Image description
 

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) বৈঠক রাজনৈতিক অঙ্গনে নতুন আলোচনার জন্ম দিয়েছে। তিন দলই আলাদাভাবে সরকারের কিছু উপদেষ্টাদের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। আবার কেউ কেউ অপসারণের দাবিও তুলেছে।

কিন্তু এই তিন দলের অভিযোগের ধরন এবং অবস্থান বিশ্লেষণ করলে স্পষ্ট হয়—তারা শুধু সরকারের ওপর নয়, পরস্পরের বিরুদ্ধেও চাপ সৃষ্টির কৌশল নিয়েছে। নির্বাচনের আগে প্রশাসনিক প্রভাবের প্রশ্নে এক অঘোষিত প্রতিযোগিতা এখানে দৃশ্যমান।

গত মঙ্গলবার বিএনপি এবং বুধবার জামায়াত ও এনসিপি প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে আলাদাভাবে সাক্ষাৎ করেছে। তিন দলই কিছু বিষয়ে নিজেদের বিপরীতমুখী অবস্থানে অনড় আছে। বিশেষ করে জুলাই জাতীয় সনদের আইনি ভিত্তি, গণভোটের সময় ও পথ-পদ্ধতি নিয়ে তারা এখনো একমত হতে পারেনি।

দলগুলোর এই পরস্পরবিরোধী অবস্থানের কারণে নতুন কোনো সংকট তৈরি হয় কি না, সেই আশঙ্কা নিয়েও রাজনৈতিক অঙ্গনে নানা আলোচনা রয়েছে। জুলাই সনদের বাস্তবায়নের পদ্ধতি এখনো ঠিক হয়নি। দলগুলোও এই ক্ষেত্রে নিজেদের অবস্থান থেকে সরতে রাজি নয়।

তবে আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল প্রথম আলোকে বলেন, ‘সরকার এখন জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সুপারিশের অপেক্ষায় আছে। জুলাই সনদের বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া নিয়ে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন যে সুপারিশগুলো দেবে, সেগুলো নিয়ে আমরা বসব। উপদেষ্টা পরিষদে আলোচনার পর এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত হবে। এরপর সরকারের পক্ষ থেকে সিদ্ধান্ত জানানো হবে।’

দলগুলোর এই পরস্পরবিরোধী অবস্থানের কারণে নতুন কোনো সংকট তৈরি হয় কি না, সেই আশঙ্কা নিয়েও রাজনৈতিক অঙ্গনে নানা আলোচনা রয়েছে। জুলাই সনদের বাস্তবায়নের পদ্ধতি এখনো ঠিক হয়নি। দলগুলোও এই ক্ষেত্রে নিজেদের অবস্থান থেকে সরতে রাজি নয়।

তিন দলের পাল্টাপাল্টি

বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের নেতৃত্বে বিএনপির তিন সদস্যের প্রতিনিধিদল গত মঙ্গলবার রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে। দলটি অন্তর্বর্তী সরকারকে এখন থেকে নিরপেক্ষ ‘তত্ত্বাবধায়ক’ সরকারের ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়ার পরামর্শ দিয়েছে। এর পাশাপাশি উপদেষ্টা পরিষদে থাকা ‘দলঘনিষ্ঠদের’ বিষয়ে পদক্ষেপও নিতে বলেছে তারা।

এই ক্ষেত্রে তারা নির্দিষ্ট করে একজন উপদেষ্টা এবং প্রধান উপদেষ্টার একজন বিশেষ সহকারীর নাম বলেছে বলে দলীয় সূত্র থেকে জানা গেছে। দলটির নেতাদের অনেকে মনে করেন, ওই উপদেষ্টা জামায়াতের স্বার্থ দেখেন। সর্বশেষ জনপ্রশাসন সচিব পদে নিয়োগ নিয়ে বিএনপি বেশি অসন্তুষ্ট বলে জানা গেছে।

বিএনপি অন্তর্বর্তী সরকারকে এখন থেকে নিরপেক্ষ ‘তত্ত্বাবধায়ক’ সরকারের ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়ার পরামর্শ দিয়েছে। এর পাশাপাশি উপদেষ্টা পরিষদে থাকা ‘দলঘনিষ্ঠদের’ বিষয়ে পদক্ষেপও নিতে বলেছে তারা।

এ ছাড়া বিচার বিভাগ, সচিবালয় এবং প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে রদবদলসহ আরও কিছু বিষয়ে বিএনপির নেতারা প্রধান উপদেষ্টাকে পদক্ষেপ নিতে অনুরোধ জানান।
পরদিন বুধবার বিকেলে এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলামের নেতৃত্বে দলটির চার সদস্যের প্রতিনিধিদল প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে। নির্বাচনের আগে উপদেষ্টা পরিষদের পুনর্গঠন করার প্রয়োজন হলে সেটা যেন ন্যায্য ও যৌক্তিকভাবে করা হয়, সেটি প্রধান উপদেষ্টাকে বলেছেন এনসিপির নেতারা। এ ছাড়া কাউকে বাদ দেওয়ার প্রয়োজন হলে শুধু ছাত্র উপদেষ্টা নন, ‘বিভিন্ন দল ও গোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্বকারী’ যেসব উপদেষ্টা সরকারে আছেন, তাঁদেরও যেন বাদ দেওয়া হয়, সেটিও বলেছে এনসিপি।

জনপ্রশাসনে যোগ্যতার ভিত্তিতে নিরপেক্ষ বদলি-পদায়ন নিয়েও বৈঠকে কথা বলেছে এনসিপি। বৈঠকের পর দলটির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমরা বিভিন্ন জায়গায় দেখতে পাচ্ছি ও শুনতে পাচ্ছি যে প্রশাসনে বিভিন্ন ভাগ-বাঁটোয়ারা হচ্ছে। বড় রাজনৈতিক দল হিসেবে যারা পরিচিত, তারা নিজেদের মধ্যে প্রশাসন, এসপি-ডিসি ভাগ-বাঁটোয়ারা করছে। নির্বাচনের জন্য তারা সেই তালিকা সরকারকে দিচ্ছে। উপদেষ্টা পরিষদের ভেতর থেকেও সেই দলগুলোকে সহায়তা করছে। এভাবে চললে সরকারের নিরপেক্ষতা প্রশ্নবিদ্ধ হবে।’

নির্বাচনের আগে উপদেষ্টা পরিষদের পুনর্গঠন করার প্রয়োজন হলে সেটা যেন ন্যায্য ও যৌক্তিকভাবে করা হয়, সেটি প্রধান উপদেষ্টাকে বলেছেন এনসিপির নেতারা। এ ছাড়া কাউকে বাদ দেওয়ার প্রয়োজন হলে শুধু ছাত্র উপদেষ্টা নন, ‘বিভিন্ন দল ও গোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্বকারী’ যেসব উপদেষ্টা সরকারে আছেন, তাঁদেরও যেন বাদ দেওয়া হয়, সেটিও বলেছে এনসিপি।

একই দিন সন্ধ্যায় যমুনায় প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকে কয়েকজন উপদেষ্টাকে নিয়ে আপত্তি জানায় জামায়াত। জামায়াতের অভিযোগ, ওই উপদেষ্টারা প্রধান উপদেষ্টাকে বিভ্রান্ত করেন। তবে কাদের কাদের নিয়ে এই আপত্তি, তাঁদের নাম প্রকাশ করেনি দলটি।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, কয়েকজন উপদেষ্টার প্রতি জামায়াতের অসন্তুষ্টি আছে। এই উপদেষ্টারা বিএনপির স্বার্থ বেশি দেখেন বলে জামায়াত বিশ্বাস করে। এ ছাড়া পুলিশ, জনপ্রশাসনসহ সরকারের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকা বেশ কিছু কর্মকর্তা বিএনপির প্রতি অনুগত বলে মনে করে জামায়াত। এমন কর্মকর্তাদের তালিকাও করেছে দলটি।
বুধবার ওই বৈঠকের পর জামায়াতের নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মুহাম্মদ তাহের সাংবাদিকদের বলেন, বর্তমানে নির্বাচন কমিশন, সচিবালয় ও পুলিশ প্রশাসনে ৭০-৮০ শতাংশ কর্মকর্তা একটি দলের আনুগত্য করছেন।

রাজনৈতিক দলগুলোর পাল্টাপাল্টি অবস্থান নিয়ে সরকারের ভেতরে কী আলোচনা বা সরকার কী ভাবছে; সে বিষয়ে নিশ্চিত করে কিছু জানা যায়নি। তবে বৈঠকে দলগুলোকে প্রধান উপদেষ্টা তাঁর ওপর আস্থা রাখতে বলেছেন।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, কয়েকজন উপদেষ্টার প্রতি জামায়াতের অসন্তুষ্টি আছে। এই উপদেষ্টারা বিএনপির স্বার্থ বেশি দেখেন বলে জামায়াত বিশ্বাস করে। এ ছাড়া পুলিশ, জনপ্রশাসনসহ সরকারের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকা বেশ কিছু কর্মকর্তা বিএনপির প্রতি অনুগত বলে মনে করে জামায়াত। এমন কর্মকর্তাদের তালিকাও করেছে দলটি।

জটিলতা কাটেনি

জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি নিয়ে বিএনপি, জামায়াত, এনসিপিসহ দলগুলোর মধ্যে মতপার্থক্য এখনো কাটেনি।

গতকালও বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে বলেন, ‘দুটি রাজনৈতিক দল ছাড়া বাকি সবাই গণভোটের প্রস্তাবে একমত হয়। আমি দুটি রাজনৈতিক দলের নাম উল্লেখ করছি না। তবে দুটি দলের একটি জুলাই সনদ স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে গিয়েছে। অপর একটি রাজনৈতিক দল এখন জুলাই জাতীয় সনদে স্বাক্ষর করার সুযোগ খুঁজছে।’

এই ক্ষেত্রে সালাহউদ্দিন আহমদ এনসিপিকেই ইঙ্গিত করছেন। অবশ্য প্রধান উপদেষ্টা সর্বশেষ গত বুধবারের বৈঠকেও সনদে সই করার জন্য এনসিপির প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।

দুটি রাজনৈতিক দল ছাড়া বাকি সবাই গণভোটের প্রস্তাবে একমত হয়। আমি দুটি রাজনৈতিক দলের নাম উল্লেখ করছি না। তবে দুটি দলের একটি জুলাই সনদ স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে গিয়েছে। অপর একটি রাজনৈতিক দল এখন জুলাই জাতীয় সনদে স্বাক্ষর করার সুযোগ খুঁজছে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ

এনসিপির সদস্যসচিব আখতার হোসেন গতকাল ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, বড় একটি দলের প্রভাবে সরকার আইনি ভিত্তি ছাড়াই জুলাই সনদ ঘোষণা করেছে। আইনি ভিত্তি ও পথরেখা ছাড়া এনসিপি এতে একমত নয়। সনদের বাস্তবায়ন কোনো ভাগ-বাঁটোয়ারার বিষয় নয়; একবার স্বাক্ষর হয়ে গেলে নব্বইয়ের মতো প্রতারণা হতে পারে।
রাজনৈতিক দলগুলোর পরস্পরবিরোধী অবস্থানে যে জটিল পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে, তাতে শান্তিপূর্ণ পরিবেশে নির্বাচন আয়োজন নিয়ে শঙ্কা তৈরি হতে পারে বলে মনে করছেন অনেকে।

বড় একটি দলের প্রভাবে সরকার আইনি ভিত্তি ছাড়াই জুলাই সনদ ঘোষণা করেছে। আইনি ভিত্তি ও পথরেখা ছাড়া এনসিপি এতে একমত নয়। সনদের বাস্তবায়ন কোনো ভাগ-বাঁটোয়ারার বিষয় নয়; একবার স্বাক্ষর হয়ে গেলে নব্বইয়ের মতো প্রতারণা হতে পারে।
এনসিপির সদস্যসচিব আখতার হোসেন

লেখক ও গবেষক মহিউদ্দিন আহমদ প্রথম আলোকে বলেন, পাল্টাপাল্টি অবস্থানের মাধ্যমে দলগুলো সরকারের পাশাপাশি প্রতিপক্ষ দলের ওপরও চাপ তৈরি করতে চাইছে। সামনে যেহেতু নির্বাচন, সবাই সরকারের কাছ থেকে সুবিধা বা পৃষ্ঠপোষকতা নিতে চাইছে। এক দল মনে করছে তাদের চেয়ে আরেক দল বেশি পৃষ্ঠপোষকতা পাচ্ছে। সে জন্য তারা অভিযোগগুলো করছে। সরকার এসব বিষয় যথাযথভাবে বিবেচনায় না নিলে সংকট বাড়তে পারে।

পাল্টাপাল্টি অবস্থানের মাধ্যমে দলগুলো সরকারের পাশাপাশি প্রতিপক্ষ দলের ওপরও চাপ তৈরি করতে চাইছে।
লেখক ও গবেষক মহিউদ্দিন আহমদ