Image description
রাজবাড়ী

পদ্মা নদীর তীরে অবস্থিত ঢাকা বিভাগের ক্ষুদ্রতম জেলা শহর রাজবাড়ী। সারাদেশের মতো ক্ষুদ্র জেলা শহর রাজবাড়ীতেও লেগেছে ভোটের হাওয়া। ত্রয়োদশ জাতীয় নির্বাচনের এখনো তফসিল ঘোষণা করা হয়নি। কিন্তু এখনই যেন সম্ভাব্য প্রার্থীদের এতটুকু ফুসরত নেই। আগামী ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘোষণার পর থেকেই রাজবাড়ীর দুটি আসনেই সম্ভাব্য প্রার্থীরা ভোটের মাঠে সক্রিয় হয়ে উঠেছেন।

১৯৯১ সালের পর থেকে রাজবাড়ীর দুটি আসনেই আওয়ামী লীগ ছাড়াও বিএনপি ও জামায়াতের প্রার্থীরা নির্বাচিত হয়েছেন। তবে বর্তমান প্রেক্ষাপট সম্পূর্ণ ভিন্ন। আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর জেলার বাস্তব চিত্রই পাল্টে গেছে। কার্যক্রম নিষিদ্ধ হওয়া সংগঠনটির অধিকাংশ নেতা কেউ কারাগারে, অধিকাংশ আত্মগোপনে। 
এই অবস্থায় দীর্ঘদিন ধরে হাতছাড়া হওয়া রাজবাড়ীর দুটি আসন নিজেদের দখলে নিতে মরিয়া বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী। বড় এই দুটি দলের সম্ভাব্য প্রার্থীরা নির্বাচনী এলাকায় গণসংযোগ, উঠোন বৈঠক, ব্যানার- ফেস্টুন- ডিজিটাল ব্যানার লাগিয়ে ভোটারদের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করছে। তবে দুটি আসনেই জামায়াতে ইসলামী একক প্রার্থী দিয়ে অনেকটাই সুবিধানজনক অবস্থানে রয়েছে।

অন্যদিকে, বিএনপির একাধিক মনোনয়নপ্রত্যাশী মাঠে থাকায় দলটির নেতাকর্মীরা বিভক্ত হয়ে পড়েছে। বিএনপি একক প্রার্থী নিশ্চিত করতে না পারলে জামায়াত থাকবে অনেকটাই সুবিধাজনক অবস্থানে। তবে দুটি আসনেই হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের আলামত স্পষ্ট। 
জেলা নির্বাচন অফিসের তথ্য অনুযায়ী, রাজবাড়ী জেলায় মোট ভোটার ৯ লাখ ৪৭ হাজার ২৮৭ জন। এর মধ্যে পুরুষ ভোটার ৪ লাখ ৮২ হাজার ৭৯৬ জন এবং নারী ভোটার ৪ লাখ ৬৪ হাজার ৪৯১ জন। রাজবাড়ী-১ আসনে (সদর ও গোয়ালন্দ) মোট ভোটার ৪ লাখ ১০ হাজার ৭৭৭ জন, এর মধ্যে পুরুষ ভোটার ২ লাখ ৭ হাজার ৯০৪ জন, নারী ভোটার ২ লাখ ২ হাজার ৮৭৩ জন।

অন্যদিকে, রাজবাড়ী-২ আসনে (পাংশা, কালুখালী ও বালিয়াকান্দি) মোট ভোটার ৫ লাখ ৩৬ হাজার ৫১৭ জন, এর মধ্যে পুরুষ ভোটার ২ লাখ ৭৪ হাজার ৮৬৩ জন, নারী ভোটার ২ লাখ ৬১ হাজার ৬৫৪ জন।

রাজবাড়ী-১ (সদর ও গোয়ালন্দ) আসন ॥ রাজবাড়ী  সদর ও গোয়ালন্দ উপজেলা নিয়ে গঠিত এই আসনে বিএনপির হয়ে সম্ভাব্য প্রার্থী হিসেবে মাঠে সক্রিয় রয়েছেন- কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য ও সাবেক এমপি আলী নেওয়াজ মাহমুদ খৈয়ম, কেন্দ্রীয় কৃষক দলের সহ-সভাপতি ও জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক অ্যাডভোকেট মো. আসলাম মিয়া, জেলা বিএনপির সাবেক সিনিয়র যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও জেলা জিয়া স্মৃতি পাঠাগারের সভাপতি মো. আব্দুস সালাম মিয়া।
অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামী দলীয়ভাবে একক প্রার্থী আগেই ঘোষণা করেছে। কেন্দ্রীয় মজলিশে শূরার সদস্য ও রাজবাড়ী জেলা আমির অ্যাডভোকেট মো. নুরুল ইসলাম এবার লড়বেন জামায়াতে ইসলামীর মনোনয়নে। এ ছাড়া বাংলাদেশ খেলাফত মজলিশ রাজবাড়ী জেলা শাখার সভাপতি হাফেজ মাওলানা ইলিয়াস মোল্লা, এনসিপির কেন্দ্রীয় যুগ্ম আহ্বায়ক খালেদ সাইফুল্লাহ, গণঅধিকার পরিষদের রাজবাড়ী জেলা শাখার যুগ্ম আহ্বায়ক ওমান প্রবাসী মো. জাহাঙ্গীর খান আলোচনায় রয়েছেন।

এছাড়াও গণঅধিকার পরিষদের রাজবাড়ী জেলা শাখার সদস্যসচিব মো. রবিউল আজম, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের রাজবাড়ী জেলা সভাপতি অ্যাডভোকেট জাহাঙ্গীর আলম খান জাহিদ হাসান, ইসলামী আইন মজলিসের কেন্দ্রীয় সদস্য আমিনুল ইসলাম কাশেমীসহ আরও কয়েকজন প্রার্থী রয়েছেন নির্বাচনী মাঠে।

কেন্দ্রীয় মজলিশে শূরার সদস্য, রাজবাড়ী জেলা আমির ও জামায়াতে ইসলামী মনোনীত প্রার্থী অ্যাডভোকেট মো. নুরুল ইসলাম বলেন, ‘আমি নির্বাচিত হলে রাজবাড়ীতে একটি মেডিক্যাল কলেজ ও আধুনিক মেডিক্যাল হাসপাতাল স্থাপন করব। পাশাপাশি একটি কারিগরি কলেজ গড়ে তুলে শিক্ষার মানোন্নয়ন ও চিকিৎসা ব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটাব। একই সঙ্গে জেলাজুড়ে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণে কঠোর পদক্ষেপ নেব।’

রাজবাড়ী জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক এবং কৃষক দলের কেন্দ্রীয় সহসভাপতি আসলাম মিয়া চলমান সংকটেও নিয়মিত দলের কর্মসূচিতে সক্রিয় রয়েছেন। তিনি শুধু ঢাকায় নয়, মাঠেও সংগঠনের অভ্যন্তরীণ কাঠামো মজবুত করতে নেতৃত্ব দিয়ে চলেছেন। জুলাই-পরবর্তী আন্দোলন, বিএনপির কেন্দ্র ঘোষিত কর্মসূচি পালনসহ প্রতিটি ইস্যুতে মাঠে ছিলেন তিনি।
আসলাম মিয়া বলেন, ‘বিএনপি থেকে মনোনয়ন পেলে রাজবাড়ীর জন্য দ্বিতীয় পদ্মা সেতু, দৌলতদিয়া ঘাটকে ঘিরে শিল্পনগরী গড়ে তোলার মতো বড় প্রকল্প বাস্তবায়নে কাজ করব। জনগণই আমার শক্তি।’
রাজবাড়ী-১ আসনের বিএনপির মনোনয়নপ্রত্যাশী চার নেতা ইতোমধ্যে ভোটের মাঠে সক্রিয় হয়েছেন। এদের মধ্যে সাবেক সংসদ সদস্য ও বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য আলী নেওয়াজ মাহমুদ খৈয়ম, যিনি তিনবার রাজবাড়ী পৌরসভার মেয়র ছিলেন।

রাজবাড়ী অংকুর স্কুল ও কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ খৈয়ম জুলাই বিপ্লবের আগে আওয়ামী লীগের নির্যাতনের শিকার নেতাকর্মীদের চাঙ্গা করতে নানা কর্মকা- চালাচ্ছেন। ইউনিয়ন ও পৌরসভার নেতাদের সঙ্গে নিয়মিত সভা করে দিকনির্দেশনা দিচ্ছেন এবং বিভিন্ন পেশাজীবী ও শ্রেণি-পেশার লোকদের সঙ্গে মতবিনিময় করছেন।
আলী নেওয়াজ মাহমুদ খৈয়ম বলেন, ‘বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের আশীর্বাদ পেলে এলাকার মানুষের সেবা করার জন্য জীবন উৎসর্গ করব।’

রাজবাড়ী-২ (পাংশা, কালুখালী ও বালিয়াকান্দি) আসন ॥ রাজবাড়ীর পাংশা, কালুখালী ও বালিয়াকান্দি উপজেলা নিয়ে গঠিত এই আসনে বিএনপির হয়ে সম্ভাব্য প্রার্থী হিসেবে মাঠে রয়েছেন- জেলা বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক হারুন অর রশিদ, পাংশা উপজেলা বিএনপির সাবেক আহ্বায়ক অধ্যক্ষ এ আর মাহমুদুল হক রোজেন, বালিয়াকান্দি উপজেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি আবুল হোসেন খান, স্বেচ্ছাসেবক দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ব্যারিস্টার কাজী রহমান মানিক।

অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামী ইতোমধ্যেই একক প্রার্থী হিসেবে জেলা শূরা কর্মপরিষদ সদস্য ও পাংশা আব্দুল মাজেদ একাডেমির সহকারী শিক্ষক হারুন অর রশিদের নাম ঘোষণা করেছে। এ ছাড়া আলোচনায় রয়েছেন, এনসিপির কেন্দ্রীয় সদস্য, কবি ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক সাইয়েদ জামিল, গণঅধিকার পরিষদের ঢাকা মহানগর উত্তর ও তেজগাঁও মডেল থানা সভাপতি ইঞ্জিনিয়ার জাহিদ শেখ।

রাজবাড়ী-২ আসনে বিএনপির মনোনয়নপ্রত্যাশী হারুন অর রশিদ বলেন, ‘১৯৭৯ সালে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান একটি ফারাক্কা প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলেন, যা বর্তমানে পদ্মা ব্যারাজ নামে পরিচিত। আমাদের পার্টির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানও এ বিষয়ে কথা বলেছেন। এটি আমাদের জেলার একটি মেগা প্রকল্প এবং এর সঙ্গে ২৬টি জেলার মানুষের ভাগ্য জড়িত। আমরা নির্বাচিত হলে এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করব।’
রাজবাড়ীর উভয় আসনেই জামায়াতে ইসলামী ইতোমধ্যে একক প্রার্থী ঘোষণা করে মাঠে নেমেছে। অন্যদিকে বিএনপির অন্তত ৬ জন প্রার্থী দুই আসনেই সক্রিয় থাকায় তাদের ভোট ভাগাভাগির শঙ্কা দেখা দিয়েছে। প্রার্থীরা সবাই নিজ নিজ অবস্থান থেকে জনসংযোগ, উঠান বৈঠক, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচারসহ মাঠপর্যায়ে সক্রিয় রয়েছেন।
স্থানীয় রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, নির্বাচনের দিন যত ঘনিয়ে আসছে, রাজবাড়ীর দুই আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা ততই তীব্র হবে। বিএনপি যদি একক প্রার্থী নির্ধারণ করতে ব্যর্থ হয়, তবে জামায়াতের জন্য এ আসন দুটিতে সুবিধা পাওয়া সহজ হয়ে উঠবে।