রাষ্ট্র কাঠামো সংস্কারে ৩১ দফার রূপরেখা ঘোষণা করেছিল বিএনপি। সেখানে দ্বিতীয় দফায় উল্লেখ আছে ‘রেইনবো নেশন’ বা রংধনু জাতির দর্শন। বিভিন্ন সময়ে বিএনপি নেতাদের বক্তব্যে এ ধারণা জনগণের কাছে তুলে ধরা হয়।
রেইনবো নেশন তত্ত্ব কী
রেইনবো নেশন তত্ত্ব হলো দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদ-পরবর্তী সময়ে একটি ধারণা, যা আর্চবিশপ ডেসমন্ড টুটু প্রচলন করেন। এর মূল লক্ষ্য ছিল এমন একটি সমাজ গঠন করা, যেখানে জাতি, বর্ণ ও ধর্ম নির্বিশেষে সকল নাগরিকের সমান অধিকার ও মর্যাদা থাকবে। নেলসন ম্যান্ডেলা ১৯৯৪ সালে রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পর এই তত্ত্বটিকে ব্যাপকভাবে পরিচিত করেন এবং একে তার ‘রংধনু জাতি’র আদর্শ হিসেবে ঘোষণা করেন।
সম্প্রতি বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ক্ষমতায় গেলে বিএনপি সব জাতিগোষ্ঠীকে সঙ্গে নিয়ে ‘রেইনবো নেশন’ গড়ে তুলবে।
তিনি বলেন, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ২০২২ সালে ৩১ দফা ঘোষণা দিয়েছেন। সেখানে তিনি বলেছেন আমরা একটা রেইনবো নেশন তৈরি করব। অর্থাৎ যে নেশন সব সম্প্রদায় অন্তর্ভূক্ত হয়ে অবদান রাখতে সক্ষম হবে। আগামীতে বিএনপি সরকারে এলে অবশ্যই অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে সব সমস্যা বিবেচনা করা হবে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী রেইনবো নেশনের ব্যাখ্যায় বলেন, আজকে নতুন প্রজন্মের কাছে ভাষা ও সংস্কৃতি পরিবর্তন হচ্ছে। এখানে অনেক ধর্মের ও বর্ণের মানুষ বাস করে। সবার ধর্ম, ভাষা ও সংস্কৃতিকে প্রাধান্য বা সম্মান জানানোর জন্য রেইনবো নেশন। সেই জায়গা থেকে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদকে মূলে রেখে নতুনভাবে রেইনবো নেশনের কথা বলা হচ্ছে। যা নতুন প্রজন্মের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে।
বিএনপি নেত্রী রুমিন ফারহানা রেইনবো নেশন নিয়ে বলেন, আমরা পেছনে ফেলে আগাবো না। সবাইকে নিয়ে একটা ইনক্লুসিভ ন্যাশন করার কথা বলছি। এবং গত এক দশকে যেভাবে জাতিকে বিভাজিত করা হয়েছে বিভিন্ন ধোয়া তুলে। কখনো মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ-বিপক্ষ শক্তি, কখনো বলা হয়েছে স্বাধীনতার পক্ষ-বিপক্ষ, কখনো জঙ্গীবাদ, কখনো ধর্ম-মানে একেকবার একেকটা কার্ড সামনে আনা হয়েছে জাতিকে বিভাজিত করতে। সেই জায়গাটাতে আমরা মনে করি জাতিকে ঐক্যবদ্ধভাবে আনবার জন্য এই রেইনবো নেশনের পরিকল্পনা।
বিএনপি রেইনবো নেশন কি বাস্তবায়ন করতে পারবে?
বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে রেইনবো নেশন বা ‘রংধনু জাতি’ একটি নতুন ধারণা। বিএনপি ক্ষমতায় গেলে দেশকে বিভিন্ন সম্প্রদায় ও জাতিগোষ্ঠীর মানুষের জন্য অন্তর্ভুক্তিমূলক, সমানাধিকারভিত্তিক সমাজে পরিণত করার ঘোষণা দিয়েছে। তবে বাংলাদেশের বাস্তবতায় বাস্তবায়ন সহজ হবে না ধরে নেয়া যায়।
বাংলাদেশে দীর্ঘ সময় ধরে রাজনৈতিক অস্থিরতা, পারস্পরিক অবিশ্বাস এবং সামাজিক বিভাজন রেইনবো নেশনের বাস্তবায়নকে চ্যালেঞ্জের মুখে দাঁড় করাচ্ছে। বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধ, ধর্ম, ভাষা ও আদর্শের ভিত্তিতে নানা বিভাজন দেশের রাজনৈতিক-সামাজিক বিন্যাসকে জটিল করেছে।
বিএনপি চাচ্ছে সব সম্প্রদায়, ভাষা ও ধর্মের মানুষ সমানভাবে সবকিছুতে অংশগ্রহণ করবে। তবে এটি বাস্তবায়নের জন্য বিএনপি ক্ষমতায় গেলে প্রয়োজন হবে সরকারের স্বচ্ছতা, রাজনৈতিক সহনশীলতা, নাগরিক সমতার নিশ্চয়তা এবং সমাজে পারস্পরিক আস্থা গঠন। এসব ছাড়া রেইনবো নেশন তত্ত্ব কেবল দার্শনিক বা নীতিগত ঘোষণা হিসেবে থাকতেই পারে।
অর্থাৎ, বাংলাদেশের বাস্তবতায় রেইনবো নেশন বাস্তবায়ন সম্ভাবনা রাখলেও তার পথে রয়েছে নানামুখী সামাজিক ও রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ। বিএনপির জন্য এটি হবে বড় ধরনের পরীক্ষার বিষয়।