Image description

রাজধানীর উপকণ্ঠে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচনী আসন নারায়ণগঞ্জ-১ (রূপগঞ্জ)। আগামী ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এ আসনের সম্ভাব্য প্রার্থী নিয়ে চলছে নানা জল্পনা-কল্পনা আর গুঞ্জন। সর্বশেষ চারটি নির্বাচনে এ আসনে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য ছিলেন সাবেক বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী ব্যবসায়ী গোলাম দস্তগীর গাজী (বীরপ্রতীক)। আসনটি ফিরে পেতে মাঠে নেমেছেন বিএনপির একাধিক নেতা। এতে বিভেদও সৃষ্টি হয়েছে দলের মধ্যে। তবে একক প্রার্থী নিয়ে অনায়াসে লক্ষ্যে এগিয়ে যাচ্ছে জামায়াতে ইসলামী।

এরইমধ্যে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সম্ভাব্য প্রার্থীরা কর্মী-সমর্থকদের নিয়ে নির্বাচনী এলাকায় গণসংযোগসহ নানা কর্মসূচি শুরু করেছেন। তবে এবারের নির্বাচনে বিএনপি ও তাদের দীর্ঘদিনের জোটসঙ্গী জামায়াত যে ভোটে তীব্র লড়াইয়ের মুখোমুখি হচ্ছে তার আভাস পাওয়া যাচ্ছে। 

রূপগঞ্জ উপজেলার ৭টি ইউনিয়ন ও ২টি পৌরসভা নিয়ে নারায়ণগঞ্জ-১ আসন গঠিত। উপজেলায় মোট ভোটার সংখ্যা ৩ লাখ ১৪ হাজার ১৯০ জন। এরমধ্যে পুরুষ ভোটার ১ লাখ ৯২ হাজার ৩৮ জন ও নারী ভোটার ২ লাখ ৪৯ হাজার ৫২ জন। শিল্পাঞ্চল এ উপজেলা রাজধানী লাগোয়া। ঢাকার সঙ্গে সহজ যোগাযোগ ব্যবস্থা, পূর্বাচল উপশহরসহ বিভিন্ন আবাসন প্রকল্পের কারণে এখানে গড়ে উঠেছে অনন্য অর্থনৈতিক ও সামাজিক কাঠামো। যার ফলশ্রুতিতে রূপগঞ্জকে রাজনৈতিক দলগুলো সবসময় ভিআইপি আসন হিসেবে দেখে থাকে। 

 

অতীত নির্বাচনের ফল

১৯৮৪ সালে নারায়ণগঞ্জ জেলা হিসেবে সৃষ্টির পর এ পর্যন্ত ১০টি জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয় এখানে। এর মধ্যে আওয়ামী লীগ পাঁচবার, বিএনপি তিনবার ও জাতীয় পার্টি দুইবার বিজয়ী হয়েছে। ১৯৮৬ ও ১৯৮৮ সালে জাতীয় পার্টির সুলতান উদ্দিন ভূঁইয়া এমপি নির্বাচিত হয়েছিলেন। এরপর ১৯৯১, ১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারির নির্বাচন ও ২০০১ সালে বিএনপির আবদুল মতিন চৌধুরী জয়ী হন। তিনি ছিলেন দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য। খালেদা জিয়ার সরকারের সময় তিনি স্বরাষ্ট্র এবং বস্ত্র মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছিলেন। 

১৯৯৬ সালে সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের কে এম সফিউল্লাহ (বীরউত্তম) জয়লাভ করেন। এরপর ২০০৮ সাল থেকে টানা চারটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জয়ী হন আওয়ামী লীগের গোলাম দস্তগীর গাজী (বীর প্রতীক)। তিনি বস্ত্র ও পাটমন্ত্রীর দায়িত্বও পালন করেছেন।

 

 

বিএনপিতে প্রার্থীজট

দলীয় সূত্রে জানা গেছে, নারায়ণগঞ্জ-১ আসনে বিএনপির মনোনয়ন চেয়ে ছয়জন মনোনয়ন প্রত্যাশী এরইমধ্যে প্রচার-প্রচারণা চালাচ্ছেন। মনোনয়ন প্রত্যাশীদের মধ্যে রয়েছেন মোস্তাফিজুর রহমান ভূঁইয়া দিপুর নাম। তিনি দলটির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য ও নারায়ণগঞ্জ চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি। এছাড়া জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করছেন। সভা-সমাবেশ ও ভোটারদের দ্বারে দ্বারে ঘুরে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছেন দীপু ভূঁইয়া।

মনোনয়ন প্রত্যাশী হিসেবে আলোচনায় রয়েছেন বীর মুক্তিযোদ্ধা ও বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য ও বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি কাজী মনিরুজ্জামান মনির। তিনি ২০০৮ ও ২০১৮ সালে দলের প্রার্থী ছিলেন। তিনিও নির্বাচনী মাঠে সরব রয়েছেন। বিভিন্ন সভা-সমাবেশ ও মিছিল-মিটিংয়ের মাধ্যমে মাঠে দলকে চাঙ্গা করতে ভূমিকা রাখছেন তিনি।

এদিকে পরিচ্ছন্ন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব রূপগঞ্জ উপজেলা বিএনপির সভাপতি অ্যাডভোকেট মাহফুজুর রহমান হুমায়ূনও দলের মনোনয়ন প্রত্যাশী হিসেবে নিজেকে প্রকাশ করেছেন। কেন্দ্রীয় যুবদলের সাবেক সহ-সাধারণ সম্পাদক দুলাল হোসেনও দলীয় মনোনয়ন পেতে নির্বাচনী মাঠ চষে বেড়াচ্ছেন। জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক ও দাউদপুর ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান শরীফ আহমেদ টুটুল মনোনয়ন প্রত্যাশী।

 

এছাড়া জেলা বিএনপির সাবেক ভারপ্রাপ্ত আহ্বায়ক নাসির উদ্দিনও মনোনয়ন প্রত্যাশী হিসেবে নিজের নাম ঘোষণা করেছেন। তারা সবাই আলাদাভাবে প্রচার-প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছেন। মনোনয়ন যুদ্ধে কেউ কাউকে ছাড় দিতে নারাজ।

 

নির্বাচনী মাঠে বিএনপি সক্রিয় থাকলেও দলীয় কোন্দল বিএনপির জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। দলীয় কোন্দল ও গ্রুপিংই বিএনপির জন্য বড় অন্তরায় বলে মনে করছেন স্থানীয় বিশ্লেষকরা। সম্ভাব্য প্রার্থীদের ঘিরে তৃণমূলে রয়েছে বিভেদ। অতিরিক্ত মনোনয়নপ্রত্যাশীর কারণে বিএনপিতে শুরু হয়েছে দলীয় বিশৃঙ্খলা। নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষও দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়ছে। গত এক বছরে বেশ কয়েকটি মারামারির ঘটনাও ঘটেছে। তবে মনোনয়ন নিয়ে দলীয় বিভাজন স্পষ্ট হলেও প্রার্থী চূড়ান্ত হলে সবাই মিলে মাঠে একত্রিত হয়ে কাজ করবে বলে মনে করছে দলের শুভাকাঙ্ক্ষীরা।

 

জামায়াতে একক প্রার্থী, প্রস্তুতিতে অন্যরা

জামায়াতে মনোনীত একক প্রার্থী হিসেবে রয়েছেন রূপগঞ্জ উন্নয়ন ফোরামের সভাপতি আনোয়ার হোসাইন মোল্লা। তিনি আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর নিয়মিতভাবে সভা-সমাবেশ করছেন। তার ছবি সংবলিত ফেস্টুন ও ব্যানারে ছেয়ে গেছে পুরো নির্বাচনী এলাকা।

আনোয়ার হোসেন মোল্লা নীরবে সাংগঠনিক শক্তি গড়ে তুলছেন। তিনি ধর্মীয় ও সামাজিক অনুষ্ঠানে অংশ নিচ্ছেন, যা সাধারণ ভোটারদের মধ্যে সাড়া ফেলেছে। জামায়াতে ইসলামী আগেভাগে একক প্রার্থী ঘোষণা করায় তাদের প্রার্থী ও কর্মী-সমর্থকরা প্রচারণা ও গণসংযোগে সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছেন। মূল দলের পাশাপাশি সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরাও একযোগে জামায়াতের প্রার্থীদের পক্ষে মাঠে কাজ করছে।

 

এছাড়া এনসিপির ইউসুফ হোসেন, সাইফুল ইসলাম রোমান; গণঅধিকার পরিষদের কাউসার আলী; ইসলামী আন্দোলনের মুফতি ইমদাদুল্লাহ হাসেমী ও মুফতি শিব্বির হোসেনসহ বেশ কয়েকজন নেতা প্রার্থী হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। যদিও মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে বিএনপি ও জামায়াতের মধ্যে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা।

ভোটারদের ভাবনা

মাঠ পর্যায়ে ভোটারদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ভোটাররা এবার এমন প্রার্থী চান, যিনি ভূমিদস্যুতার বিরুদ্ধে সরাসরি অবস্থান নেবে। মাদক ও সন্ত্রাস দমনে কার্যকর ভূমিকা রাখবে। ভূমিদস্যুতা, আবাসন প্রকল্পের দৌরাত্ম্য, মাদক, সন্ত্রাস আর চাঁদাবাজি এখানকার বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। কৃষিজমি দখল হয়ে যাচ্ছে, যুবসমাজ মাদক ও বেকারত্বে বিপথগামী হচ্ছে। ভোটাররা এমন প্রার্থী চান যিনি স্বচ্ছ রাজনীতি করবেন। জনগণের সমস্যা সরাসরি সমাধান করবেন। এমন প্রার্থীই বেছে নিবেন তারা।

ভোটাররা বলছেন, জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর বদলে গেছে রাজনীতির মাঠের হালচাল। আওয়ামী লীগ ও তাদের মিত্ররা ভোটের মাঠে নেই। ফলে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে মাঠ গোছাতে ব্যস্ত বিএনপি ও জামায়াত। প্রতিযোগিতা মূলত বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর মধ্যেই সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে।

 

প্রার্থীদের বক্তব্য

বিএনপির মনোনয়ন প্রত্যাশী মোস্তাফিজুর রহমান ভূঁইয়া দিপু জাগো নিউজকে বলেন, দীর্ঘদিন আন্দোলন-সংগ্রামে মাঠে ছিলাম। নেতাকর্মীদের পাশে থেকেছি। জেলার হাজার হাজার নেতাকর্মীর মামলার দায়িত্ব আমার কাঁধে ছিল, এখনো আছে। কোথাও যাতে কোনো বিশৃঙ্খলা না হয়, সে ব্যাপারে জিরো টলারেন্সে আছি। চাঁদাবাজি, লুটপাট, দখলবাজির প্রশ্রয় দিইনি। রূপগঞ্জের মানুষ আমাকে আপনজন মনে করে। আশা করি দল এসব ব্যাপারে চিন্তা করবে।

তিনি বলেন, দলের মনোনয়ন প্রত্যাশীদের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা আছে। তবে আদর্শিক বিরোধ নেই। বিএনপি যাকেই মনোনয়ন দেবে, সবাই ঐক্যবদ্ধভাবেই তার জন্য কাজ করবো।

কাজী মনিরুজ্জামান জাগো নিউজকে বলেন, বিএনপির প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই আমি এই দলের সঙ্গে আছি। সাবেক ফ্যাসিস্ট সরকারের দীর্ঘ ১৫ বছরের আমলে অনেক নির্যাতনের শিকার হয়েছি। অগণিত হামলা-মামলা মোকাবিলা করেছি। আমি রূপগঞ্জ থেকে ২০০৮ ও ২০১৮ সালে বিএনপি মনোনীত প্রার্থী ছিলাম। নীতিনির্ধারকরা এসব বিষয়ে বিবেচনা করে আমাকে মনোনয়ন দিলে দলের আদর্শ বাস্তবায়নে কাজ করবো।

অপর প্রার্থী দুলাল হোসেন বলেন, ফ্যাসিস্ট সরকারের আমলে অনেক নির্যাতনের শিকার হয়েছি এবং মামলা হামলার শিকার হয়েছি। দলের আদর্শকে বুকে ধারণ করে মাঠে কাজ করছি। দল থেকে মনোনয়ন দিলে নির্বাচিত হলে দুর্নীতি ও চাঁদাবাজমুক্ত ও আধুনিক রূপগঞ্জ গড়বো।

অ্যাডভোকেট মাহফুজুর রহমান হুমায়ূন জাগো নিউজকে বলেন, ১৫-১৬ বছর সাবেক ফ্যাসিস্টের অত্যাচার-নির্যাতনের মধ্যেও উপজেলা বিএনপিকে সুসংগঠিত রেখেছি। দল আমাকে মনোনয়ন দিলে সন্ত্রাস, মাদকমুক্ত ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য বাসযোগ্য রূপগঞ্জ উপহার দেবো।

  

জামায়াতের মনোনীত প্রার্থী মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন মোল্লা জাগো নিউজকে বলেন, আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে আমরা মানুষের কাছে যাচ্ছি। মানুষ চায় দুর্নীতিমুক্ত সমাজ। আমরা প্রতিহিংসাহীন মানবতার রাজনীতিতে বিশ্বাস করি। মানুষের জন্য কাজ করি। জাতীয় নির্বাচনে মানুষ এর প্রতিদান দিবে। জামায়াতের প্রতি সমর্থনের জন্য আহ্বান জানাচ্ছি। ভালো সাড়া পাচ্ছি। জামায়াতে ইসলামীর প্রতি মানুষের ভালোবাসা অতীতের তুলনায় অনেকাংশে বেড়েছে। জামায়াতে ইসলামী মানুষকে নতুন বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন দেখাচ্ছে। জনগণ ভোট দিয়ে নির্বাচিত করলে জনগণের সেবক হওয়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন তিনি।