টানা পাঁচ মাস ঘর ছাড়া আওয়ামী লীগ। ক্ষমতা হারানোর পর ধীরে ধীরে নীরবতা ভাঙছে দলটি। তবে এ যাত্রায় বিদেশের মাটিতে সভা-সমাবেশসহ নানা কর্মসূচিতে আওয়ামী লীগ সরব। এমনকি এসব সভায় দলের সভাপতি শেখ হাসিনা নিজে যুক্ত হয়ে ভাষণ দিচ্ছেন।
ঘরে ফেরার জন্য মরিয়া দলটির কৌশল আগাচ্ছে কয়েকটি ধাপে। হারানো রাজত্বের চেয়ে আওয়ামী লীগের কাছে এখন গুরুত্বপূর্ণ দলের ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধার করা।
দলের কাছে এখন বড় পরীক্ষা নিজেদের জনমনে নিজেদের ও অস্থান শক্ত করা। ১৯৭৫-পরবর্তী সময়ে এমন দুরবস্থা দেখেনি দলটি। তাই অভিজ্ঞতার আঁচও শূন্য। যদিও অনেকের মতে ’৭৫ সালেও আওয়ামী লীগকে এমন বিপর্যয়ে পড়তে হয়নি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পরেও দলটি অল্প সময়ের মধ্যেই মাঠের রাজনীতিতে ফেরা শুরু করতে পেরেছিল।
কেননা, দিন শেষে তারা সরকারে থাকার সময় রাজপথের আন্দোলনে ৮২৬ জনের (সর্বশেষ হালনাগাদ তালিকায়) মৃত্যু তথ্য জানিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। যদিও এখন পর্যন্ত এর দায় নিতে প্রস্তুত নয় তৎকালীন ক্ষমতাসীনরা। মাঠের রাজনীতির বাস্তবতায় এটি একটি হিসাবের বড় সমীকরণ। যারা ওই সময় সরকার পতনের প্রকাশ্যে নেতৃত্ব দিয়েছেন, সেই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা এসব হত্যার দায় পুরোটাই এককভাবে আওয়ামী লীগকে দিতে চায়। তাদের রাজনীতির বড় একটি খুঁটি এটি। আওয়ামী লীগকে মাঠে ফিরতে না দেওয়ার ক্ষেত্রে বড় হাতিয়ার হিসেবে শহীদের এই ট্রাম্প কার্ডটি ব্যবহার করছেন তারা।
গত ৫ আগস্ট আওয়ামী সরকারের পতন হয়। টানা চারবার ক্ষমতায় থাকা দলটির সভাপতি ও তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আন্দোলনের মুখে দেশ ত্যাগে বাধ্য হন। মাঝের এতটা সময় কেটে গেলেও দলের শীর্ষ নেতাদের ট্রমা কাটছে না। তাদের অনেকেই বিষয়টি এখনো মেনে নিতে পারছেন না। সরকারের সঙ্গে ‘বিশ্বাসঘাতকতা’ ও ‘বেঈমানি’ হয়েছে বলেই তাদের ধারণা। একই সঙ্গে সুপরিকল্পিতভাবে সরকার পতন ও আওয়ামী লীগের ভাবমূর্তি নষ্ট করা হয়েছে বলেও মনে করছেন দলের শীর্ষ নেতারা।
এই প্রতিবেদন তৈরির জন্য গত ৩ জানুয়ারি থেকে টানা কয়েক দিন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতিমণ্ডলির সদস্য থেকে শুরু করে সাংগঠনিক সম্পাদক পর্যায় পর্যন্ত বেশ কিছু নেতার সঙ্গে এই প্রতিবেদকের দীর্ঘ আলোচনা হয়েছে। তারা প্রায় সবাই এখন দেশের বাইরে অবস্থান করছে। সেই আলোচনায় আওয়ামী নেতাদের এমন মনোভাব স্পষ্ট।
মোটা দাগে এখন চারটি বিষয়কে ভাবনায় রেখে আগাতে চাচ্ছে আওয়ামী লীগ। বিদেশের পাশাপাশি দেশে পরিকল্পিত কর্মসূচি বাস্তবায়ন; মাঠের রাজনীতির বাস্তবতা বুঝে অপেক্ষা করা ও সুযোগ কাজে লাগানো; সরকার, বিএনপি ও নির্বাচন এই তিন কেন্দ্রিক দলের কেন্দ্র থেকে ভারসাম্য বজায় রেখে চলা এবং এলোমেলো সাংগঠনিক কাঠামো গুছাতে পূর্ণ মনোযোগ দেওয়া।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী আব্দুর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, সরকারকে যাদের নিরাপত্তা দেওয়ার কথা ছিল তারা বেইমানি করেছে। সরকার ও জনগণের সঙ্গে তারা বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। সেই ধাক্কা সামাল দেওয়া মানসিকভাবে কঠিন। কিন্তু এখান থেকেই দলকে ঘুরে দাঁড়াতে হবে। তিনি বলেন, দলের কেন্দ্রীয় পর্যায়ে নিজেদের যোগাযোগ আগের চেয়ে অনেক বেশি বেড়েছে। আমাদের নেত্রী (শেখ হাসিনা) নিয়মিত ফোরামে যুক্ত হয়ে নির্দেশনা দিচ্ছেন। আমাদের দিক থেকেও মাঠ পর্যায়ে যোগাযোগ বাড়ানো হচ্ছে। দেশে সুযোগ বুঝে কর্মসূচি বাস্তবায়নের অপেক্ষা করছি।
শুধু বিদেশে নয় দেশেও কর্মসূচি করতে চায়
বিদেশের মাটিতে বেশ কয়েকটি সভা সমাবেশ করেছে আওয়ামী লীগ। কিন্তু দেশে প্রকাশ্যে কোনো কর্মসূচি দিতে পারছে না। তৃণমূলের নেতাকর্মীদের মন থেকে এখনও হামলা মামলার ভয় কাটেনি। তবুও কেন্দ্রের নির্দেশনা বাস্তবায়ন করতে প্রস্তুত হচ্ছে কর্মীরা।
দেশের মাটিতে রাজনৈতিক অবস্থান মজবুত করাই এখন আওয়ামী লীগের বড় লক্ষ। এরই মধ্যে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে যেসব সভা সমাবেশ করেছে আওয়ামী লীগ সেখানে সরকারে থাকা সাবেক মন্ত্রী-এমপি সরাসরি উপস্থিত হয়ে বক্তৃতা দিয়েছেন। একাধিক সভায় দলের সভাপতি শেখ হাসিনা মোবাইলে যুক্ত হয়ে ভাষণ দিয়েছেন।
জার্মানিতে আয়োজিত এক সভায় সাবেক পররাষ্ট্র মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হাছান মাহমুদ উপস্থিত হয়ে বক্তৃতা করেছেন। ইউরোপের পাশাপাশি যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রে আওয়ামী লীগের কর্মসূচি জোরদার হচ্ছে। কমিটিগুলো আগের তুলনায় এখন অনেক বেশি সক্রিয়। কেউ কেউ আগামী সোমবার (২০ জানুয়ারি) অপেক্ষায় আছেন। কিছু নেতার ধারণা মার্কিন প্রশাসনের দায়িত্বে ডোনাল্ড ট্রাম্প আসলে আওয়ামী লীগের জন্য রাজনীতির পথ সহজ হবে। কিন্তু সেই আশায় দলের কেন্দ্র বসে থাকতে প্রস্তুত নয়। দেশে সাংগঠনিক কার্যক্রম ফিরিয়ে আনতে মাঠের কর্মীদের ওপর ভরসা রাখতে চায় আওয়ামী লীগ। আবার কেউ কেউ মনে করছেন, টানা ক্ষমতায় থাকাকালে যেসব ভুল হয়েছে সেগুলো নেমে নিয়ে জনগণের কাছে পৌঁছানো দরকার।
দলের কেন্দ্রীয় কমিটির শীর্ষ এক নেতা কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমেরিকা, ভারত বা অন্য কোনো শক্তি আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় বসিয়ে দিবে- সেটা আমরা বিশ্বাস করি না। এখনো দেশের ৫০ শতাংশ জনগণ আওয়ামী লীগকে সমর্থন করে। এরাই আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় আনবে। আমাদের কাজ তাদের কাছে যাওয়া। ভুল বোঝাবুঝি, মান অভিমান দূর করা।
সাংগঠনিক কাঠামো গুছাতে দলের মনোযোগ
এখন পর্যন্ত নেতাকর্মীদের নামে কত মামলা হয়েছে সেটির পূর্ণাঙ্গ তথ্য আওয়ামী লীগের কাছেও নেই। বেশিরভাগ কেন্দ্রীয় নেতারা দেশ ছাড়া। দেশে যারা আছেন তারাও হয় আত্মগোপনে রয়েছেন বা নীরব ভূমিকা পালন করছেন। তৃণমূল থেকে ব্যক্তি উদ্যোগে কিছু করতে গেলেও বিপদ বাড়ছে।
আওয়ামী লীগের বিপক্ষের মাঠের উত্তাপ এখনও কমেনি। নূর হোসেন দিবস পালন করা ছাড়া এখন পর্যন্ত আওয়ামী লীগ কোনো প্রকাশ্য কর্মসূচি ঘোষণা করেনি। নূর হোসেন দিবস পালনেও দল সফল হয়নি। বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে অবস্থিত দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়সহ দেশের প্রায় সব কার্যালয় এখনও ধংসস্তুপেই পরে আছে। তাই এখন নতুন কর্মসূচি দেওয়ার আগে মাঠের রাজনীতির বাস্তবতা বুঝে অপেক্ষা করতে চায় দল। তবে তলে তলে প্রস্তুতি জোরদার রাখতে চায়।
দলের কেন্দ্রীয় কমিটির এক সাংগঠনিক সম্পাদক কালের কণ্ঠকে বলেন, একেবারে কোনো কিছুই দল থেকে করা হচ্ছে না- এমনটা ঠিক নয়। যেসব কর্মসূচি ছোট পরিসরে হচ্ছে সেগুলো খবরে আসছে না। বর্তমান অবৈধ সরকার নিজেই আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক কাঠামো ভাঙতে মরিয়া হয়ে উঠেছে। তবুও বঙ্গবন্ধুর আদর্শের কর্মীরা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে এক ছাতার নিচে মজবুতভাবে অবস্থান করবে এবং ঘুরে দাঁড়াবে।
দলের সাধারণ সম্পাদকের 'পদ শূন্য'
দলের সাংগঠনিক অবস্থা যখন দুর্বল তখন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের পদ যেন কার্যত 'শূন্য' হয়ে আছে। ৫ আগস্টের কিছুটা আগ থেকেই সলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
সূত্রে জানা গেছে, ওবায়দুল কাদের এখন পশ্চিমবঙ্গের কলকাতায় অবস্থান করছেন। কিন্তু সেখানে দলের নেতা কর্মীদের সঙ্গে তার কোনো যোগাযোগ নেই। কলকাতায় অন্য যারা আছেন তারা ওবায়দুল কাদেরের ওপর বিরক্ত। কেউ দেখা করতেও যাচ্ছেন না।
দলের পক্ষ থেকে সাধারণ সম্পাদক হিসেবে ওবায়দুল কাদেরের কোনো বিবৃতিও পাওয়া যাচ্ছে না। দলের পক্ষে বেশিরভাগ বিবৃতি দিচ্ছেন কেন্দ্রের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম। ভিডিও বার্তায় সামনে আসছেন দলের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক।
এই বিষয়ে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির এক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আমি দলের বাইরে কথা বলতে চাই না। এখনও তিনি আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। পরের কাউন্সিল কবে হবে সেটা জানি না। স্বাভাবিকভাবে আগামী কাউন্সিল পর্যন্ত তিনিই সাধারণ সম্পাদক থাকবেন।'
সরকার, বিএনপি, নির্বাচন; তিন কেন্দ্রিক দলের ঝোঁক
আওয়ামী লীগ আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিজেদের অবস্থান অনেকটা শক্ত করে নিয়ে এসেছে। দেশের মাঠে দলের রাজনৈতিক অবস্থান মজবুত করতে সরকার, বিএনপি ও নির্বাচন এই তিন কেন্দ্রিক আওয়ামী লীগের কেন্দ্রের ঝোক রয়েছে। দ্রুত নির্বাচন চায় সদ্য ক্ষমতা হারানো দলটি। তাই সরকারের ভুল ও বিএনপির পদক্ষেপ নজরে রাখছেন আওয়ামী নেতারা। এতে মাঠের রাজনীতিতে ফেরাটা সুবিধা হবে।
আওয়ামী লীগ শূন্য দেশের বর্তমান রাজনীতিতে বিএনপি প্রধান রাজনৈতিক দল। অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি নির্বাচনের কথা তুলেছে বিএনপি। দলটি অন্তর্বর্তী সরকারের শুরু থেকেই নির্বাচনি রোড ম্যাপ চেয়ে আসছে। নির্বাচনের জন্য মাঠে আন্দোলন গড়াবে কিনা, রাজনীতির বাজারে সেই প্রশ্ন একেবারে তুলে রাখার সুযোগ নেই। এমন বাস্তবতায় রাজনৈতিক মহলে এই আলোচনাও রয়েছে, নির্বাচনী আন্দোলনে বিএনপির সঙ্গী আওয়ামী লীগ হলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।
এক প্রসঙ্গে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার সুষ্ঠু ও নিরেপক্ষ নির্বাচন করতে সক্ষম নয় বলে সাফ জানিয়েছেন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক বাহাউদ্দিন নাছিম। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, রাজনৈতিক ছাড়া দেশ চলতে পারে না। জনগণ যাকে ভোট দিবে সে সরকারে দায়িত্বে আসবে। আমরা জনগণের রায় মেনে নিতে প্রস্তুত।
বিএনপির সঙ্গে কোনো বোঝাপড়া হচ্ছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘বিএনপি একটি রাজনৈতিক দল। আমরা তাদের ওইভাবেই মূল্যায়ন করি। তাদের দলের নিজস্ব আদর্শ আছে। বিএনপিতেও মুক্তিযোদ্ধা আছে। এখানে সমঝোতা বা বোঝাপড়া কিছু নেই। গণতান্ত্রিক দলগুলো নিজস্ব পন্থায় রাজনীতি করছে।’