Image description

সিলেটের সঙ্গে বৈষম্য আর বৈষম্য। যেন বিচ্ছিন্ন এক জনপদ। দেখার কেউ নেই। দিনে দিনে জটিল হয়েছে পরিস্থিতি। ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক সিলেটের মানুষের গলার কাঁটা। রেলপথ ঝুঁকিপূর্ণ। আকাশপথে ভাড়া উচ্চ মূল্য। সবমিলিয়ে সিলেটের যোগাযোগ ব্যবস্থা 
একেবারেই নাজুক। এমন অবস্থায় সিলেটে ক্ষোভ আর ক্ষোভ। এই ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ দেখিয়েছে গতকাল সিলেটের ঐতিহাসিক কোর্ট পয়েন্টে হাজার হাজার মানুষ। আর এতে অংশ নিয়েছিলেন সব মত ও পথের মানুষ। এ সময় নগরের ব্যবসায়ীরা করেন ব্যতিক্রমী এক প্রতিবাদ। তারা সকাল ১১টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত দোকানপাট বন্ধ রেখে সমাবেশে একাত্মতা জানান। পরিবহন শ্রমিকদের বেশির ভাগই বন্ধ রাখেন গাড়ির চাকা। ফলে এক ঘণ্টার জন্য স্থবির হয়ে পড়েছিল সিলেট। সমাবেশ থেকে অন্তর্বর্তী সরকারকে আল্টিমেটাম দিয়েছেন সাবেক মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী। বলেছেন, আগামী ১৫ দিনের মধ্যে সিলেটের প্রতি এই বৈষম্য দূর করা না হলে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তোলা হবে। 

মূলত সমাবেশ ও কর্মসূচির আয়োজক ছিলেন সাবেক মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী। জনাকীর্ণ সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন ওলিকুল শিরোমনি হযরত শাহজালাল (র.) জামে মসজিদের খতিব ও প্রধান ইমাম হাফেজ মাওলানা আসজাদ আহমদ। এ ছাড়া রামকৃষ্ণ মিশনের মহারাজ, খ্রিস্টান মিশনারির ফাদার ও বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের ভিক্ষু মঞ্চে বসা ছিলেন। বিএনপি’র কেন্দ্রীয় সহ ক্ষুদ্র ঋণবিষয়ক সম্পাদক মুক্তিযোদ্ধা আব্দুর রাজ্জাকও সমাবেশে বক্তব্য রাখেন। ব্যবসায়ী, পরিবহন মালিক-শ্রমিক সহ নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ সমাবেশে মিছিল সহকারে এসে উপস্থিত জন। এই সমাবেশের ডাক দেয়া হয়েছিল কয়েক দিন আগে। চলে ব্যাপক প্রস্তুতিও। বেলা সাড়ে ১১টার আগে হাজারো মানুষের সমাগম ঘটে সমাবেশে। সিলেট মদন মোহন কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ আতাউর রহমান পীরের পরিচালনায় সমাবেশে সরকারের উদ্দেশ্যে স্মারকলিপি পাঠ করেন সাবেক মেয়র। এ সময় তিনি বলেন, মৌলিক নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে সিলেটবাসী। 

সিলেটের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, গ্যাস, বিদ্যুৎ ও যোগাযোগ খাতের ন্যায্য প্রাপ্যতা আজও নিশ্চিত হয়নি। রাজনৈতিক, সামাজিক প্রতিটি ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখা সত্ত্বেও সিলেটবাসী বৈষম্যের শিকার। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানি অর্থাৎ নাগরিকের মৌলিক চাহিদাগুলোর ন্যায্য অধিকার থেকে সিলেটবাসী বারবার বঞ্চিত হচ্ছে। তিনি বলেন, সমগ্র সিলেটের সড়ক ব্যবস্থা অসহনীয়ভাবে হুমকির মুখে। সিলেট-ঢাকা, সিলেট-চট্টগ্রাম মহাসড়ক উন্নয়নের কাজ থমকে আছে। শুধুমাত্র মহাসড়ক নয়, সিলেট শহরের অভ্যন্তরীণ সড়কগুলোরও বেহাল অবস্থা। তিনি বলেন, ঘন ঘন দুর্ঘটনা, টাকার বিনিময়ে অনির্দিষ্ট স্থানে ট্রেন থামানো, দালালের কারণে টিকিট না পাওয়া, নির্ধারিত সময়ে ট্রেন না ছাড়াসহ নানা সমস্যা এখন নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। সিলেট-ঢাকা রুটে নতুন ট্রেন সংযোজনের কথা থাকলেও তা বাতিল করা হয়েছে। সাবেক মেয়র জানান, রেমিট্যান্সযোদ্ধারা দেশের মাটিতে পদার্পণের পর নানাভাবে হেনস্তার শিকার হচ্ছেন। বিমান ভাড়ায় যাত্রীরা নাজেহাল হচ্ছেন। 

এ সময় আরিফ সিলেটের প্রবাসীদের দাবিগুলো তদন্তপূর্বক ব্যবস্থা গ্রহণ এবং ঢাকা-সিলেট, সিলেট-চট্টগ্রাম, সিলেট-কক্সবাজার রুটে বিমান চালুর দাবি জানান। সিলেটের মানুষ বিদ্যুৎ সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে উল্লেখ করে আরিফ বলেন, সিলেটে যেখানে বিদ্যুৎ উৎপাদন হয় ২ হাজার ৪৯৬ মেগাওয়াট, সেখানে সিলেট বিভাগে দেয়া হচ্ছে মাত্র ৭০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ। ফলে প্রতিদিন লোডশেডিং হচ্ছে সিলেটে। সিলেটের আবাসিক ও অনাবাসিক গ্যাস সংযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, সিলেট বাংলাদেশের গ্যাস ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। সিলেটের অনেকগুলো গ্যাসক্ষেত্র জাতীয় গ্রিডকে সমৃদ্ধ করছে। আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে সিলেটের গ্যাস উৎপাদন সাতগুণ বৃদ্ধি পাবে। কিন্তু পরিতাপের বিষয় সিলেটবাসী আবাসিক ও অনাবাসিক গ্যাস সংযোগের জন্য হন্যে হয়ে ঘুরছেন। 

সিলেটে গ্যাস থাকবে, আর সিলেটের লোকজন গ্যাস পাবে না- তা হতে পারে না। বাজেটের ক্ষেত্রে বিভিন্ন সিটি করপোরেশনের পরিসংখ্যান তুলে ধরে তিনি প্রশ্ন করেন, ‘সিলেটের সঙ্গে এটা কেমন বৈষম্য’? এদিকে, সমাবেশ শেষে সিলেটের জেলা প্রশাসক মো. সারওয়ার আলমের কাছে বিভিন্ন দাবি সংবলিত স্মারকলিপি প্রদান করেছেন সিলেটবাসী। এ সময় আরিফুল হক চৌধুরী বলেন, ‘আমরা আমাদের দাবিগুলো জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে সরকারের কাছে দিয়েছি। আগামী ১৫ দিনের মধ্যে আমাদের সুনির্দিষ্ট দাবিগুলো পূরণে সরকার কী ব্যবস্থা নেয়, তা জানাতে হবে। যদি ১৫ দিনের মধ্যে কোনো সিদ্ধান্ত না আসে, তাহলে সিলেটের সর্বস্তরের মানুষকে সঙ্গে নিয়ে কঠোর আন্দোলন গড়ে তোলা হবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘সরকারের প্রধান উপদেষ্টাকে অনুরোধ করবো, সড়ক পথে একবার সিলেটে আসুন। উনি তখন নিজেই বুঝতে পারবেন সিলেটের মানুষ কতোটা দুর্ভোগে আছেন।’ এদিকে, স্মারকলিপি গ্রহণ করে জেলা প্রশাসক মো. সারওয়ার আলম বলেন, যে সমস্যাগুলোর কথা বলা হয়েছে, সেগুলো সম্পর্কে আমরা অবগত। গত ৫-৭ বছর ধরে যোগাযোগ খাতে তেমন কোনো কাজ হয়নি, এজন্য মহাসড়কসহ অভ্যন্তরীণ সড়কগুলোর বেহাল দশা। তবে, আমি বিষয়টি নিয়ে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলেছি, কাজ শুরু হয়েছে। তিনি বলেন, অভ্যন্তরীণ বিমানের সকালে-বিকালে ভাড়ার তারতম্য কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। এ বিষয়ে শিগগিরই সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলোচনায় বসবো। পাশাপাশি সিলেট-ঢাকা মহাসড়কের দুর্ভোগ লাঘবে অন্তত একটি বিশেষ ট্রেন চালু করার বিষয়েও আলোচনা চলছে।