Image description

ঘটনাটি একেবারেই অরাজনৈতিক। মফস্বলের এক শহরের স্থানীয় দুই দোকনদারের মধ্যেকার ব্যবসায়িক দ্বন্দ্ব; যা ছোট আকারের মারামারিতে রূপ নেয় এবং সেটা মিটমাটও হয়ে যায় স্থানীয়ভাবে। কিন্তু সেই ঘটনার ভিডিও যখন অনলাইনে এলো, তখন সেটি বাংলাদেশের দুটি বড় রাজনৈতিক দলের কর্মীদের মধ্যে একটি ‘তথ্যযদ্ধের’ উপলক্ষ্য হিসেবে আবির্ভূত হলো। অবশ্যই দুইপক্ষই একে অন্যের বিরুদ্ধে ভিডিওকে ব্যবহার করে ভুয়া তথ্য ছড়াচ্ছেন।

একই ভিডিও দুটি দলের অনলাইন এক্টিভিস্টরা যখন সম্পূর্ণ বিপরীত দাবিতে একে অন্যের বিপক্ষে পোস্ট করছেন, তখন দ্য ডিসেন্ট মূল ঘটনা জানতে সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলেছে এবং তাতেই উঠে এসেছে প্রকৃত ঘটনা।

জামায়াত-বিএনপির এক্টিভিস্টদের ভুয়া তথ্যযুদ্ধ

গত ২২ অক্টোবর MD Nuruddin নামে এক সৌদি প্রবাসীর ফেসবুক একাউন্ট থেকে একটি ভিডিও পোস্ট করা হয়। যার ক্যাপশনে লেখা হয়েছে, “নরসিংদীতে বিএনপি'র এক নেতার দোকানে কিছু বোনেরা বোরকা কিনতে গিয়েছিলেন। ওই নেতা বোরকার দাম বলেছেন ৩,২০০ টাকা। কাস্টমার মহিলারা দাম বলেছিলেন ১,৩০০ টাকা। এতে ওই নেতা রেগে গিয়ে বলেন,ওরা জামায়াতে ইসলামী’র মহিলা কর্মী,বলে তাদের উপর হামলা শুরু করে দেন।”

নুরুদ্দিনের প্রোফাইল ঘেঁটে দেখা যায় তিনি নিয়মিত জামায়াতে ইসলামীর পক্ষে অনলাইনে এক্টিভিজম করেন। তার পোস্ট করা ভিডিওটি ৪২ হাজার বারের বেশি শেয়ার হয়েছে। এবং ৬২ লক্ষ এর বেশিবার সেটি দেখা হয়েছে।

ভিডিওতে দেখা যায়, ছোট একটি কাপড়ের দোকানে কয়েকজন বোরকাপরা নারী দাঁড়িয়ে আছেন, তখন এক ব্যক্তি লাঠি দিয়ে দোকানের ভিতরে আক্রমণ করেন।

নুরুদ্দিনের পোস্টের পর জামায়াতপন্থী অথবা বিএনপিবিরোধী বিভিন্ন পেইজ ও প্রোফাইল থেকে ভিডিওটি নতুন করে পোস্ট করা হয় এবং একই ক্যাপশন দেয়া হয়।

এরকম কয়েকটি পোস্ট দেখুন এখানে ও এখানে

এরপর ভিডিওটি বিএনপিপন্থী নানান পেইজ এবং প্রোফাইল থেকেও পোস্ট করা শুরু হয়। এসব পোস্টে ভিডিওটিকে ব্যবহার করা হয় জামায়াতের বিরুদ্ধে প্রচারণার উপলক্ষ্য হিসেবে।

বিএনপিপন্থী ফেসবুক পেইজ Chemistry of Politics- এ সিসিটিভি ফুটেজটি পোস্ট করে ক্যাপশন দেয়া হয়, “নরসিংদীতে জামায়াতের এক নেতার দোকানে কিছু বোনেরা বোরকা কিনতে গিয়েছিলেন। ওই নেতা বোরকার দাম বলেছেন ৩,২০০ টাকা। কাস্টমার মহিলারা দাম বলেছিলেন ১,৩০০ টাকা। এতে ওই নেতা রেগে গিয়ে বলেন,ওরা বিএনপির মহিলা দলের কর্মী। এরপর তাদের উপর হামলা শুরু করে দেন।”

সূত্র হিসেবে উল্লেখ করা হয়, “স্থানীয় প্রতিনিধি”। ভিডিওটি লক্ষাধিকবার ভিউ হয়েছে এই পোস্টে।

একই ক্যাপশনে বিএনপিপন্থী আরও বেশ কিছু পেইজ ও প্রোফাইল থেকেও ভিডিওটি পোস্ট করা হয়। তেমন কিছু লিংক পাওয়া যাবে এখানে ও এখানে

দুই পক্ষের এক্টিভিস্টদের পোস্ট- দুইপক্ষকে দায়ী করে

দুই পক্ষের এক্টিভিস্টদের পোস্ট- দুইপক্ষকে দায়ী করে | ফেসবুক

মূল ঘটনা অরাজনৈতিক

দ্য ডিসেন্ট যোগাযোগ করে মূল ঘটনা সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন ব্যক্তির সাথে। এতে জানা যায় ঘটনাটির সাথে বিএনপি-জামায়াতের রাজনীতির কোন সংশ্লিষ্টতা নেই। যেভাবে হামলার ঘটনাস্থল যে দোকান; সেটির মালিককে কেউ ‘জামায়াত নেতা’ এবং কেউ ‘বিএনপি নেতা’ বলে অনলাইনে দাবি করেছেন, বাস্তবে ওই দোকান মালিক কোন দলেরই নেতা নন।

নরসিংদী শহরের যে দোকানে হামলা হয়েছে সেটির নাম ‘হিজাব হ্যাভেন’। এটির মালিকের নাম খাদিজা আক্তার। ভিডিওতে দৃশ্যমান হামলাকারী ব্যক্তিটি হলেন সোহাগ হোসেন বাবু; তিনি পাশের দোকান তানহা ফ্যাশন’র মালিক।

গত ১৯ অক্টোবর দুপুর ১ টায় সাথে খাদিজা আক্তার ও তার দোকানের কর্মচারীদের সাথে তর্কাতর্কির এক পর্যায়ে বাবু লাঠি হাতে আক্রমণ করেন খাদিজা এবং তার সেলসম্যানের উপর।

খাদিজা আক্তার দ্য ডিসেন্ট-কে বলেন, “এই ঘটনার সাথে কোন রাজনৈতিক যোগসূত্র নাই। আমার দোকানে কাস্টমার বেশি থাকে সবসময়, যেটা উনারা সহ্য করতে পারে না। এর আগে বহুবার মার্কেট মালিকের কাছে অভিযোগ দিয়েছে যে, আমাকে যাতে এখান থেকে উঠানো হয়। আগের দিন সামান্য বিষয় নিয়ে ওইদিন আমার সেলসম্যানের সাথে তর্কাতর্কির এক পর্যায়ে আক্রমণ করে। আমাকে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করে।”

খাদিজা বলেন, “আমার দোকানে ৭-৮ জন কাস্টমার ছিলো। আমার দুইটা দোকান অন্য দোকান থেকে আমার সেলসম্যানকে ডেকে আনি। ছোট গলির মধ্যে দোকান তো, গলিতে বাচ্চারা খেলছিলো। আমার সেলসম্যান হাসি মুখে বলছে, বাচ্চারা একটু সরে খেলো। এটা শুনে ওরা তেড়ে আসে আর বলে তুই হাসলি কেনো। আমাকে আর আমার সেলসম্যানকে গালিগালাজ করে মারতে আসে।”

তানহা ফ্যাশনের মালিক সোহাগ হোসেন বাবুর কাছে এই ঘটনা সস্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, “এটার সাথে কোন রাজনৈতিক সম্পর্ক নেই। এটা আমাদের ব্যবসায়িক ঝামেলার কারণে হয়েছে। আমি ইতোমধ্যে নরসিংদীর অপরাধ কন্ঠকে সব জানিয়েছি, ওখান থেকে দেখে নিন।”

সোহাগের বক্তব্য জানা যাবে এই ভিডিওতে

বিষয়টি নিশ্চিত হওয়ার জন্য নরসিংদী বাজার বনিক সমিতির সভাপতি এবং সাবেক বিএনপি সভাপতি বাবুল সরকার এর সাথে কথা বললে তিনি জানান, “এই ঘটনার সাথে কোন রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা নেই। সোহাগ হোসেন বাবু এর আগেও ৭-৮ বার ঝামেলা করেছে খাদিজার সাথে। আমার কাছে দুইপক্ষই আসছিলো, আমি তাদের পিটিশন দিতে বলছি। এখানে কোন দলবল নেই, সব মিথ্যা কথা।”

খাদিজা আক্তারের সাথে জামায়াতের সংশ্লিষ্টতা নিশ্চিত হওয়ার জন্য নরসিংদী জামায়াতের সেক্রেটারি আমজাদ হোসাইন এর সাথে কথা হয়। তিনি বলেন, “আমি ঘটনাটি সম্পর্কে অবগত এবং জড়িতরা কেউই জামায়াতের নেতা বা কর্মী নয়। অনলাইনে মিথ্যা প্রোপাগান্ডা ছড়ানো হচ্ছে জামায়াতের নামে।”

স্থানীয় মহিলা জামায়েতের দায়িত্বশীল নাসরিনও জানান, তারা খোঁজ নিয়ে দেখেছেন খাদিজা তাদের সংগঠনের কেউ নন।

অর্থাৎ, স্থানীয় বিএনপি-জামায়াতের নেতারা এবং ঘটনায় আক্রমণকারী এবং ভিকটিম সবাই জানালেন যে, তাদের হাঙ্গামার সাথে বিএনপি-জামায়াতের রাজনীতির কোন সংশ্লিষ্টতা নেই। কিন্তু দুটি দলের অনলাইন এক্টিভিস্টরা অসত্যভাবে ভিডিওটিকে উপলক্ষ্য করে একে ওপরের বিরুদ্ধে তথ্যযুদ্ধে শামিল হলেন।