নতুন বছরের বাকি আছে মাত্র দুই মাস। অথচ ষষ্ঠ থেকে নবম-দশম শ্রেণি পর্যন্ত প্রায় ২১ কোটি বই ছাপার কাজ এখনো শুরু হয়নি। এতে বছরের শুরুতে, অর্থাৎ জানুয়ারিতে মাধ্যমিকের সব বই পাওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে।
মাধ্যমিকের বইয়ের কাজ পিছিয়ে থাকলেও এগিয়ে আছে প্রাথমিকের বইয়ের কাজ।
নভেম্বরের মাঝামাঝিতে প্রাথমিকের সব বই উপজেলা পর্যায়ে পৌঁছে যাবে বলে জানিয়েছে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, দরপত্রসংক্রান্ত জটিলতায় মাধ্যমিকের বইয়ের কাজ শুরু করতে দেরি হচ্ছে। বিশেষ করে ষষ্ঠ, সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণির পুনঃ দরপত্র হওয়ার কার্যাদেশ এখনো দেওয়া সম্ভব হয়নি। আবার শিক্ষা মন্ত্রণালয়ও সিদ্ধান্ত নিতে সময়ক্ষেপণ করছে।
জনগুরুত্ব বিবেচনায় বই ছাপা সংক্রান্ত ফাইল তারা দ্রুততার সঙ্গে ছাড় করছে না। এমন পরিস্থিতিতে নির্দিষ্ট সময়ে বই পাওয়া নিয়ে সংশয় তৈরি হয়েছে।
সূত্র জানায়, গত সোমবার পর্যন্ত প্রাথমিকের প্রায় ৬৫ শতাংশ বই ছাপার কাজ শেষ হয়েছে। তবে উপজেলা পর্যায়ে পৌঁছেছে ৪১ শতাংশ বই।
অন্যদিকে মাধ্যমিকের নবম-দশম শ্রেণির কার্যাদেশ গত সোমবার থেকে দেওয়া শুরু হয়েছে। গতকাল দু-চারজন প্রেস মালিক কাজের জন্য এনসিটিবির সঙ্গে চুক্তিও শেষ করেছেন। তবে ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণির কার্যাদেশ শিগগিরই দেওয়া হবে বললেও সুনির্দিষ্ট তারিখ এখনো জানাতে পারেনি এনসিটিবি।
প্রেস মালিকরা জানিয়েছেন, কার্যাদেশ দেওয়ার পর নিয়ম অনুযায়ী এনসিটিবির সঙ্গে চুক্তি করতে ২৮ দিন সময় পান তাঁরা। তবে এবার যেহেতু হাতে তেমন সময় নেই, তাই হয়তো এত দিন সময় মিলবে না।
চুক্তির পর বইয়ের কাজ শেষ করতে অন্তত ৭০ দিন সময় দিতে হয়। ফলে নিয়ম অনুযায়ী ডিসেম্বরের পর বই দেওয়ার সুযোগ পাবেন তাঁরা। এখনো যেহেতু ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণির বইয়ের কার্যাদেশই দেওয়া হয়নি, ফলে এসব বই ছাপার ক্ষেত্রে অনেক বেশি সময় লাগবে তাঁদের।
বাংলাদেশ মুদ্রণ শিল্প সমিতির সাবেক সভাপতি তোফায়েল খান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ডিসেম্বরের মধ্যে মাধ্যমিকের সব বই ছাপা শেষ করা কঠিন। আমার মনে হয়, শিক্ষা মন্ত্রণালয় সিদ্ধান্ত নিতে অনেক বেশি সময় নিচ্ছে। তাদের কাছে এনসিটিবি থেকে একটা ফাইল পাঠানো হলে দীর্ঘদিন সময় লাগছে। ফলে ছাপার কাজ শুরু করতে দেরি হয়ে যাচ্ছে।’
বইয়ের কাজ শেষ হতে দেরি হওয়ার বিষয়ে তোফায়েল খান বলেন, ‘মাধ্যমিকের বইয়ের পৃষ্ঠা অনেক বেশি। এত দিনে যদি নবম শ্রেণির বইয়ের কাজ শেষ হয়ে যেত, তাহলে হয়তো কাগজের ওপর প্রেসার কম পড়ত। কিন্তু এখন নবম শ্রেণির কার্যাদেশ দেওয়া হয়েছে। আগামী সপ্তাহে ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণির কার্যাদেশও দেওয়া শুরু হতে পারে। এতে ছাপাখানার ওপর একসঙ্গে সব চাপ পড়বে। আবার কাগজ মিলগুলোর ওপর একসঙ্গে চাপ পড়বে, যা সামলানো কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। শেষ সময়ে তাড়াহুড়া করে কাজ করতে গিয়ে বইয়ের মান ঠিক রাখাটাও কঠিন হয়ে পড়বে।’
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, এ বছর বই ছাপানোর কাজের প্রক্রিয়া আগেভাগে শুরু করেছিল এনসিটিবি। নভেম্বরের মধ্যে সব বই মাঠ পর্যায়ে পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যও নির্ধারণ করা হয়েছিল। কিন্তু শেষ সময়ে মাধ্যমিকের তিন শ্রেণির (ষষ্ঠ, সপ্তম ও অষ্টম) পাঠ্যবইয়ের দরপত্র বাতিল হয়ে যাওয়া এবং নবম-দশম শ্রেণির কার্যাদেশ যথাসময়ে অনুমোদন না হওয়ায় সেই পরিকল্পনা অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ে যায়। যদিও তিন শ্রেণির পুনঃ দরপত্র হওয়ায় প্রেস মালিকরা প্রায় ৩০ শতাংশ কম দরে কাজ নিয়েছেন। এতে সরকারের পায় ১৫০ কোটি টাকা সাশ্রয় হয়েছে। কিন্তু এত কম দরে কাজ নেওয়ায় বইয়ের মান নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে।
জানা যায়, আগামী ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে জাতীয় সংসদ নির্বাচন হওয়ার কথা রয়েছে। ডিসেম্বরের প্রথমার্ধে তফসিল ঘোষণার কথা। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে শ্রমিকসংকট ও ছাপাখানাগুলো ব্যস্ত হয়ে যাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এই সময়ে তড়িঘড়ি বই দেওয়ার অজুহাতে নিম্নমানের কাগজে পাঠ্যবই গছিয়ে দেওয়ার সুযোগ নিতে পারেন অসাধু ব্যবসায়ীরা।
একাধিক প্রেস মালিকের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রাথমিকের পাঠ্যবইয়ের সংখ্যা প্রায় ৯ কোটি। বইয়ের আকার ছোট হওয়ায় ফর্মা লাগছে কম। এসব পাঠ্যবই ছাপতে বেশি সময় লাগে না। অনেক প্রতিষ্ঠানের কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে। অন্যদিকে মাধ্যমিক স্তরে বইয়ের সংখ্যা প্রায় ২১ কোটি। এখানে ফর্মা অনেক বেশি। যারা বেশি কাজ পেয়েছে, তারা যদি এখনই ছাপানো শুরু করতে না পারে, তাহলে ডিসেম্বরে গিয়ে জটিল পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে।
এনসিটিবির সদস্য (পাঠ্যপুস্তক) অধ্যাপক ড. রিয়াদ চৌধুরী কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ডিসেম্বরের মধ্যে কাজ শেষ করা নিয়ে আমরা কিন্তু খুব আশাবাদী। কারণ প্রাথমিকের বইয়ের কাজ প্রায় শেষ। নবম শ্রেণির বইয়ের কার্যাদেশ দেওয়া হয়েছে। ফলে এই শ্রেণির বইয়ের কাজ শুরু হয়ে যাবে। অন্য তিন শ্রেণির বইয়ের কার্যাদেশও শিগগিরই দেওয়া হবে। আমরা সবাই মিলে সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি। দিনরাত কাজ করছি। প্রেস মালিকরাও আন্তরিক। ফলে আশা করছি, আমরা পারব।’
ড. রিয়াদ চৌধুরী বলেন, ‘বইয়ের মানের ক্ষেত্রে আমরা কোনো কম্প্রোমাইজ করছি না। আমরা কঠোর মনিটরিং করছি। স্পেসিফিকেশনে যা উল্লেখ আছে সে অনুযায়ীই প্রাথমিকের বই যাচ্ছে। মাধ্যমিকের বইয়ের ক্ষেত্রেও আমরা মান নিয়ে কোনো আপস করব না।’