Image description

বেসরকারি স্কুল-কলেজ রাজনৈতিক প্রভাব মুক্ত রাখতে সরকারি কর্মকর্তাদের দিয়ে ম্যানেজিং কমিটি গঠন করে নীতিমালায় আমূল পরিবর্তন আনার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এ সিদ্ধান্তে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কর্মরত শিক্ষক-কর্মচারীদের পাশাপাশি সচেতন নাগরিক এবং অভিভাবকরাও সন্তোষ প্রকাশ করেন। তবে বিষয়টি নির্বাচনের কাজে বাধাগ্রস্ত করবে— এমন নানা যুক্তি ও কারণ দেখিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের নেওয়া আলোচিত এই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেছে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপি। ম্যানেজিং কমিটি নিয়ে ইতোমধ্যে সরকারের পক্ষ থেকে পরিপত্র জারি করলেও আইনি জটিলতায় সেটি স্থগিত করা হয়েছে; ফলে পুরো বিষয়টি বাস্তবায়ন অনেকটাই অনিশ্চয়তায় পড়বে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন সংশ্লিষ্টরা।

বিএনপি সংশ্লিষ্টদের মতে, সরকারের এই পদক্ষেপের মাধ্যমে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণের আওতায় আনা হচ্ছে। বিএনপি নেতারা মনে করেন, সরকারি কর্মকর্তারা সরকারি মানসিকতা ও আমলাতান্ত্রিক প্রভাব বহন করেন, ফলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের স্বায়ত্তশাসন ক্ষুণ্ন হওয়ার আশঙ্কা থেকে যায়। বিষয়টি স্থগিত চেয়ে ইতোমধ্যেই নির্বাচন কমিশন (ইসি) বরাবর লিখিত দাবি জানিয়েছে বিএনপি। দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য আবদুল মঈন খান বলেন, ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী সারাদেশে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ম্যানেজিং কমিটি, গভর্নিং বডি গঠিত হয়েছে। হঠাৎ করে শিক্ষা মন্ত্রণালয় জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময়সূচি ঘোষণার ঠিক পূর্ব মুহূর্তে এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তড়িঘড়ি করে ১ নভেম্বরের মধ্যে নতুন করে নির্বাচন সম্পন্নের জন্য নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে; যা সম্পূর্ণ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে মনে হয়।

বিএনপির দাবি, শিক্ষা ব্যবস্থায় সরকারি প্রভাব নয়, বরং অংশগ্রহণমূলক ও গণতান্ত্রিক পরিচালনাই শিক্ষার মানোন্নয়নে সহায়ক। কর্মকর্তারা পেনশনভুক্ত ও সরকারি সুবিধার ওপর নির্ভরশীল থাকায় তাদের মাধ্যমে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নিরপেক্ষতা ও স্বাধিকার ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। সরকারি কর্মকর্তারা মানসিকতায় আমলাতান্ত্রিক প্রভাব বহন করেন; ফলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের গণতান্ত্রিক বা স্থানীয়ভাবে নির্বাচিত নেতৃত্বকে সরকারকে পাশ কাটাতে চাচ্ছে।

যদিও বিএনপির এই মনোভাবের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় এমনকি শিক্ষকরা। তারা বলছেন, দীর্ঘদিন ধরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন চলছে। এটি বন্ধ করতে ম্যানেজিং কমিটি গঠন সংক্রান্ত নীতিমালা পরিবর্তন করা হয়েছে। কিন্তু বিএনপি কেন এটির বিরোধিতা করছে— তা বোধগম্য নয়। হতে পারে এমন নীতিমালার ফলে বিএনপি তাদের পছন্দের লোকদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রবেশ করাতে পারবে না, সেজন্য এর বিরোধিতা করছে।

বিষয়টি নিয়ে কথা হয় এমপিওভুক্ত শিক্ষা জাতীয়করণ প্রত্যাশী জোটের সদস্য সচিব অধ্যক্ষ দেলাওয়ার হোসেন আজীজির সঙ্গে। দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে তিনি বলেন, সরকারি স্কুল-কলেজের ন্যায় বেসরকারি স্কুল-কলেজও রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত রাখতে হবে। অন্তর্বর্তী সরকার যে উদ্যোগ নিয়েছিল; তা সবার মাঝে আনন্দের বার্তা বয়ে এনেছিল। তবে এ প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্থ করার চেষ্টা করা হচ্ছে। আমরা বিষয়গুলো পর্যালোচনা করছি। প্রয়োজনে শিক্ষকদের নিয়ে আবার রাজপথে আন্দোলনের ডাক দেওয়া হবে। স্কুল-কলেজকে রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নমুক্ত রাখতে হবে।

‘আপাতত শুধু সরকারি কর্মকর্তাদের ম্যানেজিং কমিটিতে রাখার বিধান করা হয়েছে। ভবিষ্যতে এটি পরিবর্তন করে বেসরকারি চাকরিজীবীদের এখানে যুক্ত করা যেত। এছাড়া মাস্টার্স পাসের পরিবর্তে স্নাতক পাসও করা যেত। এ ধরনের প্রস্তাবনা আমাদের বিবেচনায় রয়েছে। কিন্তু সবকিছুর বাইরে গিয়ে পরিপত্র স্থগিত করে দেওয়ার বিষয়টি সঠিক হয়নি বলেই আমাদের মনে হয়েছে।’— উপ-সচিব, শিক্ষা মন্ত্রণালয়

 

তবে শিক্ষকদের এমন মনোভাবের সঙ্গে ভিন্নমত করেছেন শিক্ষা বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, সরকারি চাকরিজীবীরাও দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত— এমন অংখ্য উদাহারণ রয়েছে। কাজেই ম্যানেজিংক কমিটিতে কেবল সরকারি কর্মকর্তাদের রাখার বিধান যুক্তিসঙ্গত নয়। সরকার চাইলে এ জায়গায় আরও কাজ করতে পারত। তবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিতে তারা সেটি করেনি।

এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক মুজিবুর রহমান দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করতে চাওয়া ভালো বিষয়। তবে কেবল সরকারি চাকরিজীবীদের রাখার সিদ্ধান্ত ভালো হয়নি। সরকার চাইলে এখানে স্থানীয় গণমান্য শিক্ষিত ব্যক্তি রয়েছেন, যাদের রাজনৈতিক কোনো সম্পৃক্ততা নেই তাদের যুক্ত করার বিধান রাখা যেত। সবক্ষেত্রে আমলাদের রাখার চিন্তা থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। আমরা দেখেছি অনেকে রয়েছেন, যারা নিজ উদ্যোগে স্কুল করেছেন, সেটি তদারকি করছেন। অথচ তার কোনো আক্ষর-জ্ঞান নেই। কিন্তু তারা স্কুল-কলেজের উন্নয়নে সবকিছু উজার করে দেন। বিষয়গুলো নিয়ে সরকারের আরও ভাবা উচিত।’

তথ্যমতে, গত ৩১ আগস্ট স্কুল-কলেজে ম্যানেজিং কমিটি গঠন সংক্রান্ত নতুন প্রজ্ঞাপন জারি করে সরকার। সরকারের এ প্রজ্ঞাপনের কয়েকটি ধারা বৈষম্যমূলক উল্লেখ করে আদালতে যায় একটি গ্রুপ। এই গ্রুপটি বিএনপিপন্থি বলে অভিযোগ উঠেছিল। এ অভিযোগ আরও পাকাপোক্ত হয় গত ২৩ অক্টোবর নির্বাচন কমিশনে স্কুল-কলেজে ম্যানেজিং কমিটি-গভর্নিং বডি নির্বাচন স্থগিত চেয়ে আবেদনের পর।

সিইসি এ এম এম নাসির উদ্দিনের কাছে একটি আবেদন জমা দেয় বিএনপির তিন সদস্য বিশিষ্ট এক প্রতিনিধিদল। প্রতিনিধদলের নেতৃত্বে ছিলেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আবদুল মঈন খান। প্রতিনিধিদলে আরও ছিলেন চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ইসমাইল জবিউল্লাহ এবং ইসির সাবেক অতিরিক্ত সচিব মোহাম্মদ জাকারিয়া। 

সরকারি স্কুল-কলেজের ন্যায় বেসরকারি স্কুল-কলেজও রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত রাখতে হবে। অন্তর্বর্তী সরকার যে উদ্যোগ নিয়েছিল; তা সবার মাঝে আনন্দের বার্তা বয়ে এনেছিল। তবে এ প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্থ করার চেষ্টা করা হচ্ছে। আমরা বিষয়গুলো পর্যালোচনা করছি। প্রয়োজনে শিক্ষকদের নিয়ে আবার রাজপথে আন্দোলনের ডাক দেওয়া হবে। স্কুল-কলেজকে রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নমুক্ত রাখতে হবে।—অধ্যক্ষ দেলাওয়ার হোসেন আজীজি, সদস্য সচিব, এমপিওভুক্ত শিক্ষা জাতীয়করণ প্রত্যাশী জোট

দলটি ইসিতে লিখিত প্রস্তাবে জানায়, সারাদেশে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ম্যানেজিং কমিটি নতুন এই কার্যক্রমের ফলে সারাদেশে শিক্ষক/শিক্ষিকাদের বার্ষিক পরীক্ষার একাডেমিক কার্যক্রম, ভোটগ্রহণ কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ কার্যক্রম, ভোটকেন্দ্রের নির্বাচনের প্রাক কার্যক্রম ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। এতে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মতো একটি বৃহৎ কার্যক্রমে শিক্ষক/শিক্ষিকা, অভিভাবক/অভিভাবিকা তথা ভোটারদের মধ্যে চরম বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। তাই অবিলম্বে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ম্যানেজিং কমিটি/গভর্নিং বডি নির্বাচন সংক্রান্ত নির্দেশনা স্থগিত করতে হবে।

বিএনপির এমন আবেদন নিয়ে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখায় শিক্ষক থেকে শুরু করে খোদ শিক্ষা মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয় বলছে, ম্যানেজিং কমিটি গঠন সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপনে কোনো পরিবর্তন আনার দরকার হলে তাদের কাছে প্রস্তবনা দেওয়া যেত। নীতিমালায় সংশোধনী আনা সম্ভব ছিল। তবে আদালত কিংবা ইসিতে আবেদন করে পুরো প্রক্রিয়াটি বন্ধ করে দেওয়া উচিত হয়নি। শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োগসহ নানা অনিয়ম বন্ধ করতে ম্যানেজিং কমিটি নীতিমালা তৈরি করা হয়েছিল। এটি বাধাগ্রস্থ হলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দুর্নীতি বন্ধ হবে না।

এর আগে নিয়মিত কমিটি গঠন ও অ্যাডহক কমিটি বিলুপ্তির সময়সীমাসংক্রান্ত পরিপত্র স্থগিত চেয়ে আদালতে রিট করেন আইনজীবী ফখরুল ইসলাম। তিনি বলেন, নয়টি বোর্ড ম্যানেজিং কমিটি পরিচালনাসংক্রান্ত প্রবিধানমালায় সংশোধন আনে। এতে দেখা যায় সরকারি, আধা সরকারি বা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান কর্মরত নবম গ্রেডের নিচে নন এমন কর্মকর্তা এবং অবসরপ্রাপ্ত হলে পঞ্চম গ্রেডের কর্মকর্তা— সভাপতি হতে পারবেন। অর্থাৎ বেসরকারি এসব প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি পাবলিক সার্ভেন্ট ছাড়া কেউ হতে পারবে না; যা বৈষম্যমূলক। আগে সভাপতি নির্বাচনের মাধ্যমে হতেন। প্রবিধানমালার সংশোধিত ১৩(১) এবং ৬৪(৩) বিধির বৈধতা নিয়ে রিটটি করা হয়।

এই আইনজীবী আরও বলেন, সংশোধিত ১৩(১) এবং ৬৪(৩) বিধি কেন বেআইনি ঘোষণা করা হবে না, রুলে তা জানতে চাওয়া হয়েছে। অ্যাডহক কমিটি বিলুপ্তসংক্রান্ত ৮ সেপ্টেম্বরের পরিপত্রের কার্যক্রম স্থগিত করেছেন আদালত। ফলে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক স্তরের বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গঠিত অ্যাডহক কমিটি কাজ চালিয়ে যেতে পারবে। আদালতে রুলের বিষয়ে পদক্ষেপ সম্পর্কে জানতে চাইলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, আদালতের নির্দেশনার প্রতি সম্মান দেখিয়ে আমরা জবাব দেব। রিটের পক্ষে যে রুল জারি করা হয়েছে, সেটি স্থগিত করার জন্য বিষয়টি আইনিভাবেই মোকাবেলা করা হতে পারে।’ 

সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে শিক্ষা মন্ত্রনালয়ের এক উপসচিব দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ‘আপাতত শুধু সরকারি কর্মকর্তাদের ম্যানেজিং কমিটিতে রাখার বিধান করা হয়েছে। ভবিষ্যতে এটি পরিবর্তন করে বেসরকারি চাকরিজীবীদের এখানে যুক্ত করা যেত। এছাড়া মাস্টার্স পাসের পরিবর্তে স্নাতক পাসও করা যেত। এ ধরনের প্রস্তাবনা আমাদের বিবেচনায় রয়েছে। কিন্তু সবকিছুর বাইরে গিয়ে এমন সিদ্ধান্তের কারণে নির্বাচন বন্ধ কিংবা নিয়মিত কমিটি গঠন ও অ্যাডহক কমিটি বিলুপ্তির সময়সীমাসংক্রান্ত পরিপত্র স্থগিত করে দেওয়ার বিষয়টি সঠিক হয়নি বলেই আমাদের মনে হয়েছে।