Image description

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) সাবেক মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপসের আশীর্বাদে ৮টি কাজে অন্তত ৫৭৭ কোটি টাকা লোপাট হয়েছে-এমন অভিযোগ সংশ্লিষ্টদের। তাদের মতে-কাজ না করে বিল পরিশোধ, যোগসাজশ করে প্রাক্কলিত দর বাড়ানো, পছন্দের ঠিকাদারকে কাজ দেওয়াসহ নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে এই মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিয়েছে একটি প্রভাবশালী সিন্ডিকেট। এ ব্যাপারে অনুসন্ধান শুরু করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।

আরও জানা গেছে, ইতোমধ্যেই আলোচ্য দুর্নীতির যাবতীয় তথ্য-উপাত্ত চেয়ে ডিএসসিসিকে চিঠি দিয়েছে দুদক। সেখানে বলা হয়েছে, উল্লিখিত কাজের সঙ্গে জড়িতরা বিভিন্ন অনিয়ম, দুর্নীতি, দরপত্র জালিয়াতি এবং সিন্ডিকেট করে শত শত কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে।

এদিকে ডিএসসিসিকে পাঠানো দুদকের চিঠি বিশ্লেষণ করে এবং দুদক সূত্রে জানা যায়, ওই সময় সংশ্লিষ্ট কাজে যারা দায়িত্বপ্রাপ্ত ছিলেন, তাদের ব্যাপারে অনুসন্ধান করা হচ্ছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন-ডিএসসিসির সাবেক অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী কাজী মো. বোরহান উদ্দিন (বর্তমানে সিলেট সিটি করপোরেশনে কর্মরত), তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী আনিছুর রহমান, তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মো. খায়রুল বাকের (সম্প্রতি রাজশাহী সিটি করপোরেশনে বদলি), নির্বাহী প্রকৌশলী মিথুন চন্দ্র শীল, স্থপতি সিরাজুল ইসলাম, নির্বাহী প্রকৌশলী মাহবুব আলম, নির্বাহী প্রকৌশলী সাইফুল ইসলাম। এর বাইরে সাবেক মেয়র তাপস, সংশ্লিষ্ট কাউন্সিলর, কর্মকর্তা-কর্মচারী ও ঠিকাদারদের বিষয়ে ব্যাপক অনুসন্ধান শুরু করেছে দুদক।

জানতে চাইলে ডিএসসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. জহিরুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, দুদকের তদন্ত কর্মকর্তারা বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত চাচ্ছেন। সব ধরনের তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করা হচ্ছে। সুশাসন প্রতিষ্ঠায় সরকারের এই কমিশন কাজ করে। যদি কোনো কর্মকর্তা, কর্মচারী বা অংশীজন অনিয়ম করে থাকে, তারা তা ভোগ করবেন। আর যারা কোনো অনিয়ম করেননি, তাদের চিন্তার কোনো কারণ নেই।

দুদকের উপপরিচালক (জনসংযোগ) মো. আকতারুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) বিভিন্ন অনিয়ম, দুর্নীতি এবং অব্যবস্থাসংক্রান্ত অনুসন্ধান চলমান। অনুসন্ধান কর্মকর্তা বিভিন্নভাবে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করছেন। ইতোমধ্যে ডিএসসিসির কাছে তথ্য-উপাত্ত বা নথিপত্র চাওয়া হয়েছে। প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্ত যাচাই-বাছাই শেষে অনুসন্ধান কর্মকর্তার প্রতিবেদনের আলোকে কমিশন পরবর্তী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান যুগান্তরকে বলেন, ডিএসসিসির যেসব বিষয়ে দুদক অনুসন্ধান শুরু করেছে-তা প্রভাবমুক্তভাবে খতিয়ে দেখতে হবে। সেখানে পদ, ব্যক্তি বা কারও সামাজিক অবস্থান বিবেচনা করলে চলবে না। তিনি আরও বলেন, দুর্নীতি নিরসন করতে হলে দুর্নীতিবাজদের শাস্তি হতে হবে। দুদকে সে কাজটি দায়িত্বশীলতার সঙ্গে করতে হবে। ডিএসসিসি যেসব বিষয়ে অনুসন্ধান শুরু করেছে, তার সুষ্ঠু তদন্ত শেষে দায়ীদের শাস্তি নিশ্চিত করা গেলে সেখানে দুর্নীতি কমবে। দুদককে এই কাজটি পেশাদারত্বের সঙ্গে করতে হবে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, ডিএসসিসির বিষয়ে দুদকের অগ্রাধিকার তদন্তে রয়েছে-শ্যামপুর, দনিয়া, মাতুয়াইল এবং সারুলিয়া এলাকার সড়ক অবকাঠামো প্রকল্প। এ প্রকল্পের ৭৩৬ কোটি টাকার কাজের মধ্যে ১৫৪ কোটি টাকা লোপাট হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন সংশ্লিষ্টরা। এ প্রকল্পে নিুমানের কাজ, প্রতারণা, জালিয়াতির ঘটনা ঘটেছে। এ বিষয়ে স্থানীয় সরকার বিভাগ থেকে তদন্তের জন্য গত বছর একটি কমিটি গঠন করা হয়। কিন্তু রহস্যজনক কারণে অদ্যাবধি সেই প্রতিবেদন আনুষ্ঠানিকভাবে জমা হয়নি। এ কাজের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের মধ্যে ছিলেন-ডিএসসিসির সাবেক অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী কাজী মো. বোরহান উদ্দিন ও ডিএসসিসির নির্বাহী প্রকৌশলী মিথুন চন্দ্র শীল।

আরও জানা যায়, ইউরোপ থেকে যন্ত্রপাতি এনে হাজারীবাগ জবাইখানা ও কাপ্তানবাজার জবাইখানার আধুনিকায়ন কাজে ৭৪ কোটি টাকা খরচ করা হয়। কিন্তু সেখানে ইউরোপের যন্ত্রপাতির পরিবর্তে চায়নার যন্ত্রপাতি লাগানো হয়েছে। কয়েক বছর ধরে ওই দুটি জবাইখানা অচল অবস্থায় পড়ে রয়েছে। এ কাজের দায়িত্বে ছিলেন-তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী আনিছুর রহমান, নির্বাহী প্রকৌশলী সাইফুল ইসলাম, নির্বাহী প্রকৌশলী মাহবুব আলম এবং ডিএসসিসির তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মো. খায়রুল বাকের।

দুদক সূত্রে জানা যায়, মাতুয়াইল ল্যান্ডফিলের সীমানা প্রাচীর নির্মাণে ৫ কোটি ১ লাখ টাকা কাজ না করে ভুয়া বিল পরিশোধ করা হয়েছে। আর যেটুকু সীমানা প্রাচীর নির্মাণ করা হয়েছিল তারও কিছু অংশ ভেঙে পড়ে। ঠিকাদারের কাছ থেকে ৫ কোটি ১ লাখ টাকা আদায় করার নির্দেশ দিলেও সেটা ডিএসসিসির তহবিলে জমা পড়েনি। এ কাজের দায়িত্বে ছিলেন-তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মো. খায়রুল বাকের ও সহকারী প্রকৌশলী নজরুল ইসলাম।

ডিএসসিসির মেন্দিপুর আল হেলাল ক্লাবসংলগ্ন খেলার মাঠের উন্নয়ন কাজে ১ কোটি ৭৪ লাখ টাকার দুর্নীতির ঘটনা ঘটে বলে নিজস্ব তদন্তে উঠে আসে। এতে দায়িত্বপ্রাপ্ত নির্বাহী প্রকৌশলী সাইফুল ইসলামকে চাকরি থেকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। সরকারি নিয়ম অনুযায়ী ওই টাকা ডিএসসিসির তহবিলে ফেরত আনার কথা। কিন্তু তা না করে উলটো ওই নির্বাহী প্রকৌশলীর সাময়িক বরখাস্তাদেশ প্রত্যাহার করা হয়। এ কাজের সঙ্গে আরও জড়িত ছিলেন ডিএসসিসির সাবেক অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী কাজী মো. বোরহান উদ্দিন।

ডিএসসিসির নতুন ১৮টি ওয়ার্ড এবং পুরো ডিএসসিসি এলাকার পরিকল্পিত উন্নয়নের লক্ষ্যে সমন্বিত মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এরই আলোকে দুটি পরামর্শক প্রতিষ্ঠান যৌথভাবে মহাপরিকল্পনার কাজ পান। ২০২০ সালের জুনে ওই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ডিএসসিসির চুক্তি হয়। ওই প্রতিষ্ঠানের প্রতিবেদন অনুমোদন হওয়ার আগেই পরামর্শক প্রতিষ্ঠানকে ২ কোটি ৫০ লাখ টাকা পরিশোধ করেন দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা স্থপতি সিরাজুল ইসলাম। সবশেষ ডিএসসিসির কারিগরি কমিটি ওই পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের দেওয়া মহাপরিকল্পনা প্রতিবেদন গ্রহণ করেনি। নিয়ম অনুযায়ী ওই প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে ওই টাকা ফেরত নেওয়ার কথা থাকলেও তা নেওয়া হয়নি। পাশাপাশি দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তার বিরুদ্ধেও কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। এতে ডিএসসিসির এই আড়াই কোটি টাকা গচ্চা গেছে।

তথ্যানুসন্ধানে আরও জানা যায়, পদ্মা সেতুর রেল সংযোগ সংক্রান্ত কাজে ডিএসসিসি রেলওয়ের কাছ থেকে ৫১ কোটি ৪ লাখ টাকা নিয়েছে। প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী কোনো কাজ না করে তা লোপাট করে ফেলেছে। পরে এ সংক্রান্ত কাগজপত্র চাইলেও তা সরবরাহ করতে পারেনি। এ কারণে পরে রেলওয়ে আরও ২২ কোটি ৯৩ লাখ টাকা দেওয়ার শর্ত থাকলেও তা দেয়নি। ডিএসসিসি ও রেলওয়ের ওই কাজের ব্যয়সংক্রান্ত অডিট আপত্তি এখনো নিষ্পত্তি হয়নি। এ কাজের দায়িত্বে ছিলেন তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মো. খায়রুল বাকের।

শাহবাগে ডিএসসিসির শিশুপার্কের উন্নয়ন ও রাইডস ক্রয়ের জন্য ৪৫০ কোটি টাকা প্রাক্কলন করেছে ডিএসসিসি। অথচ কাজটি ২০০ কোটি টাকায় করা সম্ভব হতো বলে ডিএসসিসির একাধিক প্রকৌশলীর সভায় মূল্যায়ন করা হয়েছে। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ও তৎকালীন মেয়র, কাউন্সিলর ও প্রকৌশলীরা যোগসাজশ করে এই অতিরিক্ত প্রাক্কলন করেছে। এই শিশুপার্কের কাজ আগে আঁতাত করা প্রতিষ্ঠানকেই দেওয়া হয়েছে। শাহবাগ শিশুপার্কের নাম শুরু থেকে শহীদ জিয়া শিশুপার্ক থাকলেও মেয়র তাপসের সময় তা পরিবর্তন করা হয়। গণ-অভ্যুত্থানের পর তা আবার আগের নামে ফিরিয়ে নেওয়া হয়েছে। এ কাজের দায়িত্বে ছিলেন ডিএসসিসির তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী আনিছুর রহমান ও নির্বাহী প্রকৌশলী মাহবুব আলম।

ডিএসসিসি এলাকার গুরুত্বপূর্ণ সংযোগ সড়কে স্বয়ংক্রিয় ট্রাফিক সিগন্যাল ও কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ কক্ষ স্থাপনের কাজে বিশ্বব্যাংকের বাজেট থেকে ৩৮ কোটি টাকা খরচ করে। বাস্তবে কোনো কাজ করা হয়নি। নগরভবনের কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ কক্ষের জায়গায় আনসাররা থাকছেন। এ কাজের দায়িত্বে ছিলেন স্থপতি সিরাজুল ইসলাম।

উপরোক্ত বিষয়গুলো ছাড়াও দুদকে ডিএসসিসির পরিবহণ খাত, বিধিবহির্ভূতভাবে জ্বালানি ব্যবহার, প্রাধিকার বহির্ভূতভাবে গাড়ি ব্যবহার করা, ইমপ্রুভমেন্ট অব ইনার সার্কুলার রিং রোড, নিয়োগ এবং জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘন করে পদোন্নতিসহ বহুবিধ ইস্যুতে তদন্ত অব্যাহত রেখেছে। এসব বিষয়ও দুদকের অনুসন্ধানে স্থান পাচ্ছে।

উল্লিখিত সব অনিয়ম ও দুর্নীতি নিজস্ব তদন্তে উঠে এলেও তৎকালীন মেয়র ফজলে নূর তাপস রহস্যজনক কারণে কোনো ব্যবস্থা নেননি। প্রতিটি ঘটনায় তাপসের ‘সবুজ সংকেত’ ছিল-এমন অভিযোগ ডিএসসিসির সংশ্লিষ্টদের। তাদের মতে-দুদকের অনুসন্ধান নির্মোহভাবে করা হলেই প্রকৃত দোষীদের নাম খুব সহজেই বেরিয়ে আসবে।

নগর পরিকল্পনাবিদ এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক ড. আকতার মাহমুদ যুগান্তরকে বলেন, প্রায় খবরের মাধ্যমে জানতে পারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে দুদক অভিযান পরিচালনা করছে। বিভিন্ন প্রকল্প নিয়ে অনুসন্ধান করছে। কিন্তু দিনশেষে সেই হারে মামলা বা পদক্ষেপ দেখা যায় না। দুদকের দায়িত্ব নিরপেক্ষতার সঙ্গে পেশাদারত্ব পালন করা। ডিএসসিসিতে এখন যেসব বিষয়ে তদন্ত কাজ শুরু করা হয়েছে, তার সুষ্ঠু তদন্ত করে দোষীদের চিহ্নিত করার পাশাপাশি দুর্নীতি হ্রাসকরণে কী পদক্ষেপ নিতে পারে সে সুপারিশও করা।