
দেশের শীর্ষ আলেম রাজনীতিবিদদের অন্যতম মাওলানা মামুনুল হক। এই সময়ে জাতীয় রাজনীতিতেও তিনি বেশ আলোচিত। বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের আমির। হেফাজতে ইসলামের যুগ্ম মহাসচিব। শাইখুল হাদিস, সংগঠক, বক্তা, লেখক, সম্পাদক, গবেষকসহ আরও নানা পরিচয়ে তিনি পরিচিত। তাঁর কর্মের ময়দানও অনেক বিস্তৃত। সম্প্রতি তিনি আওয়ার ইসলামের মুখোমুখি হয়েছেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন পোর্টালটির সম্পাদক: হুমায়ুন আইয়ুব। দুই পর্বের সাক্ষাৎকারের আজ প্রথম পর্ব।
আওয়ার ইসলাম: আপনি সম্প্রতি বলেছেন, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস কোনো জোটে যোগদান করেনি। কিন্তু আপনারা বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী এবং ইসলামী আন্দোলন যে যুগপৎ আন্দোলন করছে সেখানে অংশগ্রহণ করেছেন, কর্মসূচি দিয়েছেন। যদি জোট না হয়ে থাকে তাহলে আপনারা যুগপৎ আন্দোলন আন্দোলন কেন করলেন?
মাওলানা মামুনুল হক: এখানে আমরা যেটা বলেছ, জোটে যাওয়া না যাওয়াটা হলো নির্বাচনকেন্দ্রিক জোট। এখনো পরিষ্কার করছি যে, নির্বাচনকেন্দ্রিক কোনো এলায়েন্স বা কোনো জোটভুক্ত হইনি এবং বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস এখনো এই বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেনি। বাকি এখানে জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি এবং জুলাই সনদ বাস্তবায়নসহ আরও বেশ কিছু দাবিসহ মোট ৫ দফা দাবি, যেগুলো আমরা মনে করি সুন্দর ও গ্রহণযোগ্য, যে দাবি পূরণ হওয়া অপরিহার্য। বিশেষ করে জুলাই বিপ্লবকে অন্তত এস্টাবলিশ করার জন্য। জুলাই সনদের বাস্তবায়ন এবং আইনি ভিত্তি ছাড়া এর বিকল্প কিছু নেই। তো এটাকে কেন্দ্র করে মূলত যুগপৎ আন্দোলনের দিকে যাওয়া। কারণ এককভাবে এই দাবি আদায় করার পরিবেশ ছিল না। এজন্যই আমরা মূলত এই দাবি আদায়ের ক্ষেত্রে যুগপৎ আন্দোলনে গিয়েছি। নির্বাচনি কোনো জোট এখনো গঠিত হয়নি।
আওয়ার ইসলাম: আপনি নির্বাচন করবেন কি না? করলে কোন আসন থেকে করবেন?
মাওলানা মামুনুল হক: নির্বাচন করব কি না এটা এখনো আমি চূড়ান্ত করিনি। ব্যক্তিগতভাবে আমি নির্বাচন করতে খুব একটা উৎসাহিত না। তবে, শুরু থেকেই বলছি যেটা, যদি জাতীয় প্রয়োজন দেখা দেয়, দলের বিশেষ প্রয়োজন দেখা দেয় যে, আমি নির্বাচন করলে হয়তো দলের জন্য সুবিধা হবে; অথবা কোনো অ্যালায়েন্স যদি হয়, অ্যালায়েন্সের প্রয়োজনে আমার নির্বাচন করাটা প্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ে; তখন হয়তো আমি নির্বাচন করতে পারি। এই ক্ষেত্রে আমি দ্বিমত করব না, এইটা হলো নির্বাচন করার ক্ষেত্রে আমার ব্যক্তিগত অবস্থা। নির্বাচন কোথায় থেকে করব এক্ষেত্রে একাধিক জায়গার সম্ভাবনা। প্রথমত, আমার বর্তমান যে কর্মস্থল ঢাকার মোহাম্মদপুর থেকেই করাটা বেশি গুরুত্ব দিচ্ছি। আর এর বাইরেও আরও দুইটা আসনে করার চিন্তাভাবনা আছে। একটা হলো আমার জন্মস্থান লালবাগ। আরেকটা হলো আমার নানার বাড়ি, যেখানে আমার পারিবারিক কিছু ঐতিহ্য আছে, রাজনৈতিক ঐতিহ্য, আমার বাবার সেখানে অবদান ও কার্যক্রম আছে, আমার নানার যেখানে রাজনৈতিক অতীত একটা ইতিহাস আছে, বাগেরহাট-১ আসন।
আওয়ার ইসলাম: এবারের নির্বাচনে ইসলামপন্থীদের মধ্যে একটা আগ্রহ-উদ্দীপনা দেখা যাচ্ছে। এই সম্ভাবনাটাকে কাজে লাগাতে আপনার বিশেষ কোনো চিন্তা বা পরিকল্পনা আছে?
মাওলানা মামুনুল হক: এটা অবশ্যই, মানুষের যে ইসলামপন্থীদের নিয়ে একটা ভিন্ন আগ্রহ ও স্বপ্ন, এটাই মূলত আমাদেরকে দায়িত্ববোধে বিশেষভাবে অনুপ্রাণিত করছে। আদৌ সম্ভাবনা আছে কি না সেটা তো আসলে নির্বাচনের ফলাফলের পরেই বোঝা যাবে। কিন্তু মানুষ যে ইসলামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলোর ব্যাপারে একটা প্রত্যাশা করছে- তারা যেন ঐক্যবদ্ধভাবে নির্বাচনি ময়দানে অবতীর্ণ হয়, সেই চাহিদাটা আমাদের ওপর একটা বাড়তি প্রেশার হিসেবে কাজ করছে।
আওয়ার ইসলাম: আমি দুইটা বিষয় এখন জানতে চাইবো। প্রথম কথা হলো, জুলাইয়ের যে আকাঙ্ক্ষা, গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী মানুষ জুলাই নিয়ে যে স্বপ্ন দেখেছিল, এটা কতটুকু বাস্তবায়ন হয়েছে। আর বর্তমান যে সরকার আছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার, এই সরকারকে আপনি ১০০ তে কত মার্ক দেবেন? সফলতা এবং ব্যর্থতার বিচারে?
মাওলানা মামুনুল হক: জুলাই পরবর্তী মানুষের যে আকাঙ্ক্ষা ছিল, মানুষের যে অভিপ্রায় ছিল, সেটা বাস্তবায়ন করার অনেক সুযোগ ছিল। সে ক্ষেত্রে আমি সরকারকে এক কথায় ব্যর্থই মনে করি। গণমানুষের যে আকাঙ্ক্ষা এবং তাদের সামনে যে সুযোগ ছিল, সেই সুযোগের সৎব্যবহার করতে অনেকটাই তারা ব্যর্থ হয়েছে। জুলাই বিপ্লব থেকে সাধারণ মানুষের মধ্যে ইতিবাচক একটা পরিবর্তন এসেছে। এটা হলো, এখন যে মেধাবী তরুণরা রাজনীতিবিমুখ হয়ে পড়েছিল, জুলাই বিপ্লবের মাধ্যমে অনেকে মনে করে যে, গণঅভ্যুত্থান, গণবিপ্লবের মাধ্যমে ভালো কিছু করা যেতে পারে। সেই জায়গায়টা থেকে মানুষের মধ্যে একটা আস্থা, এটা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বাকি জুলাই বিপ্লবের যে আকাঙ্ক্ষা ছিল সেটা কিছুটা পূরণ হবে যদি জুলাই সনদের আইনি বাস্তবায়ন হয়। এটার সম্ভাবনা জোরালো বলে আমরা মনে করছি। যেহেতু সব দল গণভোটের মাধ্যমে জুলাই সনদ কার্যকরের অনেকটা ইতিবাচক মনোভাব দেখিয়েছে। সে ক্ষেত্রে আমরা মনে করি, জুলাই সনদটা কার্যকর হলে হয়তো আগামী দিনে বাংলাদেশের রাজনৈতিক বন্দোবস্তের কিছুটা পরিবর্তন আসতেই পারে। যদি পরিবর্তন আসে তাহলে আমরা মনে করব যে জুলাই বিপ্লবের কিছুটা সার্থকতা হাসিল হলেছে।
আওয়ার ইসলাম: সফলতা এবং ব্যর্থতায় এই সরকারকে একশতে কত নম্বর দেবেন?
মাওলানা মামুনুল হক: একশতে এই সরকারকে সর্বোচ্চ ৪০-৫০ মার্ক দেওয়া যায়।
আওয়ার ইসলাম: আমরা সাম্প্রতিক সময়ে হেফাজতের আমিরকে জামায়াতে ইসলামী নিয়ে বেশ কিছু বক্তব্য দিতে দেখেছি। এটার মিশ্র প্রতিক্রিয়া হয়েছে। অন্যান্য ইসলামি দলের সঙ্গে জামায়াতের যে একটা জোটের আলাপ চলছিল, ওই বক্তব্যের কারণে জোটের মধ্যে কোনো প্রতিবন্ধকতা তৈরি হবে বলে মনে করেন কি?
মাওলানা মামুনুল হক: জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে অন্যান্য বিশেষ করে কওমি ঘরানার যে রাজনৈতিক দলগুলো জোট বা অ্যালায়েন্স হওয়ার কথা রয়েছে, এর পেছনে আমিরে হেফাজতের বক্তব্যের একটা প্রভাব অবশ্যই পড়েছে। আমিরে হেফাজত আল্লামা মুহিব্বুল্লাহ বাবুনগরী, তিনি দেশের সর্বজন গ্রহণযোগ্য শ্রদ্ধেয় প্রভাবশালী একজন আলেম। কাজেই তার কথার তো অবশ্যই গুরুত্ব রয়েছে। তবে এটাও ঠিক যে, তিনি একটা দিক বলছেন, সেটা ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে তিনি তার অবস্থান পরিষ্কার করছেন। আমরা মনে করি, আমাদের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের জন্য এটা একটা সতর্কবার্তা। কিন্তু রাজনীতিতে তো আরও অনেক বিষয় থাকে। যেগুলোকে ক্যালকুলেশন করেই রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হয়। সেই জায়গা থেকে আমি মনে করি রাজনৈতিক দলের যে উলামায়ে কেরাম নেতৃবৃন্দ আছেন, তারা তাদের মাঠ পর্যায়ে গোটা দলের কর্মীদের মিলেই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন।
আওয়ার ইসলাম: কওমি সনদের স্বীকৃতির যখন আলাপ আসে তখন শায়খুল হাদিস আল্লামা আজিজুল হক রহ.-এর আলাপটা খুব ভালোভাবে আসে। সর্বশেষ আল্লামা আহমদ শফী রহ. যে স্বীকৃতিটা নিয়েছেন, আমরা একটা স্বীকৃতি পেয়েছি বলেই দাবি করি; এই স্বীকৃতির বাস্তবায়নের প্রসঙ্গ নানাভাবে আলোচনায় আসছে। আল্লাহ তায়ালা যদি আপনাকে মন্ত্রী করেন অথবা এমপি করেন; এই সনদ বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে আপনার কোনো বিশেষ ভূমিকা থাকবে কি না।
মাওলানা মামুনুল হক: কওমি মাদরাসা সনদের রাষ্ট্রীর স্বীকৃতির ক্ষেত্রে ২০০৫ সালে শায়খুল হাদিস আল্লামা আজিজুল হক রহ.-এর নেতৃত্বে দেশব্যাপী যে একটা আন্দোলন হয়েছিল সেই আন্দোলনেও মাঠ পর্যায়ের একজন কর্মী হিসেবে ভূমিকা পালনের সুযোগ আমার হয়েছে। তাছাড়া আমি নিজেই কওমির একজন সন্তান। কাজেই সে ক্ষেত্রে তো আমার অবশ্যই অনেক দায়িত্ব রয়েছে। রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে দায়িত্ব বা ভূমিকা পালনের ন্যূনতম সুযোগও যদি আমাদের আসে, তাহলে অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে যে কাজগুলো করব, অবশ্যই তার মধ্যে একটা হবে এই দেশ এবং জাতির কল্যাণে, জাতির খেদমতে কওমি মাদরাসার শিক্ষার্থীদের যে ভূমিকা রাখার, অবদান রাখার যে সুযোগ আছে, সেই সুযোগের সর্বোচ্চটুকু যেন তাদেরকে দেওয়া হয়। এতে দেশ এবং জাতি উপকৃত হবে এবং বিপুল পরিমাণ কওমির যে শিক্ষার্থীরা আছে তারাও উপকৃত হবে।