আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে পাহাড়ে সংঘাত সৃষ্টির পাঁয়তারা করছে আঞ্চলিক সংগঠন প্রসীত বিকাশ খীসার নেতৃত্বাধীন ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট-ইউপিডিএফ। প্রতিবেশী একটি রাষ্ট্রের ইন্ধনে তারা খাগড়াছড়িতে একটি সহিংস পরিবেশ সৃষ্টি করতে চায়। তাদের উদ্দেশ্য অন্তর্বর্তী সরকারকে বেকাদায় ফেলা এবং নির্বাচনকে বাধাগ্রস্ত করা। সম্প্রতি প্রসীত খীসা ওই দেশটির শীর্ষ এক নিরাপত্তা কর্মকর্তার সঙ্গে বৈঠক করেছেন। যে কোনো ইস্যুতে পাহাড়ে একটি অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টির জন্য বৈঠকে সমঝোতা হয়েছে। বিনিময়ে ইউপিডিএফ বিনা বাধায় সীমান্ত দিয়ে দেশটি থেকে পাহাড়ে অস্ত্র আনতে পারবে। বিভিন্ন সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
চলতি বছর নানা ইস্যুতে আন্দোলনের নামে পাহাড়ে অশান্ত পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে চেয়েছিল ইউপিডিএফ। জনগণকে বিভ্রান্ত করে তারা এসব আন্দোলনের প্লট সাজায়। সেপ্টেম্বরে মারমা কিশোরীকে কথিত ধর্ষণের অভিযোগ তুলে তুলকালাম পরিস্থিতি তৈরি করে তারা। ইউপিডিএফ-এর ইন্ধনে সৃষ্ট ‘জুম্ম ছাত্র-জনতা’র ব্যানারে টানা চারদিনের অবরোধে অচল হয়ে পড়ে খাগড়াছড়ি। আন্দোলন জেলা শহরকেন্দ্রিক হলেও পূর্বপরিকল্পিতভাবে শহর থেকে ৩০ কিলোমিটার দূরের গুইমারায় রক্তাক্ত পরিস্থিতি তৈরি করা হয়। বিভিন্ন প্রত্যন্ত এলাকা থেকে আসা ইউপিডিএফ সদস্যরা ১৪৪ ধারা ভেঙে অবরোধ করে ব্যাপক তাণ্ডব চালান। ক্ষতিগ্রস্ত রামসু বাজারের বাসিন্দারা বলেন, ইউপিডিএফ-এর ছাত্র সংগঠন পিসিপির ছেলেরা বাইরে থেকে এসে সড়ক অবরোধ করে ভয়ংকর পরিস্থিতি তৈরি করে। তাদের আমরা গ্রামে আসতে নিষেধ করি। কিন্তু তারা তা শুনেনি। আমরা পাহাড়ি-বাঙালি মিলেমিশে বসবাস করতাম। কিন্তু ইউপিডিএফ-এর কারণে এখানে সম্প্রীতি নষ্ট হয়েছে।
এছাড়া ২৪ অক্টোবর খাগড়াছড়িতে মব সৃষ্টি করে ইউপিডিএফ। জেলার লক্ষ্মীছড়ি উপজেলার বর্মাছড়িতে অস্থায়ী সেনা ক্যাম্প স্থাপনকে কেন্দ্র করে একটি রক্তক্ষয়ী পরিস্থিতি তৈরি করতে চেয়েছিল সংগঠনটি। ইউপিডিএফ স্থানীয় গ্রামবাসীদের সেনাবাহিনীর মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়। এ সময় উপস্থিত সেনা সদস্যরা শান্তভাবে পরিস্থিতি মোকাবিলা করায় ইউপিডিএফ-এর পরিকল্পনা ভেস্তে যায়।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, মূলত বর্মাছড়িতে ইউপিডিএফ-এর সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের হেডকোয়ার্টার রয়েছে। দলটিতে বর্তমানে পাঁচ শতাধিক সশস্ত্র সদস্য রয়েছে বলে জানা যায়। এছাড়া রাঙামাটির নানিয়াচর, কতুকছড়ি, সাজেকের ভুয়াছড়ি, পানছড়ির বিভিন্ন এলাকা এবং দীঘিনালার উত্তর অংশে দলটির সশস্ত্র অবস্থান রয়েছে। এ কারণেই ইউপিডিএফ ও তাদের সমর্থক জনপ্রতিনিধিরা বর্মাছড়িতে অস্থায়ী সেনা ক্যাম্প স্থাপন বাধাগ্রস্ত করতে উঠে-পড়ে লেগেছে। সড়কে বাঁশ-গাছ দিয়ে ব্যারিকেড তৈরি করে কাজে বাধা দিয়েছে। ৬০ বর্গকিলোমিটারের বর্মাছড়িতে ইউপিডিফের জয় বসু, চিফ কালেক্টর রবি চন্দ্র অর্কিডসহ বেশ কয়েকজন নেতা অবস্থান করছেন। সেনাবাহিনীর অস্থায়ী ক্যাম্প স্থাপিত হলে তাদের সেই আধিপত্য থাকবে না। তাই তারা সেনা ক্যাম্পের বিরোধিতা করে বিভিন্ন অপপ্রচার চালায়।
এছাড়া প্রায় এক দশক আগে লক্ষ্মীছড়ি থেকে বর্মাছড়ি ইউনিয়নে যাতায়াতের জন্য পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড সড়ক নির্মাণের প্রকল্প গ্রহণ করে। ইউপিডিএফ-এর বাধায় প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হয়নি। জেলার বর্মাছড়ি একমাত্র জায়গা, যেখানে সড়ক যোগাযোগ স্থাপিত হয়নি। মূলত নিজেদের আধিপত্য ও সশস্ত্র অবস্থান টিকিয়ে রাখতে ইউপিডিএফ সড়ক নির্মাণে বাধা দেয়।
১৬ জানুয়ারি ভারতের মিজোরাম রাজ্যের পুলিশ অস্ত্রের বড় একটি চালান জব্দ করে। এ ঘটনায় ইউপিডিএফ জড়িত বলে জানায় মিজোরামের পুলিশ। এ ধরনের পরিস্থিতির পুনরাবৃত্তি না ঘটাতে এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের সীমান্ত দিয়ে অস্ত্র আনার ক্ষেত্রে বিশেষ সুবিধা পেতে বর্তমানে ইউপিডিএফ নেতারা প্রতিবেশী দেশটির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরি করছে।
ইউপিডিএফ নেতারা কোথায় : ইউপিডিএফ-এর শীর্ষ নেতাদের বেশির ভাগই ভারতে অবস্থান করছে বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়। মূলত সেখানে বসেই দলটির শীর্ষ নেতা প্রসীত বিকাশ খীসাসহ অন্যরা পাহাড়ে অশান্ত পরিস্থিতি তৈরির ইন্ধন দিচ্ছেন। ভারতের কলকাতা, ত্রিপুরার আগরতলা ও মিজোরামে তাদের অবস্থান রয়েছে। ইউপিডিএফ নেতা মিল্টন চাকমা প্রাণেশ, প্রদীপন চাকমা, রবিশংকর চাকমা, সুগত চাকমা, নতুন কুমার চাকম ও উজ্জ্বল স্মতি চাকমা ভারতে অবস্থান করছেন। এছাড়া মাইকেল চাকমা, সচিব চাকমা ও অংকন চাকমাসহ বেশ কয়েকজন নেতা ঢাকায় রয়েছেন। ভারতে থাকা খাগড়াছড়ির আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করেছেন ইউপিডিএফ নেতারা।
নারী-শিশুদের ঢাল হিসাবে ব্যবহার : দুর্গম প্রত্যন্ত এলাকাগুলোয় সাধারণ মানুষকে ভয় দেখিয়ে জিম্মি করে আন্দোলন-মিছিলে যেতে বাধ্য করে ইউপিডিএফ। বিশেষত নারী ও শিশুদের ব্যবহার করে তারা। সম্প্রতি আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর) এক বিবৃতিতে বিষয়টি আরও স্পষ্ট হয়। ৬ অক্টোবর পানছড়ির যুবনেশ্বরপাড়ায় সেনাবাহিনী অভিযান চালায়। অভিযানে ইউপিডিএফ-এর সশস্ত্র সদস্যদের ব্যবহৃত ১টি পিস্তল, ম্যাগাজিন, ২ রাউন্ড অ্যামোনিশন, ১৫টি ব্যানার, ২টি ওয়াকিটাকি, ২টি মোবাইল ফোন ও ধারালো অস্ত্র উদ্ধার করা হয়। অভিযান চলাকালে সেনাবাহিনীর কার্যক্রম ব্যাহত করতে ইউপিডিএফ স্থানীয় নারী-পুরুষ ও ছাত্র-ছাত্রীদের সেনাবিরোধী স্লোগান দিতে বাধ্য করে। বিবৃতিতে আরও বলা হয়, ইউপিডিএফ ও এর অঙ্গসংগঠনগুলো পার্বত্য চট্টগ্রামকে অস্থিতিশীল করার লক্ষ্যে সুপরিকল্পিতভাবে এলাকার নারী ও স্কুলগামী কোমলমতি শিশুদের বিভিন্ন পন্থায় তাদের নাশকতামূলক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণে বাধ্য করছে। মূলত স্থানীয় কারবারিদের মাধ্যমে ইউপিডিএফ বিভিন্ন কর্মসূচিতে মানুষকে জমায়েত করায়। কর্মসূচিতে অংশ না নিলে স্থানীয়দের শারীরিক শাস্তি ও আর্থিকভাবে জরিমানা করা হয়।
সতর্ক প্রশাসন : খাগড়াছড়িতে কেউ যাতে নতুন করে অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরি করতে না পারে, সেজন্য সতর্ক রয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। অনুমতি ছাড়া জেলায় কোনো মিছিল-সমাবেশ করার ক্ষেত্রে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। ২১ অক্টোবর আইনশৃঙ্খলা কমিটির মাসিক সভায় জনস্বার্থে এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে জানান জেলা প্রশাসক এবিএম ইফতেখারুল ইসলাম খন্দকার। তিনি বলেন, অনিবন্ধিত সংগঠনের ক্ষেত্রে এই সিদ্ধান্ত প্রযোজ্য হবে। অনেক সময় ফেসবুকে ঘোষণা দিয়ে হঠাৎ করে মিছিল মিটিং করা হয়। এতে সাধারণ জনগণের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হয়।
খাগড়াছড়ি পুলিশ সুপার মো. আরেফিন জুয়েল বলেন, জেলা শহরের বিভিন্ন পয়েন্টে নিরাপত্তা জোরদার করতে সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপনের জন্য পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয় একটি প্রকল্প গ্রহণ করেছে। এর আওতায় পৌর শহর ছাড়াও জেলার প্রবেশদ্বার হিসাবে পরিচিত মানিকছড়ি ও রামগড়েও ক্যামেরা স্থাপন করা হবে।