ে ৩০টি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে বলে জানিয়েছেন অধ্যাপক আলী রীয়াজ।

"প্রাথমিক পর্যায়ে ৬৪টি বিষয়ে ঐকমত্য বা সিদ্ধান্ত হয়। পরে ২০টির মতো বিষয়ে দু'মাস অব্যাহত আলোচনা হয়েছে। অনেক বিষয়ে ঐকমত্য ও ক্ষেত্র বিশেষে নোট অব ডিসেন্ট সহ সিদ্ধান্ত হয়েছে," সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন তিনি।