
গণ-অভ্যুত্থানের পর পুলিশের ভঙ্গুর পরিস্থিতিতে মহাপরিদর্শকের (আইজিপি) দায়িত্ব নেন বাহারুল আলম। তিনি নির্বাচনের প্রস্তুতি, নিরাপত্তাঝুঁকি, পুলিশের সংস্কার, নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করাসহ বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলেন প্রথম আলোর সঙ্গে। তাঁর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন প্রথম আলোর নিজস্ব প্রতিবেদক মাহমুদুল হাসান।
এখন মূল আলোচনা জাতীয় নির্বাচন নিয়ে। ভোট কেমন হবে বলে মনে করেন? পুলিশ কতটা প্রস্তুত?
বাহারুল আলম: আমার বিশ্বাস, দেশবাসীর প্রত্যাশা অনুযায়ী একটি নিরপেক্ষ ও উৎসবমুখর নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এর জন্যই আসলে আমরা তৈরি হচ্ছি। আমাদের এখনকার সব কর্মকাণ্ড এটাকে ঘিরে। কারণ, এটা এমন একটা দায়িত্ব, যার ওপরে দেশ ও জাতির ভবিষ্যৎ এবং ভাগ্য নির্ভর করছে। আমরা এই নির্বাচনকে অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে দেখছি। এ জন্য দুই লাখ সদস্যের পুলিশ বাহিনীর প্রায় ৭৫ শতাংশ, মানে দেড় লাখ সদস্যকে আমরা মোটিভেশন ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে তৈরি করছি। তাঁদের সরাসরি নির্বাচনের কাজে নিয়োজিত করা হবে।
গণ-অভ্যুত্থান–পরবর্তী সময়ে পুলিশের মনোবল এখনো পুরোপুরি ফেরেনি। অপরদিকে জাতীয় নির্বাচনে ভোটকেন্দ্র হবে ৪৩ হাজারের মতো। সুষ্ঠু ভোটের জন্য এই জনবল দিয়ে নির্বাচনী পরিবেশ সামাল দেওয়া যাবে বলে মনে করেন কি না?
বাহারুল আলম: নির্বাচনের দায়িত্বে তো কেবল পুলিশ থাকবে না। পুলিশের পাশাপাশি একটা বড় অংশ থাকবে আনসার ও ভিডিপির। একটা কেন্দ্রে গড়ে দুজন পুলিশের সদস্য থাকবেন। তাঁর সঙ্গে আটজন, কোথাও ১০ জন আনসারের সদস্য থাকবেন। এর সঙ্গে সেনাবাহিনীর সদস্যরা আছেন। সীমান্ত এলাকায় বিজিবি, উপকূলীয় এলাকায় কোস্টগার্ড ও নৌবাহিনী থাকবে। আর সবচেয়ে বড় ভরসার জায়গা হচ্ছে মানুষ। কারণ, মানুষ যদি নির্বাচনমুখী হয়, অনেক রাজনৈতিক দলগুলো যদি নির্বাচনমুখী হয়, তাহলে আমার মনে হয় যে নিরাপত্তাঝুঁকিটা এমনিতেই অনেক কমে যায়। এরপরও নির্বাচন ঘিরে কখনো কখনো রেষারেষি এমন পর্যায়ে চলে যায় যে খুনোখুনি পর্যন্ত হয়ে যায়। অতীতে প্রতিটি নির্বাচনেই এমন ঘটনা ঘটেছে। এসব বিবেচনায় রেখে নির্বাচন ঘিরে কী ধরনের নিরাপত্তাঝুঁকি তৈরি হতে পারে, তা নিয়ে ‘গ্রাউন্ড ওয়ার্ক’ শুরু করেছি। ঝুঁকি নিরূপণে নির্বাচনী সম্ভাব্য অংশগ্রহণকারী প্রার্থীদের বিষয়গুলোও বিবেচনায় নেওয়া হচ্ছে। সব অংশীজন ও যাঁরা নির্বাচনে অংশ নেবেন, পর্যবেক্ষণ করবেন—তাঁদের মতামত শুনছি। এভাবে একটি সুন্দর নির্বাচনী পরিবেশ তৈরি হবে বলে আশা করছি।
এ ছাড়া সেই ১৯৯১, ২০০১ ও ২০০৮ সালের নির্বাচন যেগুলোকে দেশবাসী গ্রহণযোগ্য নির্বাচন মনে করে, সেখানেও তো পুলিশ এমন জনবল নিয়েই নির্বাচনী দায়িত্ব পালন করেছে। এ জন্য জনবল এখানে বড় বিষয় হয়ে উঠবে না। তবে ফ্যাসিস্ট রেজিম হয়তো নির্বাচনী পরিবেশ নষ্ট করার জন্য একধরনের প্রতিবন্ধকতা তৈরি করতে চাইবে। তবে এখানে আমাদের বড় শক্তির জায়গা হলো বাকি সব কটি দল উৎসাহের সঙ্গে নির্বাচন চায়।
একটা কেন্দ্রে গড়ে দুজন পুলিশের সদস্য থাকবেন। তাঁর সঙ্গে আটজন, কোথাও ১০ জন আনসারের সদস্য থাকবেন। এর সঙ্গে সেনাবাহিনীর সদস্যরা আছেন। সীমান্ত এলাকায় বিজিবি, উপকূলীয় এলাকায় কোস্টগার্ড ও নৌবাহিনী থাকবে। আর সবচেয়ে বড় ভরসার জায়গা হচ্ছে মানুষ।
আওয়ামী লীগ তো সাড়ে ১৫ বছর ক্ষমতায় ছিল। এখন তাদের কার্যক্রম নিষিদ্ধ। তাদের দিক থেকে কী ধরনের ঝুঁকি দেখেন?
বাহারুল আলম: তারা হয়তো কোথাও কোথাও কিছু নাশকতামূলক কাজ করতে পারে। হয়তো কোথাও বোমা বিস্ফোরণ করাল। কোথাও ভোটারদের বাধা দেওয়ার চেষ্টা করল। মানে ছোটখাটো কিছু হাঙ্গামা তৈরি করা অথবা একধরনের ভীতি তৈরির চেষ্টা করা। সবকিছু মিলিয়ে একদম যে ঝুঁকি নেই, তা–ও বলব না। তবে বাকি দলগুলো নির্বাচনমুখী হয়ে গেলে এ ধরনের কাজ খুব বেশি করতে পারবে বলে আমার মনে হয় না। তবু এই বিষয়গুলো বিবেচনায় রেখে আমাদের নিরাপত্তা প্রস্তুতি থাকবে। নির্বাচনে ইমার্জেন্সি ফোর্স, স্ট্রাইকিং ফোর্স এবং মোবাইল ফোর্স দায়িত্ব পালন করবে। এ ছাড়া এবারের নির্বাচনে নিশ্চয়ই অনেক জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষণ থাকবে।
নির্বাচনের সময়কার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে কোনো আলোচনা হচ্ছে কি না?
বাহারুল আলম: দলগুলোর শীর্ষ নেতৃত্বের পর্যায়ে আনুষ্ঠানিকভাবে আলোচনা হয়নি। তবে ব্যক্তি পর্যায়ে আমি, পুলিশ সদর দপ্তরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, ডিআইজি, জেলা পর্যায়ে এসপি ও অন্যদের সঙ্গে যোগাযোগ রয়েছে। আমি ব্যক্তিগতভাবে যখনই সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলি, তাঁরা একটি ভালো নির্বাচনের জন্য সব রকম সমর্থন এবং আশ্বাস দিচ্ছেন। তাঁরা পুরোপুরি সক্রিয় ও সহায়তার জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। এটাই আমাদের বড় শক্তি। তাঁদেরও ইচ্ছা নির্বাচন সফলভাবে অনুষ্ঠিত হোক। নির্বাচন সফলভাবে অনুষ্ঠিত না হলে কেবল আমরাই নয়, পুরো দেশই ঝুঁকির মধ্যে পড়বে।
নির্বাচনে ইমার্জেন্সি ফোর্স, স্ট্রাইকিং ফোর্স এবং মোবাইল ফোর্স দায়িত্ব পালন করবে। এ ছাড়া এবারের নির্বাচনে নিশ্চয়ই অনেক জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষণ থাকবে।
নির্বাচনে পুলিশ নিরপেক্ষ থাকবে কি না বা থাকতে পারবে কি না—অনেকের মধ্যে এটা নিয়ে সংশয় আছে। নির্বাচনকালে পুলিশের নিরপেক্ষতা নিশ্চিতে আপনারা কী করবেন?
বাহারুল আলম: প্রতিটি সরকারি কর্মকর্তা বা পুলিশ সদস্যের ব্যক্তিগতভাবে কোনো না কোনো রাজনৈতিক দলের প্রতি সমর্থন থাকতেই পারে। এটি স্বাভাবিক। গত ১৫ বছরে রাজনৈতিক মতাদর্শে অনুপ্রাণিত অনেকেই সরকারি চাকরিতে এসেছে, পুলিশেও এসেছে। ফলে তাদের মধ্যে স্বভাবতই একটি পক্ষপাতিত্ব জন্মাতে পারে। অন্যদিকে যাঁরা দীর্ঘ সময় পদোন্নতি বা সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়েছেন, তাঁদেরও একইভাবে রেজিমের প্রতি বিরূপ অনুভূতি বা ঘৃণা থাকতে পারে। তবু রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব—বিশেষত নির্বাচনসংক্রান্ত দায়িত্ব পালনে সবাইকে অবশ্যই নিরপেক্ষ হতে হবে। এই নিরপেক্ষতা ফিরিয়ে আনা সহজ কাজ নয়। এ জন্য এখন থেকেই আমরা মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ করছি। কাজের ধরনে পরিবর্তন আনার চেষ্টা করছি। তাদের বোঝাচ্ছি, রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালন দলীয় দৃষ্টিকোণ থেকে নয়, সম্পূর্ণভাবে নিরপেক্ষভাবে করতে হবে। নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসবে, তফসিল ঘোষণা হবে তখন পুলিশের কর্মকাণ্ড, অভিযোগ নিষ্পত্তি এবং বাস্তব আচরণই বলবে বাহিনী কতটা নিরপেক্ষ থাকতে পারছে। এখানে কোনো দ্রুত সমাধান নেই, প্রয়োজন দীর্ঘদিনের অনুশীলন।
এখন পুলিশের মাঠপর্যায়ের নেতৃত্বে থাকা কর্মকর্তাদের বড় অংশই বিগত সময়ে বঞ্চিত ও নন-অপারেশনাল ইউনিটে ছিলেন। নির্বাচন সামনে রেখে তাঁদের ওপর ভরসা রাখা যাচ্ছে কী?
বাহারুল আলম: সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রক্রিয়ায় অংশ নেওয়া পুলিশের গুরুত্বপূর্ণ একটি দায়িত্ব হলেও তাদের কাজ শুধু এটুকুতেই সীমাবদ্ধ নয়। মামলা তদন্ত, ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা, গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির নিরাপত্তা, অপরাধ অনুসন্ধান ও আদালতে মামলা পরিচালনাও পুলিশের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। এসব ক্ষেত্রে দক্ষতার ঘাটতি আছে, কারণ অনেক কর্মকর্তা দীর্ঘদিন মূল কাজে যুক্ত ছিলেন না। তবে নির্বাচনকালীন নিরাপত্তা, আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখা এবং বড় কোনো অনুষ্ঠান সামলানোর অভিজ্ঞতা তাঁদের রয়েছে। তাঁরা জেলার এসপি বা থানার ওসির দায়িত্বে না থাকলেও অন্যান্য পদে থেকে মাঠপর্যায়ে কাজ করেছেন। ফলে নির্বাচনী দায়িত্ব পালনে তাঁরা দক্ষতার পরিচয় দিতে পারবেন বলে আশা করি। তা ছাড়া নিরাপত্তা তো শুধু পুলিশের পোশাক পরে দাঁড়িয়ে থাকা নয়। আগেভাগে পরিকল্পনা ও প্রস্তুতি নিরাপত্তার নিশ্চিতের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক। আমরা সেটি করছি। এ বিবেচনায় নির্বাচন ঘিরে নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনায় তাদের সক্ষমতা নিয়ে তেমন উদ্বেগের জায়গা নেই।
কেউ কেউ সুষ্ঠু ভোটের জন্য কেন্দ্রে কেন্দ্রে ছাত্রদের দিয়ে স্বেচ্ছাসেবক দল গঠন করার কথা বলছেন। এমন প্রস্তাবকে কীভাবে দেখেন?
বাহারুল আলম: শুধু শিক্ষার্থীদের নিয়ে বিশেষভাবে কোনো স্বেচ্ছাসেবক দল গঠনের চিন্তা এখনো আমরা করিনি। তবে আমরা যে সহায়তা ও সহযোগিতা চাই, তা করতে হলে এটি বিশেষভাবে শিক্ষার্থীদের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখার প্রয়োজন নেই। সমাজের বোদ্ধা ও শান্তিপ্রিয় অংশের সহযোগিতাও আমাদের প্রয়োজন। আনুষ্ঠানিক নাম দিয়ে বা নির্দিষ্ট সংখ্যার কমিটি করে সেই সহযোগিতার দরকার না–ও হতে পারে। মূল বিষয়টি হচ্ছে তাঁদের সমর্থনটা লাগবে। শুধু পুলিশ, সেনাবাহিনী, বিজিবি ও আনসার দিয়ে সবকিছু হবে না।
গণমাধ্যমে খবর বেরিয়েছে, জামায়াত ভোটকেন্দ্রে বিশৃঙ্খলা প্রতিরোধে কমিটি করার চিন্তা করছে। এই উদ্যোগকে কীভাবে দেখেন? দলগুলোর এমন কমিটির নেতিবাচক কোনো দিক দেখেন?
বাহারুল আলম: যেকোনো রাজনৈতিক দল যদি কেন্দ্রে কেন্দ্রে এমন কোনো আনুষ্ঠানিক বডি গঠন করে, আমরা তো অবশ্যই স্বাগত জানাব। এর চেয়ে ভালো কিছু তো আর হতে পারে না। তখন আগেই আমরা বুঝব যে কোন কেন্দ্রে কোন দলের কোন ব্যক্তি সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য আমাদের সহযোগিতা করার ক্ষেত্রে মূল দায়িত্বে থাকবে। আবার এ তালিকায় থাকা ব্যক্তিদের উদ্দেশ্য সম্পর্কেও আমরা বুঝতে পারব।
তবে যেকোনো রাজনৈতিক দল বা কেউ সহযোগিতার করার কথা বলে কেন্দ্রে ঢুকে ব্যালট ছিনিয়ে নেবে বা নির্বাচনে বিশৃঙ্খলা তৈরির চেষ্টা করবে—তা হতে দেওয়া হবে না।
লুট হওয়া অস্ত্র প্রধানত দুই ধরনের। দীর্ঘ নলের রাইফেল বা এসএমজির মতো অস্ত্রগুলো অপরাধীদের ব্যবহার করা কঠিন। তবে স্বল্প দৈর্ঘ্যের স্বয়ংক্রিয় পিস্তল, যা সহজে লুকানো যায়—এগুলো সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ। প্রাথমিকভাবে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী এখনো এমন ৪০০টি পিস্তল উদ্ধার হয়নি। এই অস্ত্রগুলো উদ্ধারে আমরা সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিচ্ছি।
কারাগার ভেঙে অনেক সন্ত্রাসী বের হয়ে গেছেন। শীর্ষ সন্ত্রাসী হিসেবে পরিচিত অনেকে জামিনে বের হয়েছেন। অনেক অস্ত্র লুট হয়েছে। নির্বাচন ঘিরে কোনো পক্ষ এদের ব্যবহার করতে পারে কি না?
বাহারুল আলম: লুট হওয়া অস্ত্র প্রধানত দুই ধরনের। দীর্ঘ নলের রাইফেল বা এসএমজির মতো অস্ত্রগুলো অপরাধীদের ব্যবহার করা কঠিন। তবে স্বল্প দৈর্ঘ্যের স্বয়ংক্রিয় পিস্তল, যা সহজে লুকানো যায়—এগুলো সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ। প্রাথমিকভাবে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী এখনো এমন ৪০০টি পিস্তল উদ্ধার হয়নি। এই অস্ত্রগুলো উদ্ধারে আমরা সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিচ্ছি। কিছুদিন আগে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টাও এ–সংক্রান্ত পুরস্কারের ঘোষণা দিয়েছেন।
এখন পর্যন্ত মুন্সিগঞ্জের একটি ঘটনা ছাড়া সরাসরি এই অস্ত্রের ব্যবহার দেখতে পাইনি। যদিও পরিত্যক্ত অবস্থায় বা বিভিন্নভাবে কিছু অস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে। এখন পর্যন্ত উদ্ধারসংখ্যা ১৩৯। বাকি অস্ত্রগুলো কোথায় গেল, তা নিশ্চিত নয়। একটি সম্ভাবনা হলো এগুলো পার্বত্য অঞ্চলে সন্ত্রাসী সংগঠনের হাতে পড়েছে। আরেকটি সম্ভাবনা হলো এসব অস্ত্র রোহিঙ্গা শিবিরে মাধ্যমে কোথাও পৌঁছে যাওয়া। উদাহরণস্বরূপ আরাকান আর্মির কাছে চলে যাওয়া। এই সবই আমাদের আশঙ্কা। এখন পর্যন্ত আমরা নিশ্চিতভাবে বলতে পারি না যে, কোথায় কোন অস্ত্র গিয়ে পৌঁছেছে।
লুট হওয়া অস্ত্রগুলোর বাইরে মাঝেমধ্যে অন্য কিছু অস্ত্রের চালান ধরা পড়তে দেখছি। আবার পার্বত্য চট্টগ্রামে দেশের বাইরে থেকে একে-৪৭ এবং চায়নিজ রাইফেল আসার কথা শোনা যাচ্ছে। কোথাও কোথাও ধরাও পড়ার খবরও দেখছি। সব মিলেই এই জায়গাটায় এখনো একটু নাজুক পরিস্থিতি রয়ে গেছে।
এর বাইরে কারাগার থেকে বের হওয়া অপরাধী বা সন্ত্রাসীদের ক্ষেত্রে আমাদের বিশেষ নজরদারি আছে। তারা যাতে নতুনভাবে কোনো অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়াতে না পারে, সেদিকটি দেখা হচ্ছে।
দেশে অস্ত্রগুলো কারা আনছে, সে বিষয়ে আপনাদের কাছে কি কোনো তথ্য আছে?
বাহারুল আলম: এ জন্য এখন আমাদের সামনে চলমান সংঘাতগুলো কী কী—সেগুলো যাচাই করা জরুরি। একটি হলো সাধারণ অপরাধমূলক ব্যবহার; অর্থাৎ ‘পিওর ক্রাইম’ করার জন্য কিছু লোক অস্ত্র ব্যবহার করে। এ ধরনের অপরাধের জন্য চায়নিজ রাইফেলের মতো অস্ত্র আমদানি করে—এমন কোনো সুস্পষ্ট প্রমাণ আমরা এখনো পাইনি। এমন অস্ত্র এসে থাকলে তা মূলত সশস্ত্র সংঘাত হয়, এমন এলাকায় যাচ্ছে।
আরেকটি ক্ষেত্র হলো সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে সংঘাত। কয়েক দিন আগে পার্বত্য চট্টগ্রামে ইউপিডিএফ ও জেএসএসের মতো গোষ্ঠীগুলো পরস্পরের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। এসব স্থানে অস্ত্রের চাহিদা রয়েছে। একইভাবে আরাকান আর্মিও মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে এসব অস্ত্র ব্যবহার করে থাকে। তাই দেশের ভেতরে এসব বড় ধাঁচের অস্ত্র ব্যাপকভাবে ব্যবহার হবে—এমন আশঙ্কা আমরা আপাতত কম ভাবছি। তবে কোনো আশঙ্কাকে আমরা অগ্রাহ্য করছি না; সব ধরনের আশঙ্কা মাথায় রেখে কাজ করে যাচ্ছি।
আরেকটি ক্ষেত্র হলো সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে সংঘাত। কয়েক দিন আগে পার্বত্য চট্টগ্রামে ইউপিডিএফ ও জেএসএসের মতো গোষ্ঠীগুলো পরস্পরের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। এসব স্থানে অস্ত্রের চাহিদা রয়েছে। একইভাবে আরাকান আর্মিও মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে এসব অস্ত্র ব্যবহার করে থাকে।
গণ-অভ্যুত্থানের মামলায় অসংখ্য নিরপরাধ মানুষকে ঢালাওভাবে আসামি করে গ্রেপ্তার ও হয়রানি করা হচ্ছে। নিরপরাধদের মুক্তি দিতে কোনো উদ্যোগ আছে কি না? এর সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেবেন?
বাহারুল আলম: আমি মামলার তদন্তকারী দলের সদস্যদের নিয়ে অঞ্চলভিত্তিক ও জেলায় জেলায় নিয়মিতভাবে মিটিং করছি। দীর্ঘদিন ধরেই এটা চালাচ্ছি। যেখানে যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে, সেগুলো যাচাই-বাছাই করে পুলিশকে নির্দেশ দিচ্ছি যাতে নিরপরাধদের দ্রুত মুক্তি দেওয়া যায়। এ জন্য প্রতিটি মিটিংয়ে জিজ্ঞাসা করা হচ্ছে, ফৌজদারি কার্যবিধির ১৭৩(ক) ধারা অনুযায়ী কতটি অন্তর্বর্তী প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে।
কেউ নিজেকে নিরপরাধ উল্লেখ করে দায়মুক্তি চেয়ে দরখাস্ত না করলেও জেলা পুলিশ সুপারের উচিত স্বতঃপ্রণোদিতভাবে নিরপরাধদের মুক্তি দেওয়া—এটি আমি জোর দিয়েই বলছি। তবে নানা কারণে এ প্রতিবেদন দেওয়া নিয়ে পুলিশের মধ্যে একধরনের জড়তা ও দ্বিধা আছে। আমরা সেটা থেকে বের করে আনার চেষ্টা করছি।
আমি প্রতিদিন যে দরখাস্তগুলো পাই, তা সংশ্লিষ্ট জেলায় পাঠাই এবং কেন্দ্র থেকে তদারকি করি। ১৩৬টি অন্তর্বর্তী প্রতিবেদন ইতিমধ্যে দেওয়া হয়েছে। আরও প্রায় ২৩৬টি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। এ প্রক্রিয়া চলমান।
অপরাধের সঙ্গে সম্পৃক্ত না থাকা অনেক পুলিশ সদস্যের ক্ষেত্রেও এমন হয়েছে। কেউ কেউ কর্মস্থলে এক জায়গায় থেকে অন্য জায়গায় হয়রানিমূলকভাবে আসামি হয়েছেন। আমি তাগাদা দিচ্ছি যে এই জায়গায়ও আমাকে ন্যায়বিচার দিতে হবে। কারণ, আমার বাহিনীর সদস্যদের মনোবল ফেরানোর ক্ষেত্রে এটাও অনেক বড় একটা ইস্যু। পুলিশপ্রধান হিসেবে সেটা আমাকে দেখতে হবে।
হয়রানিতে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণে কিছু আইনগত জটিলতা আছে। যদি মামলা সম্পূর্ণ মিথ্যা হয়, তাহলে আইনে শাস্তির ব্যবস্থা আছে। কিন্তু ঘটনা সত্যি, কেবল নিরপরাধদের নাম যুক্ত করা হয়েছে—এমন হলে কোনো স্পষ্ট আইনি বিধান নেই। তবু যেখানে প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে, সেখানে প্রতারণা বা বেআইনি প্রভাব খাটানোর বিরুদ্ধে সরাসরি ব্যবস্থা নিচ্ছি।
হয়রানিতে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণে কিছু আইনগত জটিলতা আছে। যদি মামলা সম্পূর্ণ মিথ্যা হয়, তাহলে আইনে শাস্তির ব্যবস্থা আছে। কিন্তু ঘটনা সত্যি, কেবল নিরপরাধদের নাম যুক্ত করা হয়েছে—এমন হলে কোনো স্পষ্ট আইনি বিধান নেই।
পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে গণপিটুনি, মব তৈরি করে হামলা-আক্রমণ, অপহরণ, খুনসহ অনেক অপরাধ নিয়ে মানুষের মধ্যে শঙ্কা তৈরি হয়। বর্তমান আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে আপনার মূল্যায়ন কী?
বাহারুল আলম: অপরাধ দমন শুধু বলপ্রয়োগে সম্ভব নয়; কৌশল ও পরিকল্পনার মাধ্যমে কাজ করতে হয়। জনসমক্ষে ঘটে এমন অপরাধ—যেমন ছিনতাই, অজ্ঞান পার্টির কার্যক্রম বা প্রতারণা প্রতিরোধে পুলিশের দৃশ্যমান উপস্থিতি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পুলিশ যত বেশি দৃশ্যমান থাকবে, অপরাধীরা তত বেশি সতর্ক থাকবে।
ঢাকা শহরে প্রতিদিন প্রায় দুই হাজার পুলিশ রাস্তায় থাকে, বড় সমাবেশে সংখ্যা আরও বেড়ে যায়। তবু বিপুল জনসংখ্যার ভিড়ে পুলিশের উপস্থিতি অনেক সময় চোখে পড়ে না। তাই আমরা ভাবছি—প্যাট্রোল গাড়িগুলো যেন মানুষের দৃষ্টি ও শ্রুতিতে থাকে, যাতে মানুষ বুঝতে পারে পুলিশ আশপাশে রয়েছে—এ জন্য হুডার বাজানো হবে। তবে এতে শব্দদূষণের সমস্যা হতে পারে, তাই সব দিক বিবেচনা করছি।
দীর্ঘ মেয়াদে আমাদের প্রযুক্তিনির্ভর হতে হবে। কয়েক দিন আগে স্বরাষ্ট্রসচিব গিয়েছিলেন পাকিস্তানে। তিনি এসে জানালেন, পাকিস্তানে ‘নিরাপদ শহর প্রকল্প’-এর মতো উদ্যোগ অপরাধ দমনে ভালো ফল দিচ্ছে। এ প্রকল্পের মাধ্যমে পুরো শহরটাকে তারা ক্যামেরা দিয়ে একেবারে ছেয়ে ফেলেছে। এতে ভয়ে সেখানে জনসমক্ষে অপরাধ করাটা কমে গেছে। আমরা সে রকম উদ্যোগ বিবেচনা করছি। ইতিমধ্যে ট্রাফিক ও নির্বাচনী কাজে ব্যবহারের জন্য কিছু ‘বডি অন ক্যামেরা’ চালু করেছি। ভবিষ্যতে পুলিশ সদস্যরা মাঠে নামলে, মামলা তদন্ত হোক বা নিরাপত্তা দায়িত্ব—সবার শরীরে থাকবে এই ক্যামেরা। মানুষের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করাসহ পুলিশের বিরুদ্ধেও তো অনেক অভিযোগ। প্রযুক্তিনির্ভর এসব উদ্যোগ একদিকে পুলিশ সদস্যকে শৃঙ্খলাবদ্ধ রাখবে, অন্যদিকে জনগণের সঙ্গে পুলিশের আচরণ ও কার্যক্রমের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করবে।
কোনো কোনো পত্রিকায় খবর বেরিয়েছে, শেখ হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর থেকে পলাতক পুলিশ সদস্যের একটি অংশ দেশে অস্থিরতা তৈরির চেষ্টা করছে। এ বিষয়ে আপনাদের কাছে কোনো তথ্য আছে কি না?
বাহারুল আলম: হ্যাঁ, দেশে অনেকের সঙ্গে তাদের ব্যক্তিগত যোগাযোগের কথোপকথন আমরা পেয়েছি। বিভিন্ন অ্যাপসের মাধ্যমে কথা বলে তাদের তারা উজ্জীবিত করার চেষ্টা করে। তবে যারা পালিয়ে গেছে, তারা কিন্তু সংখ্যায় খুব বেশি না। আর তাদের ইমেজটাও খুব বাজে। এ জন্য এই যোগাযোগ খুব ভীতিকর কিছু না।
রাজনৈতিক কর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ করে উসকে দেওয়ার কিছু ঘটনায় হয়তো পালিয়ে যাওয়া কেউ কেউ যুক্ত। সে ক্ষেত্রে ওই কর্মীদের আশ্বস্ত করে এমন বলা হয়, ‘পুলিশের সঙ্গে কথা বলা আছে, তারা তোমাদের কিছু করবে না।’ পুলিশের নিচের দিকের পদগুলোতে থাকা কারও কারও সঙ্গে এমন যোগাযোগের তথ্য আমরা পেয়েছি। কারও কারও বিরুদ্ধে আমরা ব্যবস্থাও নিয়েছি। প্রমাণ পাওয়ার পরে তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা করে চাকরি থেকে বের করার প্রক্রিয়ায় আছে কিছু কিছু। তবে ঊর্ধ্বতন পদে থাকা কারও সঙ্গে যোগাযোগের এমন প্রমাণ আমরা পাইনি। এ জন্য যোগাযোগ করে তারা কোনো দুষ্কর্ম করবে অথবা অস্থিরতা তৈরি করতে পারবে, সেটা আমার কাছে মনে হয় না।
আমরা আরও প্রস্তাব করেছি—পুলিশপ্রধানের নিয়োগপ্রক্রিয়াও যেন আরও স্বচ্ছ ও নিয়ন্ত্রিত হয়। আমরা চাই, শুধু জবাবদিহি নয়, পুলিশের ‘ফাংশনাল ইনডিপেনডেন্সের’ বিষয়টিও যেন এই সংস্কারপ্রক্রিয়ায় অন্তর্ভুক্ত হয়।
পুলিশে সংস্কার নিয়ে বছর বছর আশ্বাস দেওয়া হয়, কিন্তু দৃশ্যমান কোনো পরিবর্তন দেখা যায় না। গণ-অভ্যুত্থান–পরবর্তী সময়ে এই বিষয় ব্যাপকভাবে আলোচনায় আসে। এই সংস্কার কোন পর্যায়ে আছে?
বাহারুল আলম: ২০০৭ সাল থেকেই পুলিশ সংস্কারের আলোচনা শুরু হয়। কিন্তু প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়নের বাইরে ছিল। বর্তমান সরকার আসার পর আবার বিষয়টি গুরুত্ব পেয়েছে। আমাদের মূল দাবি ছিল—পুলিশের কর্মক্ষেত্রে স্বাধীনতা নিশ্চিত করা, বিশেষ করে মামলা তদন্ত ও প্রসিকিউশনে যাতে রাজনৈতিক বা প্রশাসনিক নির্দেশ না থাকে।
একইভাবে ঊর্ধ্বতন পদে পদায়নে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত স্বচ্ছ প্রক্রিয়া চাই, যাতে একটি স্বাধীন কমিশন এই বিষয়গুলো দেখবে। আশা করেছিলাম সংস্কার কমিশন এসব বিষয়ে সুপারিশ দেবে, কিন্তু তারা বিষয়টি এড়িয়ে গেছে। তারা বলেছে, এটা আরও পরীক্ষা করে দেখা উচিত—সংবিধানভিত্তিক হবে নাকি আইনভিত্তিক হবে—এটা নিয়ে তারা সিদ্ধান্ত দেয়নি। অথচ কমিশনের কাজই ছিল এটা।
সরকার এখন নতুন করে আইন উপদেষ্টার নেতৃত্বে উপদেষ্টাদের একটি কমিটির মাধ্যমে পুলিশের জবাবদিহি নিশ্চিতের জন্য একটি নিরপেক্ষ সংস্থার প্রস্তাব করছে। যেখানে জনগণ পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ জানাতে পারবে এবং নিরপেক্ষভাবে তা তদন্ত হবে। আমরা বলেছি—পুলিশ সদস্যরাও যদি নিজের ঊর্ধ্বতনের দ্বারা অন্যায়ের শিকার হন, তাঁরাও যেন সেখানে অভিযোগ জানাতে পারেন। অর্থাৎ, অভিযোগ নিষ্পত্তির পাশাপাশি ক্ষোভ নিরসনের ব্যবস্থাও রাখতে হবে।
আমরা আরও প্রস্তাব করেছি—পুলিশপ্রধানের নিয়োগপ্রক্রিয়াও যেন আরও স্বচ্ছ ও নিয়ন্ত্রিত হয়। আমরা চাই, শুধু জবাবদিহি নয়, পুলিশের ‘ফাংশনাল ইনডিপেনডেন্সের’ বিষয়টিও যেন এই সংস্কারপ্রক্রিয়ায় অন্তর্ভুক্ত হয়।
পুলিশপ্রধান নিয়োগ কীভাবে স্বচ্ছ হতে পারে বলে মনে করেন?
বাহারুল আলম: আমাদের প্রস্তাবটি ছিল পুলিশ কমিশন গঠনের বিষয়ে। আমরা বলেছিলাম—আপিল বিভাগের একজন বিচারপতি, সরকারি দলের দুই সংসদ সদস্য, বিরোধী দলের দুই সংসদ সদস্য, একজন মানবাধিকারকর্মী এবং একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক মিলিয়ে একটি কমিশন করা যেতে পারে। এই কমিশন অতিরিক্ত আইজি পদমর্যাদার কর্মকর্তাদের মধ্য থেকে তিনজনের নাম সুপারিশ করবে। এরপর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সেই তিনজনের মধ্য থেকে একজনকে পুলিশপ্রধান হিসেবে নিয়োগ দেবে। এতে প্রক্রিয়াটি স্বচ্ছ ও ভারসাম্যপূর্ণ হবে। কিন্তু এখন কেবল কর্তৃপক্ষের ইচ্ছা-অনিচ্ছার ওপর তা নির্ভর করে। আইনেও বলা আছে, সরকার যাকে পছন্দ তাকে নিয়োগ দেবে। এতে স্বাভাবিকভাবেই পক্ষপাতের ঝুঁকি থেকে যায়।
আমরা বারবার বলেছি, যদি মামলা তদন্তে রাজনৈতিক নির্দেশ মেনে চলতে হয়, তাহলে মানুষ কখনো আমাদের বিশ্বাস করবে না। পুলিশকে জনগণের বন্ধু হতে হলে রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণমুক্ত হতে হবে। অতীতে কেউ কেউ দলীয় আনুগত্য করেছে, কিন্তু পুলিশের বড় অংশই এখন এই শৃঙ্খল থেকে মুক্তি চায়।
অনেকে বলেন, পুলিশই তাদের সংস্কার চায় না; তারা রাজনৈতিক আনুগত্য বজায় রেখে সুবিধা নিতে চায়। এ বিষয়ে কী বলবেন?
বাহারুল আলম: এ কথার সঙ্গে আমি একেবারেই একমত নই। আমরা ২০০৬ সাল থেকেই বলছি—আমাদের স্বাধীনভাবে কাজ করতে দিন, আমাদের ভালো করেন। কিন্তু সমাজ বা রাজনৈতিক নেতৃত্ব সেই ডাকে সাড়া দেয়নি। ৫ আগস্টের পর রাজারবাগে কনস্টেবলরা অস্ত্র হাতে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন—‘আমরা আর রাজনৈতিক নির্দেশে গুলি চালাতে চাই না, নিরপেক্ষ কর্তৃপক্ষের অধীনে কাজ করতে চাই।’ অর্থাৎ, সংস্কারের দাবি পুলিশের ভেতর থেকেই এসেছে।
আমরা বারবার বলেছি, যদি মামলা তদন্তে রাজনৈতিক নির্দেশ মেনে চলতে হয়, তাহলে মানুষ কখনো আমাদের বিশ্বাস করবে না। পুলিশকে জনগণের বন্ধু হতে হলে রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণমুক্ত হতে হবে। অতীতে কেউ কেউ দলীয় আনুগত্য করেছে, কিন্তু পুলিশের বড় অংশই এখন এই শৃঙ্খল থেকে মুক্তি চায়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও কর্মরত ও অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ সদস্যরা এই সংস্কারের পক্ষে কথা বলেন। তাই এটা ঠিক নয় যে পুলিশ সংস্কার চায় না।
পুলিশের ঘুষ গ্রহণ নিয়ে এখনো অভিযোগ শোনা যায়। সাধারণ মানুষ থানায় প্রবেশ করতে ভয় পায়, এ অবস্থার পরিবর্তনে আপনার কী উদ্যোগ আছে? মানুষের উদ্দেশ্যে আপনার বার্তা কী?
বাহারুল আলম: মানুষের আস্থা শুধু কথায় তৈরি হবে না; আমাদের নিজেদের গ্রহণযোগ্য ও উপকারী প্রমাণ করতে হবে। সেবা না দিলে মানুষ কীভাবে আমাদের আপন করবে বা কাছে টেনে নেবে? এখনো পুলিশের প্রতি ভয় ও অবিশ্বাস আছে, যা উপনিবেশ আমল থেকে চলে আসছে।
আবার দেখা যায়, পুলিশ কাজ করতে গেলে অনেক সময় আক্রমণের শিকার হয়। যদি মানুষ সত্যিই ভয় পেত, তাহলে পুলিশের ওপর হামলা হতো না। দায়িত্ব পালনকালে পুলিশের গায়ে হাত তোলাও সমাজের জন্য উদ্বেগজনক। কারণ, ন্যায়বিচারের শেষ কথা আদালত বললেও মাঠপর্যায়ে তাৎক্ষণিক সুরক্ষা পুলিশই দেয়। আবার সঠিক কাজ করলে মানুষ পুলিশের পাশে দাঁড়ায় এমন উদাহরণও আছে।
মানুষকে বলব—ভয় না পেয়ে অন্যায় দেখলে অভিযোগ করুন, আমরা অভিযোগ শুনব এবং তদন্তের প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি।
একদিকে অপরাধীদের দ্বারা পুলিশ সদস্যরা আক্রান্ত হচ্ছেন। আবার পুলিশের কাছ থেকে মারণাস্ত্র উঠিয়ে নেওয়ার বিষয়েও আলোচনা আছে। আসলে বিষয়টি কী?
বাহারুল আলম: এখানে কিছু ভুল–বোঝাবুঝি রয়েছে। মিছিল সমাবেশ নিয়ন্ত্রণে দীর্ঘ দূরত্বের বড় রাইফেলের দরকার নেই। এই ক্ষেত্রে প্রথমে সতর্কবার্তা, জলকামান, কাঁদানে গ্যাস, রাবার বুলেট ইত্যাদি বিভিন্ন পর্যায়ে ব্যবহার করে সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। মানুষ যদি প্রাণনাশের চেষ্টা করে তখনই কেবল জীবন রক্ষার উদ্দেশ্যে গুলি করা যেতে পারে। এটি পুলিশের নিয়ম ও নীতিমালায় নির্দিষ্টভাবে বলা আছে।
অন্যদিকে নিয়মিত টহল বা গ্রামীণ পর্যায়ে ডাকাত-সন্ত্রাসী ধরার অভিযানে রাইফেল বহন অপরিহার্য। এসআইরা (উপপরিদর্শক) তখন প্রাধিকার অনুযায়ী রিভলবার রাখবে। কনস্টেবলদের হাতে রাইফেল থাকবে। সন্ত্রাসীদের ধরতে গেলে এটা লাগবেই।
এই জায়গায় পুলিশ সদস্যদের মধ্যেও একটা ভুল–বোঝাবুঝি তৈরি হয়েছে। কেউ কেউ মনে করছে, এখন পুলিশ আর কোনো ‘লং ব্যারেল আর্মস’ ব্যবহার করবে না। বিষয়টি সেটি নয়। বরং অস্ত্রের প্রাসঙ্গিক ব্যবহার ও স্থানভেদে নিয়ন্ত্রণের কথা বলা হয়েছে।
আবার দেখা যায়, পুলিশ কাজ করতে গেলে অনেক সময় আক্রমণের শিকার হয়। যদি মানুষ সত্যিই ভয় পেত, তাহলে পুলিশের ওপর হামলা হতো না। দায়িত্ব পালনকালে পুলিশের গায়ে হাত তোলাও সমাজের জন্য উদ্বেগজনক। কারণ, ন্যায়বিচারের শেষ কথা আদালত বললেও মাঠপর্যায়ে তাৎক্ষণিক সুরক্ষা পুলিশই দেয়। আবার সঠিক কাজ করলে মানুষ পুলিশের পাশে দাঁড়ায় এমন উদাহরণও আছে।
পুলিশকে অনেকেই শাসকগোষ্ঠীর হাতিয়ার মনে করেন। এই ভাবমূর্তি বদলাতে কী করছেন?
বাহারুল আলম: আসলে বর্তমানে পুলিশের মোট জনবলের ৫০ শতাংশ নিয়োগ হয়েছে ২০০৯ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত সময়ে। এর অনেক নিয়োগ কেবল দলীয় প্রভাব ও আনুগত্যের কারণেই দেওয়া হয়েছে। কাজেই একধরনের আনুগত্য তাদের মধ্যে এখনো রয়ে গেছে। এটা হঠাৎ করে বদলানো যাবে না। এ জন্য এখন আমরা পুরো জনবলকে পেশাদার করতে প্রশিক্ষণের ওপর অধিক গুরুত্ব দিচ্ছি। এরপরও যাদের মধ্যে অন্ধ আনুগত্য থাকবে ধীরে ধীরে তাদের ‘অ্যাকটিভ সার্ভিস’ থেকে দূরেই রাখতে হবে।
এ ছাড়া বর্তমান সরকারের সময় নতুন করে সাত হাজার কনস্টেবল নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। আয়ারল্যান্ডসহ অভিজ্ঞ দেশগুলোর সঙ্গে আলোচনার জন্য প্রতিনিধিদল আনতে চাচ্ছি। তাদের অভিজ্ঞতা সংগ্রহ করে আমাদের পরিমার্জিত নীতি গ্রহণ করব।
দীর্ঘ মেয়াদে পুলিশের কাঠামো সহজতর করে নিয়োগপ্রক্রিয়া তিন স্তর থেকে দুই বা এক স্তরে উন্নীত করার ভাবনা ছিল। তা বাস্তবায়নের জন্য বিধি ও প্রশাসনিক অনুমোদন দরকার। এখনো কিছু প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক বাধায় তা আটকে আছে। অভ্যন্তরীণ বৈষম্য ও বিদ্বেষ নিরসনে এটি এখন না হলেও কখনো না কখনো করতেই হবে।
পুরোপুরি নিরপেক্ষ চরিত্রে ফেরাতে এসব উদ্যোগের ফলাফল ধীরে ধীরে আসবে। তাৎক্ষণিক জাদুকরি পরিবর্তন সম্ভব নয়। নিয়ম, প্রশিক্ষণ, নিয়োগপ্রণালি ও স্বচ্ছতা নিয়ে ধারাবাহিক কাজই সমাধান।
আপনাকে ধন্যবাদ।
বাহারুল আলম: আপনাকেও ধন্যবাদ।